পরিকল্পনা নিয়ে প্রকল্পগুলো শুরু করা হলেও সেই পরিকল্পনা আর একসময় পরিকল্পনা থাকছে না। বিভিন্ন কারণে কিংবা অজুহাতে প্রকল্পগুলোর সময় ও ব্যয় বাড়ানো এখন প্রতিটা প্রকল্পেরই অখণ্ডনীয় ভাগ্য হয়ে গেছে। সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ি প্রকল্পের ব্যয় ও সময় বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। নতুন করে প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকার মতো বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এ নিয়ে এরই মধ্যে দুই দফা আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়েছে। সিপিজিসিবিএলের প্রস্তাব যাচাই-বাছাই শেষে একনেকে পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এ খরচ বাড়লে এটি হবে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যয়বহুল প্রকল্প। এখন পর্যন্ত দেশে সবচেয়ে বেশি খরচ করা হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে।
বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে ২০১৪ সালে কয়লাভিত্তিক একটি মেগা প্রকল্পের অনুমোদন দেয় সরকার। লক্ষ্য মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে সাত বছর। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা সিপিজিসিবিএল। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নতুন করে এ প্রকল্পে অতিরিক্ত আরো প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধিসহ আড়াই বছর মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল) সূত্রে জানা গেছে, নতুন করে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকার মতো খরচ বাড়তে পারে মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্পে। এতে প্রকল্পের ব্যয় ৩৬ হাজার কোটি থেকে বেড়ে ৫০ হাজার কোটি টাকাও ছাড়িয়ে যাবে। এ খরচ বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
সিপিজিসিবিএলের তথ্যমতে, প্রকল্পের ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছিল ৩২ হাজার ৯৯২ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এরপর ঠিকাদার নিয়োগ খরচ বেশি হওয়ায় এর বর্তমান ব্যয় গিয়ে দাঁড়ায় ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকায়। তার মধ্যে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) ঋণ হিসেবে দিচ্ছে ২৮ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা এবং বাকি সাত হাজার ৪৫ কোটি দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার ও সিপিজিসিবিএল।
২০১৪ সালে ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘মাতারবাড়ী ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল ফায়ার্ড পাওয়ার প্রজেক্ট’ শীর্ষক প্রকল্পটি অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদকাল ধরে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সরকারি খাতের সিপিজিসিবিএল।
সম্প্রতি মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগে পাঠিয়েছে সিপিজিসিবিএল। এ প্রস্তাব অনুমোদনে দুই দফা আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়েছে। কিন্তু এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি সরকার। তবে শিগগির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে বলে জানা গেছে।
সিপিজিসিবিএলের সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (আরডিপিপি) বলা হয়, কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ী-ধলঘাটা ইউনিয়নে বাংলাদেশ সরকার ও জাইকার অর্থায়নে বাস্তবায়ন হচ্ছে মাতারবাড়ী ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল ফায়ার্ড পাওয়ার প্রজেক্টটি। এর আওতায় সমুদ্রপথে কয়লা পরিবহনের জন্য ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, ২৫০ মিটার প্রশস্ত, ১৮ দশমিক ৫ মিটার গভীর চ্যানেলসহ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপনে অবকাঠামো তৈরি এবং কয়লা ও তেল আনলোডিং জেটিসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। এক্ষেত্রে ব্যয় বাড়ানোর অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় নির্মাণাধীন চ্যানেলের ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টি। বলা হয়, চ্যানেলটি আরো ১০০ মিটার প্রশস্ত এবং অতিরিক্ত ৩৯৭ মিটার সেডিমেন্ট মিটিগেশন ডিকে নির্মাণ বাবদ ব্যয় হবে ২ হাজার ৩৭৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আজাদ জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, সংগত কারণেই আমরা মন্ত্রণালয়ে ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠিয়েছি। এটা নিয়ে মন্ত্রণালয় বৈঠকও করেছে বলে শুনেছি। কিন্তু আমরা এখনো প্রস্তাবটির অনুমোদন পাইনি। পোর্টের উন্নয়ন কার্যক্রম এ প্রকল্পে রাখা হবে কিনা, সেটা একটা সিদ্ধান্তের বিষয় ছিল। এখন পোর্টকে এ প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসায় ব্যয় বাড়ছে। প্রকল্পের বাস্তবায়ন বিষয়ে জানতে চাইলে এখন পর্যন্ত ৪০ শতাংশের মতো কাজ হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এজন্য ২০২৬ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালে। পরে সেটার নতুন সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে। তবে প্রকল্পের স্বত্বাধিকারী সিপিজিসিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম তখন বলেছিলেন, ২০২৩ সালের মাঝামাঝিতে তারা কাজ শেষ করতে পারবেন। এখন আবার তিনি বলছেন, ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এজন্য ২০২৬ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানোর প্রক্রিয়া করছেন।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্পটির আর্থিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ব্যয় বৃদ্ধি ও বাস্তবায়নের সময় পিছিয়ে যাওয়ায় এই প্রকল্পের আর্থিক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে যে ইতিবাচক প্রবণতা দেখা গিয়েছিল, তা অনেক কমেছে। প্রকল্পটি থেকে যে অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জন সম্ভব ছিল, তা-ও পেতে বিলম্ব হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানা কারণে অনেক প্রকল্পেরই ব্যয় বাড়তে পারে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন করা গেলে সেই ব্যয় বৃদ্ধির ক্ষতি পোষানো যায়। কিন্তু বিলম্বের ক্ষতি কখনোই পোষানো যায় না।
তারা বলছেন, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণে যেন ব্যয় না বাড়ে, সেজন্য বিশেষ লক্ষ রাখতে বলেছেন। এক্ষেত্রে পোর্টের জন্য অতিরিক্ত ২ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা বাড়লে বাকি প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা প্রকল্প বিলম্ব হওয়ার কারণেই বাড়ছে বলে মনে হচ্ছে। যদি এ ব্যয় বৃদ্ধি প্রকল্পের বিলম্বের জন্য হয়ে থাকে তাহলে সেটা অযৌক্তিক।
এসডব্লিউ/বিবি/কেএইচ/১৩২০
আপনার মতামত জানানঃ