বিশেষ প্রতিনিধি : মিয়ানমারে অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভ ঠেকাতে রাস্তায় শান্তিপ্রিয় বিক্ষোভকারীদের ওপর ছোঁড়া হচ্ছে রাবার বুলেট, জলকামান। এমনকি কখনো কখনো ছোড়া হচ্ছে সাউন্ড গ্রেনেড ও তাজা গুলি। চলছে গ্রেফতার অভিযান, বাড়ি বাড়ি তল্লাশি। এখন বাড়ি বাড়ি ঢুকে চালানো হচ্ছে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করছে সেনা-পুলিশ। নিরাপত্তা বাহিনীর এই অপতৎপরতা বিক্ষোভকারীদের জন্য নতুন আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। দেশজুড়ে এসব ঘটনার বেশ কিছু ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
এদিকে জোর করে ক্ষমতা দখলের পর থেকেই নিজেদের অবস্থান পোক্ত করতে শুরু থেকেই নানা বিধি-নিষেধ ও আইন চালুর সঙ্গে সঙ্গে সহিংস দমন পীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে জান্তা সরকার। চলতি সপ্তাহে তা আরও ভয়ানক রূপ নিয়েছে।
বিক্ষোভকারীদের গ্রেফতার করতে বাড়ি বাড়ি চিরুনি অভিযান চালাচ্ছে গেট ভেঙে ঢুকে বাড়িতে ভাঙচুর, মারধর ও লুটপাট চালানো হচ্ছে সেনা ও দাঙ্গা পুলিশ।
গত সোমবার সর্বদক্ষিণের উপকূলীয় তানিনথারি রাজ্যের মিয়েক শহরে সেনা ও পুলিশের একটি দল বেশ কয়েকটি বাড়ি ভাঙচুর ও এর বাসিন্দাদের মারধর করে। এর মধ্যে এক গর্ভবতী নারীকেও বেদম প্রহার করা হয়েছে। সেই সঙ্গে তার বাড়িও লুট করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ওই বাড়ির এক কিশোরকে গুলি করা হয়েছে।
এই হামলার ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। মিয়েক শহরের কোনো এক বাসিন্দার শেয়ার করা এই ভিডিওতে ওই গর্ভবতীকেও দেখানো হয়েছে।
সেখানে তিনি বলছেন, সেনা ও পুলিশের ৩০ সদস্যের একটি দল তার বাড়িতে ঢুকে পড়ে এবং আসবাব সামগ্রী ভাঙচুর করে। এ সময় তার মাথায়ও আঘাত লাগে। তার ঘর থেকে প্রায় চার লাখ কিয়াট ও একটি এটিএম কার্ড লুট করে নিয়ে গেছে পুলিশ।
শুধু একটা বাড়িতে নয়, মিয়েক শহরের অন্তত তিনটা ওয়ার্ডের বহু বাড়ির দরজা-জানালায় ভাঙচুর চালিয়েছে সেনা-পুলিশ। চালানো হয়েছে এলোপাতাড়ি গুলি।
গুলি করে হত্যা করে বলছে করোনায় মৃত্যু
বুধবার মান্দালয়ে মারা যাওয়া ওই বিক্ষোভকারীর স্বজনদের তার লাশ দেখতে দেওয়া হয়নি। কারণ হিসাবে বলা হচ্ছে করোনায় মৃত্যু।।বিক্ষোভের সময় নিরাপত্তা বাহিনীর হামলায় আহত দুজনকে শনিবার ভর্তি করা হয় মান্দালয়ের ৯১০ ব্যাটালিয়ন কম্পাউন্ড হাসপাতালে।
তাদের সঙ্গে আহত আরেকজন ইয়ার ঝার অং মারা গেলে তার স্ত্রী ফিউ ফিউ উইনকে বলা হয় তিনি করানোয় মারা গেছেন।
কিন্তু মৃতের স্ত্রী জানান, তাদের বিশ্বাস তাকে পিটিয়ে মারা হয়েছে। কারণ পায়ে গুলির আঘাত নিয়ে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
কেবল মৃত প্রতিবাদীকে করোনায় মৃত্যু বলে চালানো হয়নি। একই সঙ্গে তার সঙ্গে আহত বাকিদেরও স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না করোনার অজুহাতে। বলা হচ্ছে, ওই দুই আহতকে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। কারণ তারা করোনায় মৃত ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছিলেন।
করোনায় মৃত্যুর দাবি ও আহতদের সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের দেখা করতে না দেওয়ার বিষয়ে মুখ খুলছে না জান্তা সরকার ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি কীভাবে দেখছে বিশ্ব?
গত ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের পর রোববার সবচেয়ে রক্তাক্ত দিন পার করেছে মিয়ানমার। কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা প্রতিবাদ দমাতে এদিন মিয়ানমারজুড়ে বিক্ষোভে পুলিশ গুলি চালালে এতে অন্তত ২৬ জন নিহত হন।
মিয়ানমারে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি টম অ্যান্ড্রুজ বলেছেন, জান্তার আক্রমণ অব্যাহত থাকবে এটি পরিষ্কার ছিল, তাই বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া জোরদার করা উচিত।
তিনি জানান, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা, অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আরও বেশি দেশ থেকে আরও বেশি নিষেধাজ্ঞা, সামরিক বাহিনীর ব্যাবসাগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে পদক্ষেপ নিতে হবে।
এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, “নিন্দাবাক্যকে স্বাগত জানাই কিন্তু এগুলো যথেষ্ট নয়। আমাদের অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের চোখের সামনে মিয়ানমারে যে দুঃস্বপ্ন শুরু হয়েছে তা আরও খারাপ হবে। বিশ্বকে অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে।”
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন এ ঘটনাকে নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত ‘জঘন্য সহিংসতা’ মন্তব্য করে এর নিন্দা জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র দৃঢ়ভাবে মিয়ানমারের জনগণের পাশে আছে জানিয়ে রোববার এক টুইটে তিনি বলেন, তাদের ইচ্ছার প্রতি সমর্থন জানাতে সব দেশকে এক সুরে কথা বলার জন্য উৎসাহিত করছি আমরা।
কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্ক গার্নাউ বলেছেন, সামরিক বাহিনী তাদের নিজেদের জনগণের বিরুদ্ধেই প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহার করেছে, এটি ভয়াবহ ঘটনা।
ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ইন্দোনেশিয়া মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীকে বিক্ষোভ দমনে বলপ্রয়োগে আরো সংযত থাকার এবং রক্তপাত ও প্রাণহানি এড়াতে সর্বোচ্চ ধৈর্যের অনুশীলন করার আহ্বান জানাচ্ছে।
মিয়ানমারের বিক্ষোভকারীদের সমর্থনে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের আন্দোলনকারীরাও প্রতিবাদের আয়োজন করেছেন। থাইল্যান্ডের তরুণদের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক আন্দোলন মিয়ানমারের অভ্যুত্থান বিরোধীদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।
আদালতে সূচি
চলমান বিক্ষোভের মধ্যেই প্রথমবারের মতো ভিডিও সংযোগের মাধ্যমে আদালতে হাজিরা দিয়েছেন অং সান সু চি। তার বিরুদ্ধে আরও দুটি অভিযোগ আনা হয়েছে। আর আগামী ১৫ মার্চ পর্যন্ত স্থগিত রাখা হয়েছে মামলার শুনানি। সার্বিক শুনানি শেষে অন্তত দুই বছরের জেল হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ভয়াবহতম রক্তাক্ত দিন
মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চলমান বিক্ষোভে আজ কাঁদুনে গ্যাস, স্টান গ্রেনেড নিয়ে বিক্ষোভকারীদের উপর চড়াও হওয়ার পাশাপাশি গুলিও ছুড়েছে পুলিশ।
এ সময় পুলিশের গুলিতে কমপক্ষে ২৬ জন নিহত হয়েছে বলে জানা যায় আন্তর্জাতিক সংবাদসংস্থা আল জাজিরা সুত্রে। দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর আজকের দিনটিকে ভয়াবহতম রক্তাক্ত দিন বলে আখ্যায়িত করছে গণমাধ্যমগুলো।
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রচারকৃত ছবিতে দেখা গেছে, রক্তাক্ত অবস্থায় বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারীকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন সহকর্মীরা।
এ প্রসঙ্গে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটির প্রথম ক্যাথলিক কার্ডিনাল চার্লস মং বো টুইটারে বলেছেন, ‘মিয়ানমারের অবস্থা যুদ্ধক্ষেত্রের মতো।
উল্লেখ্য, গত ১ ফেব্রুয়ারি দেশটিতে তাতমাদাও নামে পরিচিত মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী সেনা অভ্যুত্থান ঘটায়। একই সাথে প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট ও স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চিসহ রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করে। পাশাপাশি দেশটিতে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। সামরিক বাহিনীর এই অভ্যুত্থান কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে, গত বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে বিতর্ককে।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে সেনা অভ্যুত্থানের প্রতিবাদে মিয়ানমারের বিভিন্ন শহরেই বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভকারীরা অং সান সু চিসহ বন্দী রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তির পাশাপাশি সামরিক শাসন প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছেন।
মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি
দেশটির সরকারি অফিস কাচারি জনশূন্য। হাসপাতালগুলো পড়ে আছে, যেনো পরিত্যক্ত। রেলস্টেশনগুলোতে থেমে আছে ট্রেন। মিয়ানমারে লাখ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী জান্তা সরকারের জন্য কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। স্থবির হয়ে পড়ছে দেশটির অর্থনীতি।
মিয়ানমারে গত প্রায় চার সপ্তাহ ধরে সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে চলছে অসহযোগ আন্দোলন। চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে ‘সিভিল ডিসওবেডিয়েন্স মুভমেন্ট’ (সিডিএম) নামে এই আন্দোলন মিয়ানমারজুড়ে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।
মিয়ানমারে কারাবন্দিদের অধিকার নিয়ে কাজ করা ‘অ্যাসিসট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স’ জানিয়েছে, অভ্যুত্থানের পর থেকে ১১৩২ জনকে গ্রেপ্তার, অভিযুক্ত বা সাজা দেওয়া হয়েছে, এদের মধ্যে ২৭০ জনকে রোববার আটক করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে, মিয়াননারের পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক হবে। নিজ দেশের জনগণের প্রতি দেশটির সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নে স্তম্ভিত গোটা বিশ্ব। পরিস্থিতি আরও নাজুক হবার আশঙ্কাই করা হচ্ছে। তবে মিয়ানমারের সাধারণ মানুষের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভ, দেশটির ভবিষ্যত রাজনৈতিক দিক নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে।
আপনার মতামত জানানঃ