২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু করে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটক বাংলাদেশ। শুরুতে এর সিম পেতে মারামারির ঘটনাও ঘটে। পরের ইতিহাস খুবই করুণ। যাত্রার ১৬ বছরেও ব্যবসায়িক দিক থেকে লাভজনক হয়ে উঠতে পারেনি টেলিটক। মাঝের দুই বছর বাদে এ দীর্ঘ সময়ের পুরোটাই লোকসানের বৃত্তে আটকে থেকেছে প্রতিষ্ঠানটি।
গ্রাহক বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ, সেবার মান বৃদ্ধিসহ নানা ক্ষেত্রে খুব একটা সাফল্য দেখাতে পারেনি টেলিটক। এখনো টেলিটকের ব্যবসার মূল ভিত্তি রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা। আবার গ্রাহকদের উন্নতমানের পণ্য ও টেলিকম সেবা দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে কার্যক্রম শুরু করা এ প্রতিষ্ঠানের সেবার মান নিয়ে গ্রাহকদেরও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ।
অথচ সরকারি নানা সুবিধা নিয়ে দেশের অন্যতম সেরা সেলফোন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেদের প্রমাণের সুযোগ টেলিটকের ছিল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ২০০৪ সালে যাত্রা করা দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত অপারেটরটির সংযোগ অর্ধকোটিও ছাড়ায়নি। ৩১ডিসেম্বর, ২০২০ শেষে টেলিটকের সংযোগসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৯ লাখ ২৭ হাজার।
রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটকের সেবা নিয়ে গ্রাহকদের অভিযোগের অন্ত নেই। সংস্থাটির সেবার মান যে সন্তোষজনক নয়, তা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে।
এতে বলা হয়েছে, টেলিটকের নেওয়া প্রকল্পগুলো থেকে সুফল মিলছে না। থ্রি-জি প্রযুক্তি চালুকরণ ও ২.৫ জি নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ নামের একটি প্রকল্প সরেজমিন পরিদর্শন শেষে আইএমইডি যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, টেলিটকের ইন্টারনেট সুবিধা ভালো নয়। নেটওয়ার্ক মাঝেমধ্যে খুব খারাপ থাকে।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টেলিটকের ইন্টারনেট প্যাকেজ সুবিধা কম। সব জায়গায় থ্রি-জি নেটওয়ার্ক সার্ভিস নেই। শহরের মধ্যে যা কিছুটা নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়, শহরের বাইরে কাভারেজ পাওয়া যায় না। টেলিটকের সেবার মান সন্তোষজনক নয়। এই প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্ক কাভারেজ অন্য অপারেটরদের চেয়ে অনেক কম। তা ছাড়া প্রয়োজনের তুলনায় টাওয়ার বিটিএসের সংখ্যা কম হওয়ায় গ্রাম পর্যায়ে নেটওয়ার্কের খুব সমস্যা থাকে।
গত ৭ ডিসেম্বর, ২০২০ ফেইসবুকে টেলিটেকর ভেরিফায়েড পেইজে লাইভে এসে বেশ কয়েকটি বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস জানিয়েছিলেন অপারেটরটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাহাব উদ্দিন।
জনাব সাহাব উদ্দিন বলেন, “যেখানে অন্যান্য অপারেটররা যায়নি সেখানে টেলিটকের নেটওয়ার্ক রয়েছে, পার্বত্য এলাকাসহ সুন্দরবনে নেটওয়ার্কের আওতায় আছে। এছাড়া খুব শিগগিরই হাওড় এলাকায় নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসার কাজ চলছে। আশা করি, হাওড় এলাকায় নেটওয়ার্ক এ মাসেই চালু করা হবে। সরকারের উদ্দেশ্য দেশের প্রতিটি ইঞ্চিতে যেন টেলিটকের কানেকটিভিটি থাকে।”
কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, পার্বত্য এলাকা, নোয়াখালী ও কয়েকটি ছিটমহলে এ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে কাজ করছে টেলিটক।
এ প্রকল্পে প্রায় ৩৮০ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে এবং এসব সাইটে উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করা হবে ফোর-জি প্রযুক্তির মাধ্যমে। জনাব সাহাব উদ্দিন বলেন, “টেলিটকের গ্রাহকের ব্যবহারের টাকায় এ প্রতিষ্ঠান বেঁচে আছে। টেলিটকের বিনিয়োগ মাত্র সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা, সাড়ে ৫ হাজার বিটিএসের মধ্যে তিন হাজার ৩০০ বিটিএস দিয়ে ফোর-জি সেবা দেওয়া হচ্ছে। টুজি আমাদের গ্রাম পর্যায়ে রয়েছে। গ্রাম পর্যন্ত আমরা ফোরজিতে চলে যেতে চাই।”
ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের তথ্য মতে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ১৬ বছরে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত সেলফোন অপারেটর টেলিটক এ যাবৎ লোকসান করেছে ১ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা। গত চার বছরেই টেলিটক লোকসান করেছে ৯৯৩ কোটি টাকা।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত সময়ে টেলিটকের আয়-ব্যয়ের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শুরুর পর থেকে শুধু দুই অর্থবছরেই লাভের মুখ দেখেছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১০-১১ অর্থবছরে ১১ কোটি ও ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৪৬ কোটি টাকা মুনাফা করে টেলিটক। এর বাইরে ২০০৫-০৬ অর্থবছর ৫৬ কোটি টাকা, ২০০৬-০৭ অর্থবছর ৬১ কোটি, ২০০৭-০৮ অর্থবছর ১৬২ কোটি, ২০০৮-০৯ অর্থবছর ১১০ কোটি, ২০০৯-১০ অর্থবছর ২৯ কোটি, ২০১১-১২ অর্থবছর ১৭ কোটি, ২০১৩-১৪ অর্থবছর ২০ কোটি, ২০১৪-১৫ অর্থবছর ২০২ কোটি, ২০১৫-১৬ অর্থবছর ৪১ কোটি, ২০১৬-১৭ অর্থবছর লোকসান ২৫৭ কোটি, ২০১৭-১৮ অর্থবছর ২৭৭ কোটি, ২০১৮-১৯ অর্থবছর ১৯০ কোটি ও ২০১৯-২০ অর্থবছর টেলিটক ২৬৯ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে।
লোকসানের বাইরে সরকারের বড় অংকের পাওনাও রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির কাছে। টেলিটকের কাছে থ্রিজি তরঙ্গ বরাদ্দ বাবদ সরকারের পাওনা ১ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা। বকেয়া আদায়ে একাধিকবার তাগাদা দিলেও তা আদায় করতে পারেনি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। পরে থ্রিজি তরঙ্গ বরাদ্দের ফি বাবদ বকেয়া অর্থ ইকুইটিতে রূপান্তরের প্রস্তাব দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। তবে সে প্রস্তাবে এখনো সাড়া দেয়নি অর্থ মন্ত্রণালয়।
ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বণিক বার্তাকে বলেন, শুরুতে অনেকটা অপরিকল্পিতভাবে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা হয়েছে। সে অবস্থা থেকে টেলিটককে বের করে আনার জন্য এরই মধ্যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো বিনিয়োগের সুযোগ না থাকায় নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করতে পারেনি টেলিটক। এতে পিছিয়ে পড়তে হয়েছে তাদের। তবে যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন হলে শিগগিরই প্রতিষ্ঠানটি ঘুরে দাঁড়াবে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন ‘আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি টেলিটক লোকসানে যাবে, যাচ্ছেও। যে পরিমাণ বিনিয়োগ করা হয়েছে তা পুরোপুরি নষ্ট হয়েছে। এটার কোনো দরকারই নেই। সরকারের উচিত প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করে দেয়া। সরকারের সঙ্গে কোনো কোম্পানি জয়েন্ট ভেঞ্চারে থেকেও প্রতিষ্ঠানটি চালাতে পারে। নিম্ন আয়ের দেশ ছাড়া বিশ্বের কোনো দেশে এমন লোকসানি টেলিকম প্রতিষ্ঠান নেই। সরকারি চাকরি ও পাবলিক পরীক্ষাসংক্রান্ত বিভিন্ন সেবার ক্ষেত্রে অনেকেই বাধ্য হয়ে প্রতিষ্ঠানটির সেবা নিচ্ছে। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে এভাবে টেলিকম প্রতিষ্ঠান টেকসই হয় না।’
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জেলা শহরগুলোতে টেলিটকের নেটওয়ার্ক পাওয়া গেলেও গ্রামাঞ্চলে এর কোনো নেটওয়ার্ক নেই। গ্রামের সব মানুষই অন্য কোম্পানির সিম ব্যবহার করেন। টেলিটকের নেটওয়ার্ক শক্তিশালী হলে এর ব্যবহার বাড়বে। ফলে এতে ভর্তুকি না দিয়ে বরং সরকার বড় অঙ্কের রাজস্ব পাবে।
এসডব্লিউ/ এফএ/০১২০
আপনার মতামত জানানঃ