কথিত আছে, বিশ্বস্ত সেনাপতি মোহনলালের বোন মাধবী, যিনি কিনা হীরা নামেও পরিচিত ছিলেন তার সঙ্গেই নবাব সিরাজের পরিণয় ছিল। সে সূত্রে হীরার গর্ভে সিরাজের একমাত্র পুত্রসন্তান জন্ম নেয়। বিষয়টি নবাব আলিবর্দি খানের অগোচরে থেকে যায়। পাছে ঘটনাটি নবাবের ক্রোধের কারণ না হয়ে দাঁড়ায়, এজন্য ভীত সিরাজের নেয়া কিছু পদক্ষেপে মোহনলাল ক্ষুব্ধ হন এবং মুর্শিদাবাদ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। তবে সিরাজের জন্য মোহনলালের গুরুত্ব ছিল অনেক। তাই তার এ সিদ্ধান্ত বদল করতে আলিবর্দি খান উদ্যোগী হন। তিনি হীরা তথা আলেয়া বেগমের সঙ্গে সিরাজের বিয়ের আয়োজন ইসলামী রীতি অনুসারে সম্পন্ন করেন। হীরা হন সিরাজের স্ত্রী আলেয়া বেগম।
বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অমলেন্দু দে দীর্ঘদিন সিরাজ ও আলেয়া বেগমের সম্পর্ক এবং এ দম্পতির বংশপরম্পরা নিয়ে গবেষণা করেছেন। ২০১২ প্রকাশিত হয় তার আলোচিত গ্রন্থ সিরাজের পুত্র ও বংশধরদের সন্ধানে। ২০১৪ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এ বিষয়ে তার গবেষণা চালিয়ে গিয়েছিলেন। তার গ্রন্থকে অনুসরণ করে সিরাজ ও আলেয়া বেগমের পুত্র ও বংশধরদের পরিচিতি থাকছে এ লেখায়।
হীরা ধর্মান্তর হয়ে আলেয়া নামে পরিচিত হন। নবাবের প্রাসাদের পাশে যে হীরাঝিল—সেটির নামকরণ এ হীরার নামানুসারে করা হয়। আর আলিবর্দির ইচ্ছানুযায়ী মোহনলালকে সিরাজের পুত্রের রক্ষণাবেক্ষণের ভার নিতে হয়। মোহনলালের এ দায়িত্ব ইতিহাসের এক অমীমাংসিত অধ্যায়ের সূচনা করে।
১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধের ভবিতব্য পরিণতি আঁচ করতে পেরে মোহনলাল অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সিরাজ তনয়কে নিয়ে মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করেন। তিনি যুদ্ধে আহত হয়েছিলেন না নিহত তা নিয়ে ধোঁয়াশা থাকলেও ধারণা করা হয় তিনি জীবিতই ছিলেন এবং বাসুদেব ও হরন্দর নামক দুজন সহচারী নিয়ে ময়মনসিংহের বোকাইনগর দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন।
তবে ক্লাইভের চতুর অনুসন্ধানের কারণে সেখানে অবস্থান করা অসম্ভব হয়ে গেলে মোহনলাল ময়মনসিংহের জমিদার শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীকে অনুরোধ করেন সিরাজ পুত্রকে দত্তক নেয়ার জন্য। চৌধুরী তাতে সম্মতিও দান করেন।৷ পরবর্তী সময়ে জমিদারের প্রয়াণের পর মোহনলাল জমিদারপুত্র কৃষ্ণকিশোরকে সিরাজ পুত্রের বিষয়ে একই অনুরোধ করেন। কৃষ্ণকিশোরের এক ছোট ভাই ছিল। এ ছোট ভাই কৃষ্ণগোপাল রায় চৌধুরী নিঃসন্তান থাকায় সিরাজের পুত্রকে দত্তক নিতে আগ্রহী হন এবং আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমেই এ বিধি সম্পন্ন করেন। এ বিধি পালনের উদ্দেশ্য ছিল সিরাজপুত্র যেন কৃষ্ণগোপালের উত্তরাধিকার হন। এরপর পুত্রশিশুটি নতুন পরিচয় পায়, তার নাম হয় যুগলকিশোর রায় চৌধুরী। সময়টা ছিল ১৭৫৮।
১৭৬০-এ কৃষ্ণগোপাল মারা গেলে যুগলকিশোর তার জ্যাঠার তত্ত্বাবধানে জমিদারি পরিচালনায় অভিজ্ঞ ও দক্ষ হতে আরম্ভ করেন। সে সময়ে জমিদারিতে রথযাত্রার আয়োজনে আচমকা এক দুর্ঘটনায় কৃষ্ণকিশোর মারা গেলে পরিবারে এ রথযাত্রা আয়োজন চিরতরে নিষিদ্ধ করা হয়।৷ জ্যাঠার প্রয়াণের পর যুগলকিশোর দক্ষভাবে জমিদারি পরিচালনাসহ তার জ্যাঠার বিধবা দুই স্ত্রীদের প্রতিও যথাযথ দায়িত্ব পালন করেন।
তবে বিপদ তার পিছু ছাড়ছিল না। ইত্যবসরে জাফরশাহি অঞ্চলে মহামারীর প্রকোপ শুরু হলে যুগলকিশোর তা মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হন। এবং এ জায়গায় বসবাস না করার সিদ্ধান্ত নেন। সে অনুযায়ী যুগলকিশোর গৌরীপুরের বালুরঘাটে উপস্থিত হন।৷ তবে এ অঞ্চলে তখন বনজঙ্গলে পূর্ণ ও নিম্নশ্রেণীর সম্প্রদায়ের আবাসস্থল ছিল। যুগলকিশোরের বিচক্ষণতায় সে স্থানের আমূল পরিবর্তন ঘটে এবং জীবনযাত্রার মান বাড়ে। প্রজাদের মাঝে তার প্রতি সমীহ তৈরি হয়।
সেকালে ময়মনসিংহে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ছিল চরমে। বিদ্রোহ দমনে সরকার জমিদারদের শরণাপন্ন হলে যুগলকিশোর এক্ষেত্রে সহযোগিতা করেন। একই সময়ে ময়মনসিংহে বন্যার আঘাতে জনজীবনে দুর্ভোগ নেমে আসে। একদিকে দেখা দেয় অনাহার, অন্যদিকে শুরু হয় লুটপাট। যুগলকিশোর এ দুর্যোগ সামাল দিতে তৎপর হন। সিন্ধা পরগনার গ্রামে অত্যাচারের মাত্রা বাড়লে সেখানকার জমিদার মুহম্মদ খাঁর কাছে যুগলকিশোর সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু মুহম্মদ খাঁ প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে এ বিশৃঙ্খলা আরো উসকে তোলেন। নিরুপায় হয়ে যুগলকিশোর ১৭৭৯-তে প্রায় পাঁচ হাজার লাঠিয়ালসহ সিন্ধা আক্রমণ করে বসেন এবং তার পদাতিকেরা সিন্ধাতে ব্যাপক অরাজকতা চালায়, যাতে যুগলকিশোরের প্রতিভাপূর্ণ জীবনে কলঙ্ক লেপিত হয়।
মুহম্মদ খাঁর অভিযোগ ও এ ঘটনার তদন্ত জেরে তাকে শাস্তি দান করার জন্য ঢাকায় নেয়ার আদেশ দেয়া হলেও যুগলকিশোরের পূর্ববর্তী সহযোগী আচরণের কারণে রটন সাহেবের অনুরোধে নাসিরাবাদে বিচার কার্য সমাধা করার অনুমতি দেন। তবে বিচারে নৈরাজ্য তৈরিতে সংশ্লিষ্ট থাকার যথাযথ প্রমাণ না পাওয়ায় যুগলকিশোর একটি অঙ্গীকারপত্র লিখে এ থেকে অব্যাহতি পান। তবে বিষয়টি তার আত্মসম্মানের সঙ্গে শারীরিক সক্ষমতায় আঘাত করার জন্য যথেষ্টই ছিল।
প্রশাসনিক জীবনের এ টালমাটাল হাওয়া এসে লাগে পারিবারিক আঙিনায়ও। যুগলকিশোরের প্রয়াত জ্যাঠার দুই বিধবার মাঝে পতির জলপিণ্ড সংস্থানের জন্য দত্তক পুত্র গ্রহণে আগ্রহী হওয়ার সঙ্গে তৈরি হয় মনোমালিন্য। যুগলকিশোর মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করলেও তারা এতে কোনো সমাধানে আসতে রাজি হন না। মোকদ্দমার পরিপ্রেক্ষিতে রত্নমালা ও নারায়ণী দেবীর নামে জমিদারি জারি থাকে। তারা যুগলকিশোরের অধিকৃত সম্পদের অর্ধেকের মালিকানা লাভ করেন। রত্নমালা দেবীর মৃত্যু পরবর্তী সময়ে নারায়নী দেবী সম্পদের প্রকৃত উত্তরাধিকার হয়ে দত্তক পুত্র গ্রহণ করেন। কেননা কোনো না কোনোভাবে তারা যুগলকিশোর সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন। এ সন্দেহ যুগলকিশোরের মাঝেও ছিল, যা তাকে সংশয়ে ফেলে।
যুগলকিশোর রাজশাহীর পাকুরিয়া গ্রামের বিখ্যাত শক্তি সাধক পণ্ডিত মোহন মিশ্রের কাছে কালীমন্ত্রে দীক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি নানা রকম ধর্মীয় উন্নয়নকাজে অবদান রাখেন, যা তাকে সাধারণের কাছে শ্রদ্ধা অর্জনে সহায়তা করে। তবে মামলা মোকদ্দমা এবং আত্মপরিচয় নিয়ে আতঙ্ক সর্বদা তার মাঝে বিরাজমান ছিল। তার দৈহিক গঠন, বর্ণ তাকে বাঙালিদের থেকে সহজেই আলাদা করে তুলত, যা তাকে ব্রিটিশ শাসকদের তোপের মুখে ফেলতে যথেষ্ট ছিল। তাই তার গৌরীপুর থেকে শ্রীহট্ট যাওয়ার পরিকল্পনা করে পরিচয় আত্মগোপন করেন এবং ফরিদপুরের যাপুর গ্রামের ভট্টাচার্য বংশের রুদ্রানী দেবীকে বিয়ে করেন এবং তার গর্ভে হরকিশোর, শিবকিশোর নামে দুই পুত্র এবং অন্নদা, বরদা, মোক্ষদা ও মুক্তিদা নামে চার কন্যার জন্ম হয়।
পুত্র হরকিশোর শ্রীহট্ট জেলায় জমিদারি বিস্তৃতি ঘটালেও তা ধরে রাখতে অসামর্থ হন এবং তা বিক্রি করে দেন। গৌরীপুর বাড়ির সৌন্দর্যবর্ধনসহ তিনি রাজশাহীর বৃকুৎসা গ্রাম নিবাসী কাশীনাথ মজুমদারের কন্যা ভাগীরথী দেবীকে বিয়ে করেন। সেখানে তার একমাত্র কন্যাসন্তান কৃষ্ণমনি জন্ম নেয়। কৃষ্ণমনির শৈশবকালে পিতৃবিয়োগে তাবৎ সম্পদ কোর্ট অব ওয়ার্ডসের তত্ত্বাবধানে কিছুদিন পরিচালিত হয়। অতপর আনন্দকিশোর রায় চৌধুরী নামে ভাগীরথী দেবী এক দত্তক পুত্র গ্রহণ করেন। তবে বাল্যকাল থেকেই আনন্দ ছিল উচ্ছৃঙ্খল ও অপব্যয়ী। যার কারণে ভাগীরথী দেবী পুত্রের ওপর গোটা জমিদারির দায়িত্ব অর্পণ করতে অপরাগ হন। অতঃপর গোটা জমিদারি ভাগীরথী দেবী ও আনন্দের মাঝে সমবণ্টিত হয়।
এ দত্তকপুত্র উচ্ছৃঙ্খল আনন্দকিশোর রায় চৌধুরীর মধ্য দিয়েই যুগলকিশোরের বংশের ধারা অব্যাহত থাকে। সে সূত্রে এখন শ্রীহট্টের দিকে দৃষ্টিপাত করা জরুরি। যুগলকিশোরের প্রথম স্ত্রী রুদ্রানীর দুই পুত্র মারা যাওয়ার পর তিনি যমুনা দেবীকে বিয়ে করেন, যিনি পাবনার পাকুরিয়া গ্রামের গঙ্গাময়ী দেবীর বোন। যমুনা দেবীর গর্ভে প্রাণকৃষ্ণনাথের জন্ম। স্ত্রী-পুত্রসহ তিনি সিলেটের কাজল শহরে গিয়ে সেখানে বিশাল জমিদারি ক্রয় করে পুনরায় জমিদারি শুরু করেন।
তবে এ বেলায় তিনি নিঃসঙ্গ অবস্থায় থাকতেন। গৌরীপুরের সে দাপটের গল্প এখানে ক্ষীয়মাণ নদীর স্রোতের মতোই সরু ছিল। যেহেতু শারীরিক গড়নের কারণে যুগলকিশোরকে পাঞ্জাবি বলে মনে হতো। তাই নিজের পরিচয় সম্মুখে প্রকাশ হওয়ার শঙ্কা সবসময় তাকে তাড়া করে বেরিয়েছে। নিজ পরিচয় তিনি তার পুত্র প্রাণকৃষ্ণনাথের সঙ্গে সময়ানুযায়ী আলোচনা করেন। ইংরেজ শাসনামলে এ বিস্ফোরক তথ্য সামনে এলে সমূহ পরিণতি কী হতে পারে তা বিবেচনা করে তারা এ তথ্য গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নেন এবং সবাই সিলেটে একসঙ্গে না থেকে একটি অংশ পদবি পরিবর্তন করে শিলংয়ে পাড়ি জমান৷এমন তথ্য ময়মনসিংহ ইতিহাস গ্রন্থে পাওয়া যায়।
যুগলকিশোরের ছেলে প্রাণনাথ চৌধুরী সিলেটের উন্নয়ন সাধনে যথেষ্ট অবদান রাখেন। সিলেট লেক, যুগল আখড়া, ইসকন প্রতিষ্ঠান এসব তার প্রমাণ। প্রাণনাথের প্রথম পুত্র কাজল পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে মাত্র ১২ বছর বয়সে।
দ্বিতীয় পুত্র সৌরেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী ভিন্ন ধাতুতে গড়া ছিলেন। জমিদারী ব্রিটিশ শাসনের স্রোতের অনুকূলে না গিয়ে তার সম্পর্ক স্থাপিত হয় বিপ্লবী দলের সঙ্গে। যার দরুন তিনি ব্রিটিশ সরকারের বাঁকা নজরে পড়েন। তবে পিতার পরামর্শে নিজ পরিচয় জেনে তিনি পরবর্তী সময়ে বিপ্লবী কার্যক্রমের থেকে সরে গিয়ে শিক্ষা আহরণে মনোনিবেশ করেন এবং এরই মাঝে দুবার নামেরও বদল করেন। প্রসন্ন চন্দ্র রায় চৌধুরী এবং প্রসন্নকুমার দে বলে তিনি দুবার নিজেকে পুনর্জন্ম দেন। অর্থাৎ সৌরেন্দ্র কিশোর, প্রসন্ন চন্দ্র, প্রসন্নকুমার একই অঙ্গে তিনটি পরিচয়ের ধারক।
প্রসন্ন চন্দ্র রায় চৌধুরী কলকাতার হিন্দু কলেজে ভর্তি হয়ে জুনিয়র স্কলারশিপ লাভ করেন। এ কলেজে বিএ ডিগ্রি লাভ করার সময়ে এটি প্রেসিডেন্সি কলেজে রূপান্তর হয়। এমন তথ্য প্রেসিডেন্সি কলেজ রেজিস্টার থেকে উদ্ধৃত।৷ ধারণা করা হয়, এ কলেজে পড়ার সময়েই তার সঙ্গে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিচয় ঘটে। এটির সত্যতা নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও প্রসন্নকুমার রচিত ইংরেজি কবিতা Is Bankim Dead?” সাহিত্যধারায় এক অমূল্য রত্ন সংযোজন করে নেয়। বঙ্কিম প্রয়াণ পরবর্তীকালে প্রথম কোনো বাঙালি কবির এমন শ্রদ্ধাঞ্জলি সত্যি অবাক করার মতো।
সুবিশাল বাংলার অধিপতির রক্তধারা কেবল শাসনযজ্ঞে নয়, বরং সাহিত্য প্রান্তরেও কাঁপন তোলে চিন্তাশীলতা ও কলমের আঁচড়ে। পিতার কাছে জানা যুগলকিশোরের জীবনকাহিনী প্রসন্নকে আলোড়িত করেছিল দারুণভাবে। তার ভিত্তিতে তিনি বোরাইনগরের ইতিবৃত্ত প্রবন্ধ রচনা করেন, যা কিনা প্রকাশিত হয় জাহ্নবী নামক বিখ্যাত বাংলা পত্রিকায়। ভারতী পত্রিকায় প্রকাশ পায় তার রচিত যুগলকিশোরের দস্যু দমন ও বিচারের ফল। উল্লেখ্য, তৎকালীন ভারতীয় পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ময়মনসিংহ ইতিহাস গ্রন্থ রচনায়ও প্রসন্নের ভূমিকা অতিগুরুত্বপূর্ণ।
এবার আসি প্রসন্নকুমার দের গল্পে। প্রসন্নকুমারের তিন স্ত্রীর মাঝে বড় স্ত্রীর ত্রিপুরেশ্বরী দেবীর ঘরে জন্ম নেয় উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী। তবে এক দুর্ঘটনায় তার প্রথম স্ত্রী গত হলে আত্মীয়রা প্রসন্নকে এ ব্যাপারে দায়ী করে। সন্দেহের জেরে মামলা টানা হলেও তা ধোপে টেকে না শেষাবধি। তবে এ মামলা চলাকালীন উপেন্দ্রকিশোরকে তার মায়ের বাড়ির লোকেরা বরিশালে নিয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে প্রসন্ন আবারো বিয়ে করেন।৷এ পক্ষে তার দুই পুত্র ও এক কন্যাসন্তান হয়। পুত্রের নাম নলিনী কিশোর রাখা হলেও পরে তিনি বিজয়কুমার বলে পরিচিত হন। আর দ্বিতীয়জনের নাম দেয়া হয় হেমন্তকুমার৷।
প্রসন্নকুমারের প্রথম স্ত্রীর ভাই পুলিশ বিভাগে যোগ দিয়ে সিলেট এসে পুনরায় তাকে ফাঁসাতে চাইলে প্রসন্ন কাজলশাহর জমিদারি ম্যানেজারের কাছে অর্পণ করে সুরমা নদীর পাড়ে সুনামগঞ্জে থিতু হন এবং এখানে জমিদারি ক্রয় করেন৷ আর এর দায়িত্বে তার দ্বিতীয় স্ত্রী ও পুত্র বিজয়কুমার শামিল হন। এ সময়েই তিনি প্রসন্নকুমার রায় চৌধুরী থেকে প্রসন্নকুমার দেতে রূপান্তর হন।
প্রসন্নকুমারের দ্বিতীয় স্ত্রী গত হওয়ার পর তৃতীয় স্ত্রীর কোল আলো করে ছয় পুত্র পূর্ণেন্দুকুমার, ঘনেন্দু, নীরেন্দু, শরবিন্দু, প্রশান্ত ও নওয়ালকুমার এবং এক কন্যাসন্তান জন্মায়। সুনামগঞ্জে শিক্ষাবিস্তারে প্রসন্নকুমার ভূয়সী অবদান রাখেন। তার মাঝে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক জুবলি স্কুল অনন্য। তার উদ্যোগে সুনামগঞ্জে প্রথম স্থাপিত হয় জুবিলি প্রেস। যুগলকিশোর কর্তৃক পরিচালিত ময়মনসিংহ জমিদারিতে বোকাইনগর থেকে নিজ এলাকা পর্যন্ত দেবদারু বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি এক বিশাল পদক্ষেপ। এতসবের মাঝেও সাহিত্যের প্রতি টান তার সবসময়ই থেকেছে।
তার ইংরেজিতে রচিত indian bounquet আমেরিকায় প্রকাশিত “Books of poet individual Bengals”-এ স্থান করে নিয়েছে। এ গ্রন্থের শিরোনাম “Mapping the Nation” একজন ভারতীয়ের গৌরববোধ এ কবিতার মধ্য দিয়ে প্রসন্ন উপস্থাপন করেছিলেন। আসামের চিফ কমিশনার স্যার হেনরি জন স্টেডম্যান কটন সম্পর্কে প্রসন্নকুমার দে কবিতা রচনা করায় তাকে ভারতবন্ধু বলা হয়। “The peacock Lute” নামে তার আরো একটি গ্রন্থ আছে তা অবশ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।
প্রসন্নকুমারের পরে তার পুত্র বিজয়কুমার সংসারের দায়িত্ব নেন। তিনি ১৯২৬-এ সুনামগঞ্জ থেকে শিলংয়ে চলে যান। সঙ্গে পদও বদল করেন। বিজয় কুমার দের জায়গায় পরিচিত হন বিজয়কুমার লালা দে নামে। তিনি অবশ্য সাহিত্য কিংবা জমিদারিতে নয়। পারদর্শিতা দেখান ওকালতিতে। কলকাতা থেকে আইনের ডিগ্রি লাভ করে তিনি শিলংয়ে ওকালতি শুরু করেন। শিলং বার অ্যাসোসিয়েশনে তিনি পাঁচ বছর সভাপতি ছিলেন। দেশভাগের আগে পরিবারের সবাইকে আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের নানা জায়গায় বসবাসের ব্যবস্থা করে দিলেও তার কজন ভাই অবশ্য সুনামগঞ্জেই রয়ে যান।
প্রসন্নকুমারের তৃতীয় স্ত্রীর কথায় আমরা জেনেছি তার গর্ভজাত সন্তানদের বিষয়ে৷ নওয়ালকুমার দে বাদে বাকি সবাই এ সুনামগঞ্জেই রয়ে গিয়েছিল।৷চতুর্থ ছেলে শরবিন্দু দে ১৯২১-এ গান্ধী পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে তাতে যোগ দেন। পরিবারের কাছে তিনি বুনি বাবু বলে পরিচিত ছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বুনি বাবু সক্রিয় কর্মী ছিলেন। এ অসহযোগ আন্দোলনের আগেই তিনি তরুণ সংঘ নামে একটি বিপ্লবী দল গঠন করেন।৷ ব্রিটিশ আধিপত্য প্রতিহত করাই ছিল যার মূল উদ্দেশ্য। এ বিপ্লবী দলে দেবেন্দ্র চন্দ্র দত্ত, চিত্তরঞ্জন দাস, ছোট ভাই প্রশান্ত দে, দীনেশ চৌধুরী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। তাদের হাত ধরেই সুনামগঞ্জের বিপ্লবী দল গড়ে ওঠে। সুনামগঞ্জ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসেবেও তিনি সক্রিয় ছিলেন।
১৯২১-এ অসহযোগ আন্দোলনের যোগদানের পর তিনি আর বিদ্যালয়ে ফেরেননি। ১৯৩০-৩২-এ আইন অমান্য করে আন্দোলনে যোগ দেয়ায় কারাবরণ করেন। কমিউনিস্ট পার্টি কংগ্রেস ত্যাগ না করা অবধি শরবিন্দু সুনামগঞ্জ মহকুমা কংগ্রেসের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শরবিন্দুর প্রভাবেই তার পরিবার ব্রিটিশবিরোধী সক্রিয় আন্দোলনের ধারায় জড়িয়ে পড়ে। ইতিহাস যেন বৃত্তের একই কেন্দ্রতে এসে ফের দাঁড়িয়ে পড়ে।
প্রশান্তকুমার দে নিজেও সুনামগঞ্জ বিপ্লবী দলের নেতা ছিলেন। সিলেটের মুরারী চাঁদ কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি শেষে তিনি এলাহাবাদে ডিফেন্স অর্ডিন্যান্স অর্গানাইজেশনে যোগদান করেন। মহাত্মা গান্ধী পরিচালিত আইন অমান্য করে আন্দোলনে শামিল হওয়ায় চাকরি থেকে তাকে পদত্যাগ করতে হয় এবং তিনি সুনামগঞ্জে এসেই আন্দোলনে যোগ দেন। ’৪৭-এর ১৫ আগস্টে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হলে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও শ্রীহট্ট জেলা গণভোটের মাধ্যমে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। এ পরিবর্তনে প্রশান্তকুমার নিজেকে মানিয়ে নিতে অসমর্থ হন। ১৯৪৮-এ সব কমিউনিস্টকে পাকিস্তানে কারাগারে বন্দি করার সঙ্গে শরবিন্দু ও স্ত্রী সুষমাও গ্রেফতার ও নির্যাতনের শিকার হন।
পরবর্তী সময়ে ভারত ফিরে যাবেন এ শর্তে তাদের মুক্তি দেয়া হলে তারা ১৯৭০-এ ভারতে আসেন এবং ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী নৃপেন চক্রবর্তীর শরণাপন্ন হন। তার সহায়তায় তিনি আগরতলায় তাদের বসবাসের জন্য এক টুকরা জমি কিনে দেন। সেখানেই আবাস নির্মাণ করে তারা বাস করেন এবং জীবনের অন্তিম দিনগুলো এখানেই অতিবাহিত করেন।
তবে ইতিহাসের পরিহাস এ নৃপেন চক্রবর্তী শেষ পর্যন্ত জানতে পারেননি তিনি অজান্তেই সিরাজের বংশধরদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করে গেছেন। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে শরবিন্দু নামটি এক উজ্জ্বল আত্মত্যাগী চরিত্র হিসেবে চিহ্নিত। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার এ বংশধারার বিবরণে এলে আশ্চর্য ও হয়রান দুটোই হতে হয়। বর্ণাঢ্য এ যাত্রাপথের গল্প অল্প কথায় বলে শেষ করা অসম্ভব। আলিবর্দি ও সিরাজের চৌকস বুদ্ধি, সরলতা, ঔদার্য আর সহনশীলতা যেন দৃপ্তভাবে বিরাজমান থেকেছে প্রজন্ম থেকে প্রজান্মতরে। জমিদারি দক্ষতা থেকে সাহিত্যের মাঠ বিচরণ আইনের মারপ্যাঁচ হতে শেষে ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা প্রমাণ করেছে দেশপ্রেমিকের রক্তে বহমান দেশপ্রেমের এ ভক্তি চিরশাশ্বত, চিরঞ্জীব। আর যুদ্ধ কেবল মাঠে নেমে নয়, বিদ্যা-বুদ্ধি-জ্ঞান-আহরণ ও এর সঠিক প্রয়োগেই নিহিত। এর সঠিক লালন ও পরিবর্ধন বাঙালির ভাবনার সীমাহীন প্রসারণ ঘটিয়ে চলেছে চমৎকারভাবে।
কে জানত নবাবের ঘেঁষে থাকা আলেয়ার সমাধিতে পুঞ্জীভূত আঁধারের মাঝে সুপ্ত এ আলোর ঝিলিক আড়ালে থাকা বংশধারার যাত্রাকথার উজ্জ্বল আলোকবর্তিকার ইঙ্গিত বহন করে চলেছিল অলক্ষ্যে, অগোচরে।
আপনার মতামত জানানঃ