ঔষধ প্রশাসন অধিপ্তরের প্রতিটি ধাপে দুর্নীতি হচ্ছে বলে অভিযোগ। ড্রাগ লাইসেন্স নবায়ন, নতুন লাইসেন্স প্রদান, ওষুধ নিবন্ধন, নমুনা পরীক্ষা, মান নিয়ন্ত্রণ ও রপ্তানি নিবন্ধনসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনায় প্রতিষ্ঠানটিতে সীমাহীন ঘুষ-বাণিজ্য চলছে। আর এতে বাজারে মানহীন নকল ওষুধে সয়লাব হয়ে গেছে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। গত সোমবার (৮ ফেব্রুয়ারি) দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
দুদকের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কার্যালয়ে সেবা প্রার্থীরা কোন কোন ক্ষেত্রে যথাযথ কাগজপত্র দাখিল না করে দ্রুত সেবা পেতে চায়। এ সুযোগে অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা খরচের বিভিন্ন প্যাকেজ অফার করে। যা নির্ধারিত ফি-এর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, দুর্নীতির অন্যতম উৎস হচ্ছে ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরিতে ওষুধের গুণগত মানের সনদ গ্রহণ প্রক্রিয়া। এ ল্যাবে সারাদেশে উৎপাদিত ও আমদানিকৃত ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য সনদ গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক। ওষুধের মান সঠিক রাখার লক্ষ্যে নিয়মিত পরীক্ষার ব্যবস্থা করাই ড্যাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরির মূল কাজ। মান পরীক্ষা করার পর মানের সনদপত্র দেয়া হয়। কোন কোম্পানি কি ওষুধ তৈরি করেছে। কোনটার মান কতটা স্ট্রান্ডার্ড। আর উৎপাদিত ওষুধ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী হচ্ছে কিনা এ বিষয়গুলো চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের যেমন ঘাটতি রয়েছে তেমনি অনিয়ম দুর্নীতি, হয়রানির অন্যতম উৎসও এগুলো।
অভিযোগ রয়েছে, অনেক নামসর্বস্ব কোম্পানি আছে যাদের পণ্য পরীক্ষায় মান উত্তীর্ণ হয় না, কিন্তু সেগুলোকেও মানসম্মত বলে সনদ দেয়া হয়। এর ফলে পাইকারি ও খুচরা ওষুধ মার্কেটে নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি হওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। নিম্নমানের ওষুধ জনস্বাস্থ্যের জন্য বিশাল হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ওষুধ উৎপাদনকারী সব প্রতিষ্ঠানে মানসম্মত ওষুধ তৈরি করছে কিনা তা সরজমিনে পরিদর্শন করার কথাও রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ওষুধ উৎপাদনকারী অনেক প্রতিষ্ঠান বিধি-বিধান অনুসরণ করে পরিদর্শন করা হয় না। প্রতিষ্ঠানগুলো পদ্ধতিগতভাবে পরিদর্শন না করে অনৈতিকভাবে সুবিধা গ্রহণ করে পরিদর্র্শনের প্রতিবেদন দেন বলে অভিযোগ আছে। যার কারণে ওষুধ মার্কেটে নিম্নমানের নকল-ভেজাল ওষুধের সরবরাহ বন্ধ হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দেশে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের বাজার ৩০ হাজার কোটি টাকার ওপরে। এর মধ্যে ১০-১২ শতাংশ ওষুধ মানহীন বা ভেজাল বলে বিভিন্ন মাধ্যমে জানা গেছে। গ্রামগঞ্জের ফার্মেসিতে এসব মানহীন ওষুধ অবাধে বিক্রি হচ্ছে। দাম কম হওয়ায় এগুলো বিক্রি হয়ে যাচ্ছে দেদার। স্বল্প আয়ের মানুষ এসব ওষুধ গ্রহণ করছে। কিন্তু এসব ওষুধ রোগ সারানোর বদলে উল্টো মানবদেহে নানা রোগের সূত্রপাত ঘটাচ্ছে। সস্তায় ওষুধ কিনতে গিয়ে মানুষ রীতিমতো বিষ গ্রহণ করছে। জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ এসব এপিআই অবাধে বিক্রি হলেও কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
দেশে আড়াই লাখ ওষুধ ফার্মেসি রয়েছে। প্রতি বছর এ সব ফার্মেসি পরিদর্শন করার কথা থাকলেও বাস্তবে ৫০ ভাগ ফার্মেসি থাকে পরিদর্শনের বাইরে। যারা দায়িত্বে আছেন তারা পরিদর্শন কার্যক্রম ঠিকমত না করে মাসোহারা নিয়ে থাকেন বলে প্রায় অভিযোগ রয়েছে। এ সুযোগে অসাধু ফার্মেসি মালিকরা আমদানি নিষিদ্ধ চোরাই পথে আসা ওষুধ, নিম্নমানের ওষুধ ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি করছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর নকল ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রির বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জেল-জরিমানার ব্যবস্থা নিচ্ছে। তারপরও নকল ভেজাল ও নিম্নমানের (মানহীন) ওষুধের জোগান বন্ধ করা যাচ্ছে না।
অভিযোগ রয়েছে, ওষুধ ব্যবসায়ী সমিতির ব্যানারে কতিপয় ব্যবসায়ী নেতা ও ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কতিপয় দুর্নীতিপরায়ন কর্মকর্তার যোগসাজশে অনৈতিক সিন্ডিকেট এসব দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, নকল ভেজাল ও মানহীন ওষুধ উৎপাদনের মূলে রয়েছে খোলাবাজারে বিক্রি হওয়া ওষুধের কাঁচামাল। ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদন পাওয়া কোম্পানিই কেবল বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করতে পারে। এসব কাঁচামাল খোলাবাজারে বিক্রির সুযোগ নেই। কিন্তু অনেক ওষুধ কোম্পানি চাহিদার তুলনায় অধিক পরিমাণে কাঁচামাল আমাদানি করে। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং অসাধু ওষুধ ব্যবসায়ী এ সব অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমদানিকৃত ওষুধের কাঁচামাল খোলা বাজারে বিক্রির সুযোগ নেই। এ কাজ যারা করছেন তারা মারাত্মক অপরাধ করছেন। মিথ্যা ঘোষণায় আমদানিকৃত কাঁচামাল যাতে দেশে না ঢুকতে পারে, সেজন্য বন্দর কর্তৃপক্ষকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরই খালাস করার অনুমোদন দেওয়া উচিত। যারা এসব ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছে, তাদের গ্রেপ্তার করে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, যাতে অন্যরা তাদের দেখে শিক্ষা লাভ করে।
তারা বলেন, ওষুধ তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত এপিআই খুবই স্পর্শকাতর পণ্য। এসব এপিআই খোলা বাজারে বিক্রি হলে এর বিশুদ্ধতা নষ্ট হতে পারে। এতে অপদ্রব্য মিশ্রিত হতে পারে, অনেক সময় কেমিক্যাল রিঅ্যাকশনও হতে পারে। এতে এপিআইয়ের গুণাগুণ নষ্ট হতে পারে। আবার অসাধু ব্যবসায়ীরা এতে নানা ধরনের অপদ্রব্য মেশাতে পারে, যা সহজে বোঝার উপায় থাকে না। কারণ এপিআই ও অপদ্রব্য দেখতে প্রায়ই একই রকম। অনেক কোম্পানি বেশি পরিমাণে এপিআই আমদানি করে খোলা বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। সেখান থেকে আবার ছোট কোম্পানিগুলো কিনে ওষুধ তৈরি করছে। এসব এপিআই থেকে তৈরি করা ওষুধে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে বলে জানান।
ওষুধের কাঁচামাল বা এপিআই আমদানির আগে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে ব্লক লিস্ট অনুমোদন করাতে হয়। অর্থাৎ তাদের বার্ষিক বা অর্ধবার্ষিক চাহিদা কত, তা আগে অনুমোদন করাতে হয়। সেখান থেকে অনুমোদন পাওয়ার পরই কোম্পানিগুলো এপিআই আমদানির ঋণপত্র খুলতে পারে। কিন্তু ব্লক লিস্টে অনুমোদিত এপিআই আমদানির পর কোম্পানিগুলো নিজেরা কতটুকু ব্যবহার করছে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই ঔষধ প্রশাসনের কাছে। কর্তৃপক্ষ তদারকি না করার সুযোগে অনেক কোম্পানি এসব এপিআই খোলা বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। খোলাবাজারে এপিআই বিক্রির বিষয়টি প্রকাশ্যে ঘটলেও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে দোষী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। এর আগে অধিদপ্তর নকল, ভেজাল, অনিবন্ধিত, মেয়াদোত্তীর্ণ ও আমদানি নিষিদ্ধ ওষুধ বিক্রির দায়ে অভিযান চালালেও অবৈধ উপায়ে এপিআই ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
বাংলাদেশে এইসব ভেজাল এবং নিম্নমানের ওষুধ কিন্তু তৈরি করে লাইসেন্স প্রাপ্ত ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোই৷ তারা বৈধতার আড়ালে অবৈধ কাজ করে৷ এর বাইরে লাইসেন্স না দিয়ে পুরোপুরি অবৈধভাবে গোপন কারখানায় বিভিন্ন নামি ওষুধ কোম্পনির নকল ওষুধ তৈরি করেও বাজারে ছাড়ার ঘটনা ঘটছে৷ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে প্রায়ই এ ধরনের নকল ওষুধের কারখানার সন্ধান পাওয়া যায়৷
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, “মানহীন বা নিম্নমানের ওষুধ রোগ না সারিয়ে উল্টো বাড়িয়ে দেয়৷ নতুন রোগ শরীরে বাসা বাঁধে৷ এছাড়া বাংলাদেশের ৫০ ভাগ ওষুধ কোম্পানি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুসরণ করছে না৷ এরজন্যও ওষুধ প্রশাসন দায় এড়াতে পারে না”।
তারা বলেন, “অনেক রোগী আছে যাদের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক রেসিটেন্স ক্ষমতা তৈরি হয়েছে, কোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকই তাদের শরীরের জীবাণু মারতে পারছে না৷ মানহীন অথবা নিম্নমানের অ্যান্টিবায়োটিকের কারণে এই অবস্থা তৈরি হয়েছে৷ এদের মৃত্যু অবধারিত৷ শুধু তাই নয়, এদের মাধ্যমে জীবাণুও ছড়িয়ে পড়ছে৷”
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি রয়েছে। অপরদিকে অধিদপ্তরের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন সময়ে নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে সদিচ্ছার ঘাটতিও লক্ষ্য করা যায়। এসকল সমস্যা ও সীমাবদ্ধতার কারণে ওষুধের বাজার তদারকি ও পরিবীক্ষণে অনিয়ম ও দুর্নীতি সংঘটিত হচ্ছে। ওষুধ প্রশাসনের অধিদপ্তরসহ যে সকল ওষুধ কোম্পানি নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ প্রস্তুত করে তাদেরকে চিহ্নিত করে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬১০
আপনার মতামত জানানঃ