একটি থেমে থাকা ঘড়ির মতোই যেন রাজনীতির সময় থমকে গিয়েছিল। কিন্তু সেই স্থবিরতার বরফ ভাঙল এক মৃদু কাঁপুনিতে—যার প্রতিধ্বনি উঠল লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলে। গত বছরের জুলাইয়ে ‘জুলাই বিপ্লব’-এর মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকার বিদায় নেওয়ার পর দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার নেতৃত্বে আছেন নোবেলজয়ী ড. ইউনূস। তখন থেকেই দোলাচলে ছিল গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ—নির্বাচন হবে কবে, আর বিচার ও সাংবিধানিক সংস্কার আদৌ হবে কি না। এমন পটভূমিতে ১৩ জুন তারেক রহমান ও ড. ইউনূসের লন্ডন বৈঠক ঘিরে চাঞ্চল্য তৈরি হয়।
তারেক রহমান দাবি জানান ২০২৫ সালের মার্চের আগেই নির্বাচনের, আর ড. ইউনূস সম্মতি দেন, রমজানের আগে প্রস্তুতি থাকলে তা সম্ভব। বৈঠকটি শুধু সময় নির্ধারণের আলোচনায় সীমাবদ্ধ ছিল না—বিচারপতি নিয়োগ, সংবিধান পরিষদ গঠন ও July Charter বাস্তবায়নসহ আরও কিছু সংস্কার ইস্যুতেও কথাবার্তা হয়েছে। নাগরিক ঐক্য সংগঠনও এগিয়ে এসেছে নির্বাচনী রোডম্যাপ প্রস্তাব নিয়ে, যা অর্ডিন্যান্স থেকে শুরু করে ভোটার তালিকা এবং নির্বাচন ঘোষণার সময় নির্ধারণ পর্যন্ত স্পষ্ট ধারণা দেয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের ভূমিকা ছিল রাজনীতির ভাঙা অংশগুলোকে এক টেবিলে বসিয়ে জাতীয় ঐক্যের রোডম্যাপ তৈরি করা। কিন্তু এনসিপির মতো রাজনৈতিক দলগুলোর দূরত্ব তাদের অবস্থান থেকে স্পষ্ট। এনসিপি এই বৈঠককে স্বাগত না জানিয়ে একে ‘ষড়যন্ত্রপ্রবণ’ এবং ‘গণতন্ত্রের ঈদের খোঁজা নয়’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। তাদের মতে, এই বৈঠক একদলীয় রাজনীতির সুবিধার জন্য আয়োজন, যা জাতীয় স্বার্থের প্রতি বিশ্বাস তৈরি করতে ব্যর্থ। এনসিপির এমন কঠোর অবস্থান অন্তর্বর্তী সরকারের সমর্থক ড. ইউনূসের কাছেও স্পষ্ট বিরোধের প্রমাণ। এনসিপি নেতাদের বক্তব্য, ড. ইউনূসের এই ভূমিকা একদিকে ক্ষমতা-সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনার চেষ্টা হলেও, অন্যদিকে দেশের গভীর সামাজিক-রাজনৈতিক বিভাজনের জটিলতাগুলো অজানা থেকে যায়। তারা মনে করে, শুধুমাত্র দুই প্রধান দলের মধ্যে সমঝোতা হলেও তা জাতীয় ঐক্যের প্রতিনিধিত্ব করবে না।
বৈঠকে রাজনীতির সময়সীমা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে এক ধরনের সমঝোতা হলেও এনসিপি সহ অন্যান্য মধ্যপন্থী এবং ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দলগুলো এই রোডম্যাপের বাইরে থেকে দেখছে একটি সংকটজনক চিত্র। তাদের মতে, এই প্রক্রিয়া গণতান্ত্রিক অন্তর্ভুক্তি থেকে অনেক দূরে, যেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতের প্রতিনিধিত্বের অভাব রয়েছে। এ কারণেই তারা ড. ইউনূস ও তারেকের লন্ডন বৈঠককে রাজনৈতিক ‘পক্ষপাত’ বা ‘কৃত্রিম’ বলে অভিহিত করেছে। এ কারণে এনসিপি এবং অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে দূরত্ব কেবল রাজনৈতিক মতপার্থক্য নয়, বরং গণতান্ত্রিক অন্তর্ভুক্তির মৌলিক ইস্যুতে গভীর ফাটল।
বৈঠক থেকে উন্মোচিত আলোচনার বিষয়গুলো যেমন—নির্বাচন সময় নির্ধারণ, বিচার ও সাংবিধানিক সংস্কার—সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ হলেও এগুলো কার্যকর করার জন্য প্রয়োজন ব্যাপক রাজনৈতিক ঐক্য এবং জনগণের আস্থা। এনসিপির অবস্থান থেকে দেখা যায়, এসব বিষয় এখনও আদৌ সমাধান হয়নি। তারা মনে করে, জাতীয় সংলাপের প্রয়োজন যেখানে সব রাজনৈতিক গোষ্ঠী, নাগরিক সংগঠন ও বুদ্ধিজীবী অংশগ্রহণ করবেন এবং নির্বাচনের স্বচ্ছতা, বিচারব্যবস্থা ও সুশাসন নিশ্চিত করা হবে। অন্যথায় এই রোডম্যাপ কেবল রাজনৈতিক কার্যক্রমের একটি সাময়িক ‘অস্থিরতা প্রশমিতকারী’ কৌশলই থাকবে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে, লন্ডন বৈঠককে ইতিবাচক বার্তা হিসেবে দেখা হলেও এর নৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বিদেশে এই ধরনের বৈঠক রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ‘বহিরাগত হস্তক্ষেপ’ হিসেবে দেখা যেতে পারে, যা দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির স্থিতিশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে—এমন আশঙ্কা অনেকের। এছাড়াও, যুক্তরাজ্য সরকারের সীমিত সহযোগিতার কারণে এই প্রক্রিয়ার গতি মন্থর হয়েছে। এর ফলে নির্বাচনী প্রস্তুতি ও বিচার ব্যবস্থার সংস্কারে প্রয়োজনীয় গতিশীলতা আসে না বলে মন্তব্য করা হচ্ছে।
অবশ্য, বৈঠকের ফলে বিএনপি ও অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে দূরত্ব কিছুটা কমেছে, যা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য ইতিবাচক। তবে এনসিপি ও অন্যান্য দলগুলোর দূরত্ব বেড়ে গেছে, যা জাতীয় ঐক্যের পথে বড় বাধা। এই বিভাজন প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এখনো একটি ব্যাপক অন্তর্ভুক্তিমূলক সংলাপের প্রয়োজন, যা শুধু ক্ষমতাসীন ও প্রধান বিরোধী দল নয়, সব রাজনৈতিক ও সামাজিক গোষ্ঠীকে একসঙ্গে নিয়ে যেতে পারবে।
সংক্ষেপে, লন্ডনে ড. ইউনূস ও তারেকের বৈঠকটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নবজাগরণের সূচনা হলেও তা এখনো অর্ধেক পথেই। এনসিপির দূরত্ব গ্লোরিফাই করে বলা যায়, রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তির সংকট ও একদলীয় প্রাধান্যের বিরুদ্ধে লড়াই এখনও বেঁচে রয়েছে। এই বৈঠক একটি বরফ গলানোর মঞ্চ হিসেবে কাজ করেছে, কিন্তু বরফ পুরোপুরি গলতে হলে জাতীয় ঐক্যের বৃহত্তর ফ্রেমওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে, যেখানে সকল পক্ষ সমান অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে। না হলে, এই আলো অনেক দিন ধরেই ঝলমল করলেও গাঢ় অন্ধকারের কোল থেকে বাংলাদেশ বের হতে পারবে না।
আপনার মতামত জানানঃ