ফুরিয়ে আসছে দেশের গ্যাস সম্পদ। এজন্য ২০১৩ সাল থেকে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী সারাদেশে নতুন গ্যাস সংযোগ দেয়া বন্ধ। সরকারিভাবে দেশে গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকলেও একটি সিন্ডিকেট ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শহরের বিভিন্ন বহুতল ভবনসহ প্রত্যন্ত এলাকায় অবৈধ সংযোগ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে অবাধে। প্রতিদিনই নতুন নতুন গ্যাস সংযোগ দেয়া হচ্ছে এখানে। অবাধে চলছে অবৈধ গ্যাস সংযোগের মহোৎসব। অভিযোগ রয়েছে- বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশনের স্থানীয় কার্যালয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে বছরের পর বছর এ অবৈধ গ্যাস সংযোগের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে চক্রটি।
বর্তমানে সঙ্কটের কারণে বৈধ গ্রাহকরাই নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস পাচ্ছেন না। শিল্পসহ বাসাবাড়িতেও গ্যাসের জন্য দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। কিন্তু ক্রমাগত বেড়েই চলেছে অবৈধ গ্যাসের ব্যবহার। সংশ্লিষ্ট অসাধু ব্যক্তিদের ম্যানেজ করে একটি সিন্ডিকেট অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ দিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। এতে একদিকে যেমন সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব তেমনি প্রাণহানীর মত বড় ধরনের দুঘর্টনার আশংকাও রয়েছে।
জানা যায়, জেলার সদরসহ বিভিন্ন স্থানে এই চক্রটি হাজার হাজার অবৈধ গ্যাস সংযোগ দিচ্ছে। সদর উপজেলার সুহিলপর, ঘাটুরা, সুতিয়ারা, নন্দনপুর, নাটাই, বিহাইরসহ বিভিন্ন গ্রামের বাসাবাড়িতে চক্রটি অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেয়ার মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে এসব অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেও কোনোভাবেই যেন এ সিন্ডিকেটকে প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। মাইলের পর মাইল অবৈধ সংযোগ দিয়ে যাচ্ছে তারা।
মূলত গ্যাস সংকটের কারণে শিল্প কারখানায় এবং বাসাবাড়িতে গ্যাসের সংযোগ দেয়া বন্ধ রাখে সরকার। এরপর চাহিদা বেড়েছে অনেকগুণ। বলা হচ্ছে ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশনের স্থানীয় কার্যালয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে অবৈধ সংযোগ দিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। সংযোগ দিতে গিয়ে কোন নিয়মকানুনের বালাই ছিল না, মানা হয়নি কোন নিরাপত্তা ঝুঁকির দিকও। কোথাও বা গাছের ওপর দিয়েও গ্যাসের পাইপ টানা হয়েছে। আর গ্রাহকরাও দ্রুত লাইন পেতে অসাধু ওই চক্রের ফাঁদে পা দিচ্ছেন। কারণ, সাধারণ গ্রাহকদের বৈধভাবে গ্যাস সংযোগ পেতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পিছনে বছরের পর বছর ঘুরতে হয়। এদিকে চাহিদামতো টাকা দিলেই অবৈধ সংযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, নিয়ম অনুযায়ী একটি বৈধ সংযোগের জন্য যেখানে ৮-১০ হাজার টাকা দিতে হয় সেখানে প্রতিটি সংযোগের জন্য ৬০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত আমাদের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা সংযোগ দিলেও বই না থাকায় ম্যাজিট্রেস্ট এসে অভিযান চালিয়ে সংযোগ বিছিন্ন করে দিয়ে গেছে। এখন তাদের কাছে টাকা চাইলে উল্টো ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। এছাড়া অনেকে জমিজমা বিক্রি করে এমনকি ধার-দেনা করে সিন্ডিকেটকে স্ট্যাম্পে চুক্তির মাধ্যমে টাকা দেয়ার পর সংযোগ পেলেও তা আবার বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। আমরা এ ঘটনার বিচারের দাবি জানাচ্ছি।
গ্যাস সমৃদ্ধ জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া দেশের জ্বালানি চাহিদার বেশিরভাগই পূরণ করে যাচ্ছে। অবৈধ গ্যাস সিন্ডিকেট চক্র সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে প্রতিনিয়তই গ্যাস সংযোগ দিয়ে যাচ্ছে। চোরাইভাবে গ্যাস ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ায় গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় হাজার হাজার বৈধ গ্রাহক পড়েছেন চরম দুর্ভোগে।
প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে চোরাই গ্যাসের এ নেটওয়ার্ক। এই অবৈধ লাইন থেকে হাজার হাজার বাড়িঘরসহ বিভিন্ন বহুতল ভবনে গ্যাস সংযোগ দেয়া হচ্ছে। ফলে ভোগান্তিতে পড়েছে বৈধ সংযোগ নেয়া গ্রাহকরাও। আবার এসব সংযোগ দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে এই সিন্ডিকেট।
বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন অফিস জানায়, তাদের ২৪ হাজার বৈধ গ্রাহক রয়েছে। অবৈধ গ্রাহক কি পরিমাণ আছে তার কোনো সঠিক তথ্য নেই তাদের কাছে।
গ্যাস সিন্ডিকেট চক্রটি বৈধ গ্রাহকদের সার্ভিস লাইনের সঙ্গে সংযোগ যুক্ত করে বিভিন্ন এলাকায় পাইপ বসিয়ে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ দিয়ে যাচ্ছে। এতে পৌর শহরের কাজীপাড়া, পুনিয়াউট, দাতিয়ারা, কলেজ পাড়া, বনিক পাড়া, কাউতলী, পাইকপাড়া, মেড্ডা, মধ্যপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা-৩টা পর্যন্ত গ্যাস থাকে না। এতে বৈধ গ্রাহকদের দুর্ভোগের যেন শেষ নেই।
এ বিষয়ে বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশনের সদ্যবিদায়ী ডিজিএম জাহিদুর রেজা গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় অচিরেই অভিযান পরিচালনা করবো এবং বিভিন্ন এলাকা চিহ্নিত করছি। এ সমস্ত অবৈধ সংযোগের কারণে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে তিনি জানান।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপক শফিকুল ইসলাম বলেন, অবৈধ সংযোগের ব্যাপারে অভিযান অব্যাহত আছে। চক্রটির বিরুদ্ধে অনেক গ্রাহক মুখে বললেও লিখিত অভিযোগ কেউ করেনি। কর্মচারীদের মধ্যে যদি কেউ অবৈধ গ্যাস সংযোগের সঙ্গে জড়িত থাকে এবং এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পুরো এলাকাজুড়ে টাইমবোমার মতো ছড়িয়ে আছে গ্যাস লাইনগুলো। গ্যাস কর্তৃপক্ষের চরিত্র হচ্ছে একবার যদি লাইন দেয় তারপরে সব চলে যায় লাইনম্যানের কর্তৃত্বে। অবৈধ সংযোগ উচ্ছেদে লোক দেখানো অভিযান চলে কিন্তু আড়ালে থেকে যায় অসাধু কর্মকর্তা ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা। যে কারণে কদিন পর একই এলাকায় আবারও চালু হয় অবৈধ সংযোগ। সরকার হারায় কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। তারা বলেন, গ্যাসের অবৈধ সংযোগের লাইন নিয়ন্ত্রণে হয় বিচ্ছিন্নকরণ প্রক্রিয়ায় যেতে হবে অথবা অবৈধ বা বৈধ লাইনগুলোকে মাসিক বিলিং সিস্টেমের আওতায় আনতে হবে। এ ছাড়া অবৈধ গ্যাস সংযোগের ফলে সৃষ্ট দুর্ঘটনা রোধে সরকার ও দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাকে শিগগিরই একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করতে হবে।
এসডব্লিউ/জেএন/কেএইচ/১৮৩২
আপনার মতামত জানানঃ