করোনা মহামারিতে মানুষের জীবন যাপন অনেকটাই কোণঠাসায় আটকে পড়েছে। দৈনন্দিন পরিকল্পনায় মানুষ আগের মতো স্বাভাবিকতা রাখতে পারছে না। দেশের অধিকাংশেরই আয় কমে গেছে, জীবন মানও নেমে গেছে অনেক। সংকটের ভেড়াজালে মানুষের কোনো রকম বেঁচে থাকাটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরইমধ্যে গোঁদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো বাড়ছে দ্রব্যের মূল্য। ফসলের মৌসুমেও পণ্যের এমন মূল্যবৃদ্ধিতে বিস্মিত হয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, অসাধু সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের কারণে বাজারে দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। আর সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারার পেছনে সরকারের ব্যর্থতাকে মোটা অক্ষরে দায়ি করছেন তারা। এছাড়াও পণ্যের উৎপাদন, চাহিদা অনুযায়ী আমদানিতে ব্যর্থতাকেও দায়ী করেছেন।
গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। রাজধানীর ফার্মগেটে বিএআরসি মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়। এটি উপস্থাপন করেন বিএআরসির গবেষণা দলের সমন্বয়ক ও প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম। গত কয়েক বছরে বিভিন্ন সময় চাল, পেঁয়াজ ও আলুর দামে অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণ উদঘাটনে কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) গবেষণাটি চালায়।
গবেষণা দলের প্রধান অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘‘আমরা গবেষণা করে দেখিয়েছি, কিভাবে সরকার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে৷ চালের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, সরকারের হাতে পর্যাপ্ত চালের মজুদ ছিল না, যা ছিল মিলারদের হাতে৷ ফলে তারা বাজারের চাহিদা অনুযায়ী চাল ছাড়েনি৷ সরকারের হাতে যদি পর্যাপ্ত চাল থাকতো, তাহলে ওএমএসের মাধ্যমে বাজারে চাল ছেড়ে নিয়ন্ত্রণ করা যেতো৷ আলুর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে৷ এটা তো সরকারের হাতে থাকে না৷ থাকে কোল্ড স্টোরেজ ও ব্যবসায়ীদের কাছে৷ বন্যার কারণে যখন সবজি উৎপাদন ব্যাহত হয়, তখন আলুর উপর চাপ পড়ে৷ আলুর চাহিদা যখন বেড়ে যায়, তখন কোল্ড স্টোরেজ থেকে পর্যাপ্ত আলু বাজারে ছাড়া হয়নি৷ অথচ সাড়ে তিন লাখ মেট্রিকটন উদ্বৃত্ত আলু আমাদের রয়েছে৷ এখানেও সরকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে আলু বাজারে আনতে পারেনি৷ আর পেঁয়াজের ক্ষেত্রে আমাদের ঘাটতি আছে৷ কিন্তু ভারত রফতানি বন্ধ করায় বাজারে সংকট তৈরি হয়৷ তখন অন্য জায়গা থেকে দ্রুত আমদানি করে ঘাটতি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার৷”
বিএআরসি উপস্থাপিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় সকল কৃষকই ধান কর্তনের প্রথম মাসের মধ্যে বাজারজাতযোগ্য উদ্বৃত্ত বিক্রি করে দেন, গত বোরো মৌসুমে ধান বিক্রির ধরণটি পরিবর্তিত হয়েছে৷ এ মৌসুমে কৃষকরা তাদের ধান মজুদ থেকে ধীরে ধীরে বিক্রি করেছেন৷ ব্যবসায়ী ও মিল মালিকরা করোনা পরিস্থিতিতে খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা করেছিলেন এবং মজুদ ধরে রেখেছিলেন৷ আলুর মূল্য বৃদ্ধির কারণ হিসেবে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, ভবিষ্যতে মূল্য বৃদ্ধির আশায় কৃষক ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে আলুর মজুত এবং হিমাগার থেকে আলু কম সরবরাহের কথা৷ পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধির পেছনের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, দেশীয় অসাধু বাণিজ্য সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজারে কারসাজি এবং ভারতের রফতানি নিষেধাজ্ঞা৷ পাশাপাশি অতিমাত্রায় ভারতের ওপর পেঁয়াজ আমদানির জন্য নির্ভরতা অন্যতম কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে৷
গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক৷ তিনি স্বীকার করেছেন, ‘সরকারিভাবে ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়া এবং সরকারি খাদ্যগুদামে পর্যাপ্ত মজুদ না থাকায় মিল মালিক ও পাইকাররা সুযোগ নিয়েছে, বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।’
দীর্ঘ দিন ধরে অভিযোগ আছে, নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। সরকারি নীতি মূলত ব্যবসায়ীদের পক্ষেই চলে যাচ্ছে। এতে করে নিত্যপণ্যের দর নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার ব্যর্থ হচ্ছে। সাধারণের অভিযোগ যে ভিত্তিহীন নয়, এবার তা প্রমাণ হলো খোদ মন্ত্রীর কথাতেই।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যারা নীতিনির্ধারক তাদের সঙ্গে এদের কোথাও না কোথাও সম্পর্ক আছে৷ সেটা লেনদেনের সম্পর্ক৷ তা না হলে এটা হতে পারে না৷ কেউ তো নির্মোহভাবে তাদের কন্ট্রোল করছে না৷ আপনি যদি তার কাছ থেকে সুবিধা পান, তাহলে কিভাবে নির্মোহভাবে কাজ করবেন? তারা মনে করেন, মাঠ পর্যায়ে অনেকেই আছে, তারা সঠিকভাবে কাজটা করতে চায়৷ কিন্তু উপর থেকে যখন নির্দেশ আসে তখন তাদের কিছু করার থাকে না৷ শুধু এই সরকার না, আগের সব সরকারের আমলেই এটা হয়েছে৷
তারা মনে করেন, শুধুমাত্র চাল, আলু আর পেঁয়াজ নয়, আরো আনেক কিছুতেই সিন্ডিকেট রয়েছে৷ ভোজ্যতেলেও তো সিন্ডিকেট কাজ করে৷ এই সিন্ডিকেট অনেক শক্তিশালী এবং এদের হাত অনেক লম্বা৷ শুধু এই সরকার নয়, আগের সরকারগুলোর সময়ও আমরা দেখেছি, সিন্ডিকেটের কারণে মাঝে মধ্যেই জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়৷ সরকার চাইলে এদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব৷”
গত কয়েক বছরে বিভিন্ন সময় চাল, পেঁয়াজ ও আলুর বাজারে অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণ উদঘাটনে বিএআরসি এই গবেষণা চালায়। তাদের প্রতিবেদনে আলাদা করে চাল, পেঁয়াজ ও আলুর দাম বাড়ার কারণ এবং তা ঠেকাতে কিছু সুপারিশ রাখা হয়।
সুপারিশগুলো এ রকম: ধান-চাল সংগ্রহের পদ্ধতির আধুনিকায়ন করা প্রয়োজন। সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করে চালকলমালিকদের দ্বারা তা চালে পরিণত করতে হবে। মোটা ও চিকন চালের জন্য সরকারকে পৃথক ন্যূনতম সহায়তা মূল্য (এমএসপি) ঘোষণা করা উচিত। সরকারি গুদামে সব সময় কমপক্ষে সাড়ে ১২ লাখ টন চাল মজুত থাকবে—এটা নিশ্চিত করা সবচেয়ে জরুরি। এটা নিশ্চিত হলে মিলমালিক ও চাল ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট সংঘবদ্ধভাবে দাম বাড়ানোর সুযোগ পাবে না। সরকারকে যথাসময়ে কার্যকরভাবে বাজারে হস্তক্ষেপ করতে হবে; সে জন্য প্রতি মৌসুমে কমপক্ষে ২৫ লাখ টন চাল সংগ্রহ করতে হবে। ধানচাষিদের স্বার্থের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে ধান-চালের সংগ্রহমূল্য এমনভাবে নির্ধারণ করা দরকার, যাতে চাষিদের উৎপাদন খরচ বাদে কমপক্ষে ২০ শতাংশ লাভ থাকে।
এবার আমনের ভরা মৌসুমে চালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি পেঁয়াজের দামও বেড়ে গিয়েছিল অস্বাভাবিক হারে। গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, পেঁয়াজের ক্ষেত্রে দেশীয় অসাধু বাণিজ্য সিন্ডিকেটের বাজারে কারসাজি মূল্যবৃদ্ধির একটা কারণ। তারা এ কারসাজির সুযোগ পেয়েছিল ভারতের পেঁয়াজ রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে। সুপারিশ করা হয়েছে, পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে; আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাতে নিজেদের উৎপাদন বাড়ানো এবং যখন আমদানি অপরিহার্য হয়ে ওঠে, তখন একটি দেশের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে দ্রুত একাধিক রফতানিকারক দেশের সন্ধান করা উচিত।
গবেষণা প্রতিবেদনটিতে আলুর মূল্যবৃদ্ধির যেসব কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলোর প্রথমেই আছে ভবিষ্যতে আলুর দাম বাড়বে—এ আশায় আলুচাষি ও আলু ব্যবসায়ীদের আলু মজুত করে রাখা; বিশেষত আলুর মৌসুমি ব্যবসায়ীদের ব্যাপক মজুতদারি এবং কৃত্রিম সংকট তৈরি করা। আলুর বাজার নিয়ন্ত্রিত হয় অসাধু ব্যবসায়ীদের দ্বারা, এখানে সরকারের নিয়ন্ত্রণ বেশ সীমিত। প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে, আলুর বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টিকারীদের শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত। এ ছাড়া হিমাগারে আলু সংরক্ষণ ও তা বের করে আনার প্রক্রিয়াটির ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি থাকা প্রয়োজন। আলুর উৎপাদন, চাহিদা, সরবরাহ ও মূল্যসংক্রান্ত তথ্য সঠিকভাবে উপস্থাপন করা এবং তা হালনাগাদ রাখার ব্যবস্থা সরকারকে নিতে হবে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিত্যপণ্যের বাজরদর নিয়ন্ত্রণে সর্বপ্রথম দরকার অসাধু বাণিজ্য সিন্ডিকেট শনাক্ত করে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা। এ ক্ষেত্রে দোষীদের কোনো ছাড় দেয়া যাবে না। একই সাথে যেসব কৃষিপণ্যের ঘাটতি রয়েছে, সেগুলোর অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে আমদানি নির্ভরতা কমাতে বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি নিতে হবে। কৃষিমূল্য কমিশন গঠনের মাধ্যমে সারা বছর বাজারে কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণ ও তদারকি করাও জরুরি হয়ে পড়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭১৪
আপনার মতামত জানানঃ