মীর মোনাজ হক : বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আল জাজিরায় প্রকাশিত ‘প্রধান মন্ত্রীর লোক’ নামে প্রতিবেদনটি নিয়ে বেশ উত্তেজিত হয়েছেন। সংবাদে প্রকাশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, “আল জাজিরার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” আল-জাজিরার দেওয়া প্রতিবেদনের তথ্যগুলো আমি আবারও দেখলাম, তারা যথেষ্ট প্রমান দিয়ে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান এর ৪ ভাইয়ের ‘মাফিয়া’ যোগসাজশের মতো অকাট্য প্রমান তুলে ধরেছে। বাংলাদেশ সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ যে অনুসন্ধান করতে পারেনি, বা করেনি, তা আল-জাজিরা করেছে।
আল জাজিরার প্রতিবেদনকে ফেক বলার কোন সুযোগ নেই। বেশিরভাগ লোক সেনাপ্রধানের ভাইদের অবৈধ ব্যবসা ও প্রভাব খাটাবার কথা বিশ্বাস করছে এবং সরকারের খুব বেশিরকম নেতিবাচক সমালোচনা হচ্ছে।

এই প্রতিবেদনের বেশিরভাগ তথ্যপ্রমাণ ‘ফেক’ বলে মনে হয়নি। যেমন প্রতিবেদনের একযায়গায় ‘মোহাম্মদ হাসান’ নামের হারিস আহমেদ মারাত্মকভাবে হাসলেন এবং তাঁর সিগারেটে একটি গভীর টান দিয়ে বললেন,’তার আসীম ক্ষমতার কথা’। তাঁর হাতে, সোনার আংটি এবং ব্রেসলেট দিয়ে বোঝায়, তিনি কীভাবে ক্ষমতাসীনদের সাথে পুরানো স্কোরটি স্থির করেছেন তা বর্ণনা করেছিলেন, শান্ত বুদাপেস্ট এর ব্যাক স্ট্রিটে অর্থ বিনিয়োগ করে যে ‘বে অফ বেঙ্গল’ প্রতিষ্ঠান ও রেস্তোরাঁর মালিক হয়েছেন সেখানে ধোঁয়াশা মেঘ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কক্ষের ছাদ দেখলেই মনে হয় যে তিনি আর্থিক বৈভবশালী আবেগ বা দাম্ভিকতা প্রকাশ করেছেন। এটি কেবল ব্যবসা বলে মনে হলেও, এটি একটি ‘মাফিয়া’ সিনেমার দৃশ্যের মতো ছিল এবং তাতে সহযোগীতা করছেন তার ভাই সেনা প্রধান আজিজ আহমেদ।
অন্যান্য রেকর্ডিংয়ে দেখা যাচ্ছে, হারিস ঘুষ আহরণের জন্য সেনাবাহিনী প্রধান, তার ভাইয়ের শক্তি ব্যবহার করে সামরিক যন্ত্রাংশ ক্রয়ের চুক্তি থেকে ঘুষ নিয়ে গর্বিত। তিনি দাবি করেছেন যে তিনি যে রাজনীতিবিদকে সুরক্ষা দিতেন তার সমর্থন রয়েছে। তিনি বলেছিলেন: “এমনকি প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) বলেছেন- হারিস যদি কিছু করতে চায় তবে তাকে তা করতে দিন। আমরা সাহায্য করব।”
আল জাজিরা দ্বিতীয় পলাতক আহমদ ভাই আনিসকেও সন্ধান করতে সক্ষম হয়। আল-জাজিরার একটি নজরদারি দল জেনারেল আজিজকে কুয়ালালামপুরে অনুসরণ করেছিল, সেখানে তাকে এবং আনিসকে বাংলাদেশ হাইকমিশনে একটি কূটনৈতিক এসকর্ট দেওয়া হয়েছিল। পরে আনিস যে বাড়িতে অবস্থান করছিল তার সম্পত্তির রেকর্ডে আনিস আহমেদ এবং মোহাম্মদ হাসান, হারিস আহমেদের নকল পরিচয়ের দুটি দলিল দেখানো হয়েছিল।
হারিস আহমেদের নকল পাসপোর্ট, যা মোহাম্মদ হাসান নামটি ব্যবহার করে। প্রধানমন্ত্রীর সুরক্ষায় আহমেদ পরিবারের ভাগ্য দীর্ঘকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে জড়িত ছিল। “হারিস ও আনিস হলেন হাসিনার দেহরক্ষী” এই বক্তব্যের অকাট্য প্রমান পাওয়া যায়নি, এক পুরোনো ছবি ছাড়া।
সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ এর তিন ভাই বাংলাদেশে খুন, হত্যা ও মানিলন্ডারিংয়ের সাথে যুক্ত, আর তার প্রশ্রয় দিচ্ছেন সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ ব্যক্তি জেনারেল আজিজ আহমেদ।
ইসরায়েলি সংস্থা থেকে বাংলাদেশ গুপ্তচরবৃত্তির সরঞ্জাম কিনেছিল, তার অকাট্য প্রমান আল-জাজিরা দিতে না পারলেও অবৈধভাবে ডকুমেন্ট জালিয়াতি করে নিজের ভাইকে বাংলাদেশের পাসপোর্ট করিয়ে দেওয়া, এছাড়াও সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুর, প্যারিস, বুদাপেস্ট কানেকশন সবকিছুই ‘মাফিয়া’ কানেকশন বলেই প্রমান করতে পেরেছে আল-জাজিরা।
‘প্রধানমন্ত্রীর সকল লোক’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন যে হারিস ও আনিস আহমেদ, দুজনেই হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়া তাদের ভাই, উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা, আইন প্রয়োগ থেকে বাঁচতে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার পরে কীভাবে তাদের সুরক্ষা পাচ্ছেন। জাল পাসপোর্ট কিভাবে ভুয়া দলিল দিয়ে করা হয়েছে, এগুলোর প্রমান দেখিয়েছে আল-জাজিরা।
তাদের ভাই হলেন জেনারেল আজিজ আহমেদ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ বিশ্বাসী।
দেশের আইনের শাসন ও নৈতিকতার ওপর মনে হয় এত বড় আঘাত এর আগে কখনো আসেনি। একজন সেনাপ্রধান নিয়োগে এতটাই এবং এতটাই ব্যাপরোয়া মনোভাব দেখানোর ভয়ানক পরিণতি! দেশটার ন্যুনতম নৈতিক ভিত্তি ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে।
দ্রুত নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করে আইনের শাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভাবমুর্তি রক্ষার উদ্যোগ নেয়া উচিৎ। বিচার ভিাগকেও রিফাইন করা অতিব জরুরী।
এদিকে, গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীসংঘের উদ্বেগ এর কথা প্রকাশ পায়। কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল-জাজিরার এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে অভিযোগ আনা হয়েছে তার তদন্ত হওয়া উচিত বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেসের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজাররিক। বৃহস্পতিবার নিয়মিত এক সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ আহবান জানান। এতে তাকে আল-জাজিরার তোলা অভিযোগ এবং জাতিসংঘের শান্তি মিশনের জন্য ইসরাইল থেকে বাংলাদেশের নজরদারি প্রযুক্তি ক্রয়ের বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। এর উত্তরে ডুজাররিক বলেন, আল-জাজিরার অনুসন্ধানে বাংলাদেশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগ এবং এ নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি সম্পর্কে আমরা অবহিত আছি। দুর্নীতির অভিযোগ একটি গুরুতর বিষয়। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদন্ত করা উচিত।
বাংলাদেশের সেনাপ্রধান এর উপর করা এমন একটি ডকুমেন্টারির সত্যতা যাচাইয়ের প্রশ্ন করলে, জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেসের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজাররিক এরপর আরো যুক্ত করেন যে, জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশের সবথেকে বেশি ইউনিফর্মড সদস্য রয়েছে। প্রতিটি শান্তি মিশনে তাদের মোতায়েনে জাতিসংঘের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনাগুলো বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে। আল-জাজিরার ডকুমেন্টরিতে যে ধরনের ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রের কথা উঠে এসেছে সে ধরনের কোনো যন্ত্র ব্যবহারের কথা জাতিসংঘের চুক্তিতে নেই। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের কোনো কন্টিনজেন্টে এরকম যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে না। তিনি আরো বলেন, একটি শান্তিরক্ষা মিশনের অপারেশনে জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা রক্ষার খাতিরে ইন্টালিজেন্স পিসকিপিং পলিসি অনুযায়ী কিছু নির্দিষ্ট ধরনের আড়ি পাতার যন্ত্রপাতির ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এটি কঠোরভাবে জাতিসংঘের ইন্টালিজেন্স পিসকিপিং পলিসি মেনে এবং ফোর্স কমান্ডারের অধীনে পরিচালিত হয়েছে।
আল জাজিরার এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম কি বলছে:
DW বলছে : “আল জাজিরা তদন্তে হারিসের রেকর্ডিং রয়েছে যা ইঙ্গিত করে যে আহমেদ ভাইয়েরা বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীতে কয়েকশো হাজার ডলারে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় চাকরি বিক্রি করে দিচ্ছেন।”
এই রেকর্ডিং “স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, মহাপরিদর্শক এবং পুলিশ কমিশনার’কে ঘুষে প্রদানের সমন্বয় করতে সহায়তা করার জন্যও জড়িত।”
BBC বাংলা বলছে : “আল জাজিরার এই অনুসন্ধানে মূলত সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের পরিবারের সদস্যদের অতীত এবং বর্তমান বিভিন্ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরা হয় এবং নানা ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ করা হয়।”
VOA ভয়েস অফ আমেরিকা এক টুইট বার্তায় বলছে : আল জাজিরার প্রতিবেদন সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদন্ত করা উচিত- স্টিফেন ডুজারিক।
Art19 বলছে : ‘প্রধানমন্ত্রীর সমস্ত লোকই’ এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ঘটছে এমন একটি উচ্চ-স্তরের কভারআপের আকর্ষক, সত্য-অপরাধের গল্প। ইনভেস্টিগেটর রেকর্ডিং, স্বীকারোক্তিমূলক সাক্ষাত্কার, ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ এবং প্রাথমিক উৎস নথির মাধ্যমে আল জাজিরা তদন্তে আহামেদ ভাইদের একটি অপরাধী দল এবং দেশটির নেতার মধ্যে দুর্নীতিগ্রস্থ এবং চলমান সম্পর্কের কথা প্রকাশ করে। এটি এমন একটি সম্পর্ক যা ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে আসছে”
আল-জাজিরার পার্ট ওয়ান শুরু হয়েছে রাজধানী ঢাকার রাস্তায় এক খুনের মধ্য দিয়ে। আর এটা ছিলো পার্ট থ্রি। আল-জাজিরার আরো কয়েকটি এপিসোড নিয়ে আবার আসবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।
০৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২০, বার্লিন
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, প্রকৌশলী ও সাংবাদিক। বার্লিন, জার্মানী।
মতামত ও বিশ্লেষন বিভাগে প্রকাশিত সকল মতামত লেখকের নিজস্ব এবং এটি State Watch এর সম্পাদকীয় নীতির আদর্শগত অবস্থান ধরে নেওয়া ঠিক হবে না।
আপনার মতামত জানানঃ