কবির হোসেন : করোনা মহামারি সামাল দিতে গোটা বিশ্বেই চলছে তোড়জোড়। সাম্প্রতিক সময়ে করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে একেকটি দেশ। এর সাথে রয়েছে ভ্যাকসিন নিয়ে রাজনীতি। এসবের বাইরেও বিশ্ব অর্থনীতি সামাল দিতে তৎপর বিশ্ব। এই দৌড়ে অনেকটাই এগিয়ে আছে চীন। তবে চীনের সাম্প্রতিক সময়ের ক্রমশ অর্থনৈতিক উন্নয়নে চোখ পুড়ছে আমেরিকাসহ এর মিত্র দেশগুলোতেও। ট্রাম্প প্রশাসন চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন দমিয়ে রাখতে চীনের বিরুদ্ধে যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাইডেন আসাতে সেসব অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক কূটনীতিবিদরা। করোনা, অর্থনীতি এসব নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে পূর্ব থেকেই আমেরিকাসহ তার মিত্রদেশগুলোতে রয়েছে চাপা ক্ষোভ। তারই অংশ হিসাবে বিশ্ব রাজনীতিতে চলছে টালমাটাল। বৈশ্বিক মহামারি সামাল দেওয়ার পাশাপাশি চীন আর যুক্তরাজ্যের মধ্যে দেখা দিয়েছে পুরনো দ্বন্দ্বের বিস্ফোরণ। হংকংয়ে বেইজিংয়ের দমনপীড়নের অভিযোগ তুলে প্রতিবাদে যুক্তরাজ্য যখন তাদের সাবেক কলোনির বাসিন্দাদের জন্য নিজেদের পাসপোর্ট দেয়ার কথা জানিয়েছে, এদিকে হংকংয়ের নাগরিকদের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ ন্যাশনাল (ওভারসিজ) পাসপোর্টের স্বীকৃতি চীন বন্ধ করে দেওয়ারও ঘোষণা দিয়েছে। গতকাল শুক্রবার চীনা সরকার তাদের এই প্রতিক্রিয়া জানায়। আল জাজিরা এ খবর দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চীনে করোনার উৎপত্তি হয়েছে আর যুক্তরাজ্যে শনাক্ত হয়েছে করোনার চেয়েও শক্তিশালী নতুন স্ট্রেইন। চীন করোনা সামালে সফলতার দিকে এগিয়ে গেলেও যুক্তরাজ্য এখনো নাকানিচুবানি খাচ্ছে। তারই প্রতিশোধ হিসাবে যুক্তরাজ্য চীন শাসিত হংকংবাসীদের কাজের সুযোগ করে দিতে যেচে এগিয়ে আসে। আর চীনও যুক্তরাজ্যের মুখোমুখি হয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
জানা যায়, রোববার থেকে হংকংয়ের যেসব নাগরিক বিএন (ও) পাসপোর্টধারী তারা এবং তাদের পোষ্যরা অনলাইনে ব্রিটিশ ভিসার জন্য অনলাইনে আবেদন শুরু করতে পারবেন। এর ফলে তারা ব্রিটেনে বসবাস ও কাজকর্ম করতে পারবেন। পাঁচ বছর পর তারা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে আবেদন করার যোগ্যতা অর্জন করবেন। ব্রিটেনের নতুন এই অভিবাসন প্রকল্পটি গত বছর হংকংয়ে গণতন্ত্রপন্থিদের বিরুদ্ধে চীনের জাতীয় নিরাপত্তা আইন জারি করার সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া হিসেবে এসেছে। কয়েক লাখ হংকংবাসীর জন্য যুক্তরাজ্য তার দরজা খুলে দিতে প্রস্তুত বলে ব্রিটিশ সরকার এক ঘোষণায় জানায়। চীনা বিতর্কিত নিরাপত্তা আইন ও বিধিনিষেধ আরোপের কারণে হংকংয়ের ৫০ লাখ ৪০ হাজার মানুষকে ৩১ জানুয়ারি থেকে যুক্তরাজ্যে থাকা ও কাজের সুবিধা দিতে যাচ্ছে যুক্তরাজ্য।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জনসন বলেছেন, “নতুন এই ভিসা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে হংকংয়ের বিএনও (ব্রিটিশ ন্যাশনাল ওভারসিজ) পাসপোর্টধারীদের যুক্তরাজ্যে বাস করা, কাজ করা এবং বসতি স্থাপনের সুযোগ দিতে পেরে আমি গর্বিত। হংকংয়ের অধিবাসীদের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব ও ঐতিহাসিক গভীর সম্পর্কের প্রতি সম্মান জানাতে যা করা দরকার; আমি তা-ই করছি। আমরা স্বাধীনতা, স্বায়ত্তশাসন এবং যুক্তরাজ্য-হংকংয়ের ধারণ করা মূল্যবোধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছি।”
১৯৯৭ সালে ব্রিটেন নিজেদের উপনিবেশ হংকংকে চীনের কাছে হস্তান্তরের সময় হংকংকে ৫০ বছরের জন্য কিছু মৌলিক স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন দেয়া হবে এমন শর্ত দিয়েছিল। চুক্তিতে নিজেদের প্রাক্তন উপনিবেশের প্রতি নিজেদের নৈতিক দায়িত্ব বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু শুক্রবার চীন আগের সেসব শর্ত রক্ষা করা হবে না বলে প্রকারান্তরে জানিয়ে দেয়।
চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান সাংবাদিকদের বলেন, ‘৩১ জানুয়ারি থেকে ট্রাভেল ডকুমেন্ট এবং আইডি ডকুমেন্ট হিসেবে কথিত বিএনও পাসপোর্ট (বিদেশিদের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকার এ পাসপোর্ট দিয়ে থাকে) আর স্বীকৃতি দেবে না চীন।’
ঝাও লিজিয়ান বলেন, ৩১ জানুয়ারি থেকে চীন আর তথাকথিত বিএন (ও) পাসপোর্ট মানবে না। ব্রিটেন যদি বাড়াবাড়ি করে তাহলে চীন আরো কঠিন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে।
কঠিন পদক্ষেপটা কী হবে, সেটা অবশ্য বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়নি। তবে এর মধ্য দিয়ে যে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক তিক্ত হতে যাচ্ছে, তা বোঝা যাচ্ছে। হংকংয়ের নাগরিকরা অবশ্য চীন ভ্রমণকালে হংকংয়ের পাসপোর্টই বহন করে থাকে। কেবল বিদেশ ভ্রমণে গেলে তখন বিএন (ও) পাসপোর্ট ব্যবহার করে।
কয়েকদিন আগেও যুক্তরাষ্ট্রকে স্নায়ুযুদ্ধ না বাঁধানোর জন্য হুঁশিয়ারি করে দিয়েছিল চীন। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের দাভোস সম্মেলনের ভার্চুয়াল ইভেন্টে বক্তব্য রাখার সময় চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেরকে ‘শীতল যুদ্ধ’ মানসিকতা বাদ দিতে এবং বৈশ্বিক সমৃদ্ধির স্বার্থে বিভেদ সৃষ্টি থেকে বিরত থাকতে হুঁশিয়ারি করে দেন। জিনপিং তার বক্তব্যে বলেন, নিজেদের মধ্যে ছোট জোট করলে, নতুন শীতল যুদ্ধ শুরু করলে, অন্যের মত প্রত্যাখ্যান করলে, কাউকে হুমকি দিলে বা ভয় দেখালে, ইচ্ছাকৃতভাবে অবরোধ আরোপ করলে, পণ্য সরবরাহে বাধা দিলে অথবা কাউকে বিচ্ছিন্ন করে রাখলে তা পৃথিবীকে বিভেদের দিকে ঠেলে দেবে। এমনকি সংঘাতের দিকেও ঠেলে দিতে পারে।
সুনির্দিষ্ট কারও নাম উচ্চারণ না করলেও জিনপিং এ কথা বোঝাতে চেয়েছেন, বেইজিং কোনোভাবেই ওয়াশিংটনের নির্দেশ মোতাবেক চলবে না। তার স্পষ্ট বক্তব্য ‘কোনো বৈশ্বিক সমস্যা কোনো দেশ এককভাবে সমাধান করতে পারে না। সবার প্রচেষ্টা ও সহযোগিতার মাধ্যমে তা সমাধান করতে হবে।’
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, চীনের বিরুদ্ধে আমেরিকার অবস্থান নেওয়া এবং করোনা থেকে উদ্ভব দ্বন্দ্বই যুক্তরাজ্যের হংকং বিষয়ে এগিয়ে আসার কারণ। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রসহ তার মিত্রদেশগুলোর পরোক্ষ অবস্থান আরো প্রত্যক্ষ হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করেন তারা। সম্প্রতি তাইওয়ান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র এবং হংকং ইস্যুতে যুক্তরাজ্যের নেওয়া অবস্থান থেকে প্রতীয়মান হয় যে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলো চীনকে কোণঠাসা করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। সম্প্রতি তুরস্কের সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দীর্ঘদিনকার বরফও গলতে শুরু করেছে। তুরস্ক গ্রীসের মধ্যকার সুসম্পর্ক ফিরে আসার ইঙ্গিত হিসাবে বড় কোনো দুর্ঘটনারই ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন। এমনিতেই করোনা চীনের তৈরি ভাইরাস বলে যুক্তরাষ্ট্রের এমন অভিযোগে কাঠগড়ায় বেইজিং। এর মধ্যে হংকং নিয়ে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়ন কোন দিকে মোড় নেয় সেটি এখন দেখার বিষয়। এই চলমান সমস্যা নিয়ে দ্রুত সমাধানে না আসলে সঙ্কট আরও বাড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এসডব্লিউ/১৫০৫
আপনার মতামত জানানঃ