পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মুসলমানদের নিয়ে লিখতে বা বলতে গেলে অনেক কথা মনে পড়ে যায়। অনেকদিন আগে আমার বন্ধু, ওর বাবা বিখ্যাত সাহিত্যিক, হাসতে হাসতে একটা গল্প বলেছিল। ওর সঙ্গে ওর সহপাঠিনীর তখন চুটিয়ে প্রেম। কিছুদিন বাদে দুই বাড়িতেই জানাজানি হলো। সেরকম আপত্তি উঠল না কোনো বাড়িতেই। আমার বন্ধুর বাড়ি তো সবসময় খোলা হাওয়া। কিন্তু মেয়েটির বাড়িতেও ছেলেটির ব্যবহারে সবাই এমন মুগ্ধ যে তাকে অল্প সময়ের মধ্যেই আপন করে নিল। দিন যায়। বিয়ের দিনক্ষণ পাকা। এমন সময়ে মেয়ের মামা আড্ডা মারতে মারতে বলে বসলেন, ছেলেটিকে তো ভালোই ভাবতাম, এখন জানলাম ও মুসলমান।
বহু বছর আগের ঘটনা। এখন আমার বন্ধুর মেয়ের বিয়েও হয়ে গেছে। কিন্তু বিষয়টি কোনোভাবে উঠলে বন্ধুটি হেসে উড়িয়ে দিতে চাইলেও বুঝতে পারি ওর বুকের ভেতর অদৃশ্য কাঁটা খচখচ করে। ভোরবেলায় মালদা স্টেশনে নেমেছি। শীতকাল। সিনিয়র এক দাদার বাসায় যাব। আগে কখনো যাইনি। তাও ঠিকানা খুঁজে ঠিক বের করেছি। শুধু ঠিক বাড়িতেই এসেছি কি না নিশ্চিত হতে মর্নিং ওয়াকে ব্যস্ত এক বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি হাঁটা না থামিয়েই জানতে চাইলেন, ‘ভদ্রলোক কি মুসলমান বিয়ে করেছেন!’ সেই বিয়ের বয়স অন্তত কুড়ি বছরের বেশি। কিন্তু স্বনামখ্যাত স্কুলশিক্ষক পাড়ায় পরিচিত মুসলিম নারীর স্বামী হিসাবে। এসব না হয় পুরোনো গল্প। এ সেদিন আমার এক বন্ধুর আশি বছর বয়সি উচ্চশিক্ষিত বাবা আমাদের চেনা এক গাড়ির ড্রাইভারের কাছে জানতে চাইছিলেন-তোরা কি বাসায় উর্দু বা হিন্দিতে কথা বলিস! বেচারা, ঘ্যাঁট চচ্চড়ি খাওয়া বঙ্গসন্তান ফ্যালফ্যাল করে বৃদ্ধের মুখের দিকে তাকিয়ে হয়তো ভাবছিল, উর্দু ঠিক কী রকম ভাষা!
আমাকে যদি বলেন, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মুসলমানের মূল সমস্যা কী, আমি বলব, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সঙ্গে অপরিচয়ের সমস্যা। কেউ কাউকে সেভাবে চিনি না। চিনতে চাইও না। ভারতের একমাত্র রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ যেখানে বাঙালি মুসলমানের বাস গ্রামে। শহরে চাকরি করতে আসেন কেউ কেউ। ইদানীং সংখ্যা কিছু বাড়ছেও। সামান্যসংখ্যক মুসলিম হালে কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনছেন ঠিকই, তবে এর সংখ্যা নিতান্তই হাতেগোনা। এমন অনেক শহর আছে, যেখানে সংখ্যালঘুদের বাড়ি বা ফ্ল্যাট ভাড়া পাওয়া মুশকিল। কোনো কোনো এলাকায় তো মুসলমানের পক্ষে নাম-পরিচয় গোপন না করলে কাজ পাওয়া কঠিন। ফলে সল্ট লেক, লেক টাউনের মতো অভিজাত অঞ্চলে আমিনাকে সাজতে হয় মীনা, সফিকুল হয়ে যান স্বপন বা ফিরোজ হয়ে যায় রঞ্জিত।
১৯৪৭ সালের পর থেকে খোদ কলকাতা শহরের জনবিন্যাস বদলে গেছে। শুধু কলকাতা কেন, নদীয়ার দিকে গেলে জানতে পারবেন, ছোট ছোট মফস্বল শহরে এখন মুসলমানের অস্তিত্ব কম। নানা কারণে তারা গ্রামে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। মুসলমান ও নিম্নবর্গের হিন্দুর জমির ওপরই গড়ে উঠেছে অত্যাধুনিক নিউটাউন। কলকাতা শহরের জনবিন্যাস যে বদলে গেছে, তা আপনি হাঁটতে হাঁটতেই দেখতে পাবেন। শুধু একটু চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। কলকাতা উত্তরে চিৎপুরে পাবেন সব থেকে প্রাচীন পাঠান স্থাপত্যের বশরি শা মসজিদ। শামবাজারে নিঃশব্দে থেকে গেছে ভাঙাচোরা এক মসজিদ। শেষ কবে সেখানে নামাজ পড়া হয়েছিল, কেউ বলতে পারবেন না। কিন্তু মসজিদ যখন আছে, আন্দাজ করা যায় একদিন সেখানে প্রাণের স্পন্দন ছিল। ছিল সংখ্যালঘু বসতি। কবে কোন রাতের অন্ধকারে তাদের পাততাড়ি গোটাতে হয়েছিল, তা গবেষণার বিষয়। ঢাকুরিয়া, প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড সব একদিন ছিল মুসলিম জনবসতি। এখন যেতে যেতে অধিকাংশ জায়গায় চোখে পড়বে জীর্ণ মসজিদ। ১৯৪৭ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মুসলমানের জীবনযাপন বদলে দিয়েছে। যে এলিট ও মধ্যবিত্ত মুসলমানের দাপট ছিল কলকাতার বিস্তৃত এলাকায়, তারা দেশ ছেড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাওয়ায় মুসলিম সমাজে যে শূন্যতা নামে, তা আজও পূরণ হয়নি। শিল্পী, সাহিত্যিক, চাকরিজীবী, শিক্ষকরা চলে গেলেন ওপারে। মুসলিম সমাজের নিম্নবিত্ত, গরিবস্য গরিবরা রয়ে গেলেন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়। দেশবিভাগের দাবিতে সোচ্চার মুসলিম লীগ রাতারাতি মুছে গেল এ রাজ্যের রাজনৈতিক পরিসর থেকে। মুর্শিদাবাদের নবাব পরিবারের দু-একজন, সৈয়দ বদরুদ্দোজা ও একে হাসানুজ্জামান ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো রাজনৈতিক নেতা না থাকায় মুসলিম জনগোষ্ঠী আচমকা টের পেল তাদের পায়ের তলায় মাটি সরে গেছে। রাজ্যের নীতিনির্ধারণে তাদের কিছুমাত্র ভূমিকা নেই। নানাভাবে তাদের কোণঠাসা করার চেষ্টা চলতে থাকল। সোহরাওয়ার্দী তখনো ছিলেন। কিন্তু তিনি তখন নখদন্তহীন বৃদ্ধ সিংহ মাত্র। ফলে মুসলিম জনগণের সামান্যসংখ্যক প্রভাবশালী অংশ মুসলিম লীগ ছেড়ে কংগ্রেসে যোগ দিলেন। সাধারণ মুসলমানদের অধিকাংশ হিন্দু আধিপত্য মেনে নিতে বাধ্য হলেন। ঈদ বা অন্যান্য উৎসবে তারা সংযত থাকলেন। গরু কুরবানি বা মসজিদ থেকে জোরে মাইকে আজান দেওয়া থেকেও তারা বিরত থাকলেন অশান্তি এড়াতে।
’৪৭-পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মুসলমান সমাজের অর্থনীতি ছিল নিতান্তই দুর্বল। মিডিল ক্লাস বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া সমাজের চেহারা হলো দুর্বল, কঙ্কালসার। বাঙালি মুসলমান বলতে তখন শুধু গরিব কৃষক, খেতমজুর, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কোনো কোনো জেলায় জরি, পান, রেশম চাষনির্ভর অর্থনীতি। ভাগাভাগির ঠেলায় একদা সমৃদ্ধ মুসলিম অঞ্চলগুলো রাতারাতি ভূতুড়ে চেহারা নিল। বালুরঘাটের হিলি, মুর্শিদাবাদের লালগোলা, মালদার রতুয়া, চাঁচল, বড়সোনা মসজিদসংলগ্ন গ্রামগুলো ছিল রংপুর, রাজশাহীনির্ভর। সিরাজগঞ্জ শহরের পাট ব্যবসা নির্ভরশীল ছিল কলকাতার ওপর। পাটের কারখানা পড়ল এপারে। পাটচাষিদের অধিকাংশের বাসস্থান হলো তৎকালীন পূর্ববঙ্গ। সব মিলিয়ে টালমাটাল যে নতুন সমাজ-অর্থনীতি, তাতে পশ্চিমবঙ্গীয় মুসলমান জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হলেন সব থেকে বেশি। তাদের চিরকালের জন্য নির্বাসিত হতে হলো সাধের কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য বড় শহর থেকে। আমাদের দুর্ভাগ্য, এ নিয়ে কখনোই সেভাবে গবেষণা হয়নি। না ভারতে, না বাংলাদেশে।
বাংলা টুকরো হয়ে যাওয়ার পর নানাভাবে মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর সরকারি-বেসরকারিভাবে হেনস্তা শুরু হলো। ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে তাদের পাকিস্তানপন্থি বলে চিহ্নিত করে যখন-তখন জেল-জরিমানা হলো প্রায় নিত্যদিনের ব্যাপার। প্রশাসন প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত নিল, সীমান্তের কুড়ি কিলোমিটারের ভেতরে রাষ্ট্রের পক্ষে বিপজ্জনক লোকদের থাকতে দেওয়া হবে না। স্পষ্ট হয়ে গেল মুসলিমদের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি। কারণ, সীমান্তসংলগ্ন গ্রামগুলোয় সংখ্যাগরিষ্ঠ বাসিন্দাই বলা বাহুল্য মুসলমান। এ অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেন মুর্শিদাবাদের তৎকালীন জেলাশাসক বিশিষ্ট লেখক অন্নদাশঙ্কর রায়। তার মারফত খবর পেয়ে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বিধান রায় মন্ত্রিসভার প্রস্তাব তৎপরতার সঙ্গে খারিজ করেছিলেন। না হলে পরিস্থিতি যে ঠিক কী রকম হতো, কল্পনা করতেও ভয় লাগে। ভাগ্যিস তখন দিল্লির মসনদে নেহেরু ছিলেন। এখনকার চরমপন্থিরা থাকলে অবস্থা জটিল হতো, তা নিয়ে সন্দেহ নেই।
বিজেপির থিঙ্ক ট্যাঙ্ক আরএসএস ইতোমধ্যেই সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনী গড়ে তুলে ফের পুরোনো দাবি সীমান্ত থেকে ‘শত্রুভাবাপন্ন লোকজনকে সরিয়ে দাও’ সামনে এনে সোচ্চার হয়েছে। ফলে আগামী দিনে ‘শত্রু’দের কপালে কী আছে, বলা কঠিন। অনেকেই পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সমাজের কথা বলতে গিয়ে তাদের অন্তহীন সমস্যার কথা বলেন। আমি কিন্তু মনে করি, সব থেকে খারাপ দিক হচ্ছে মুসলিম সমাজ নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমানসের দৃষ্টিভঙ্গি। উন্নাসিকতা এবং অপ্রিয় হলেও সত্যি-বিদ্বেষ। পশ্চিমবঙ্গের জন্মলগ্ন থেকেই বিষয়টি সত্যি। আমরা মেজরিটি উচ্চবর্গের হিন্দুরা লালন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের উদ্ধৃতি দিয়ে সম্প্রীতির কথা বলি বটে; কিন্তু মুখে, বাস্তবে নয়। ব্যতিক্রম নেই এমন কথা বলব না; কিন্তু তা সংখ্যায় অনেক কম। ভাবা যেত একুশ শতকে ধীরে ধীরে পারস্পরিক সম্পর্ক সহজ হবে। এখন এর ঠিক উলটো হয়েছে। বিজেপি ভোটব্যাংকের স্বার্থে প্রতিদিন দৃষ্টিকটুভাবে যে বিদ্বেষের চাষ করছে, এর ফলে ইতোমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগুরু জনমানসে পশ্চিমি দেশগুলোর মতো ইসলাম ফোবিয়া ক্রমবর্ধমান। সাম্প্রতিক বাংলাদেশ প্রশ্নে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার নামে এ ফোবিয়া একেবারে খোলাখুলিভাবে বেআব্রু হয়ে সামনে এসে পড়েছে। ইদানীং পশ্চিমবঙ্গের বাসে-ট্রেনে, দোকানে, বাজারে কান পাতলেই মুসলমানদের সম্পর্কে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধ্যানধারণা বোঝা যায়। বলাই বাহুল্য, কোনোটাই খুব প্রশংসার নয়। শুধু সাধারণ জনতা নয়, এমনকি অনেক পণ্ডিত ঘুরেফিরে মুসলমানদের যথেষ্ট গোঁড়া, ধর্মান্ধ উগ্র, হিংস্র প্রমাণ করতে ব্যস্ত থাকেন। মুসলিম মেয়েদের হিজাব, বোরকা তাদের মধ্যযুগীয় চিন্তাভাবনা বলে ‘উদার, প্রগতিশীলরা’ সমালোচনা করেন, তাদের বাড়িতেই ছেলেমেয়ের বিয়ে হয় কুষ্ঠি, পাঁজিপুঁথি মেনে, শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা লাইন বাই লাইন অনুসরণ করে। অদ্ভুত লাগে যখন বোরকা, হিজাব হয় প্রাচীন পন্থা। পাশাপাশি সিঁদুর, শাখা পলা, অমুক পুজো, তমুক ব্রত নিয়ে তথাকথিত সেক্যুলাররা নিশ্চুপ থাকেন।
মুসলিম সমাজকে চিনতে হলে তাদের আগে জানতে হবে। জানতে গেলে মেলামেশা করতে হবে। মুশকিল হচ্ছে, দুটি ক্ষেত্রেই আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের, অধিকাংশের বিপুল অনীহা। শত শত বছর পাশাপাশি থেকেও কেউ কাউকে চিনি না। মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন তবুও হয়তো জানে পড়শি হিন্দুদের পুজো-পার্বণ, উৎসবের কথা। আমরা বলতেই পারব না দুই ঈদের পার্থক্য বা চাঁদ রাতের বৈশিষ্ট্য অথবা আকিকার তাৎপর্য। সত্যি বলতে কী, আমিও কিচ্ছু জানতাম না কয়েক বছর আগেও। ভারতের সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি রাজেন্দ্র সাচারের নেতৃত্বে কংগ্রেস একটি কমিশন গঠন করে সারা দেশের ’৪৭-পরবর্তীকালে মুসলমান সমাজের অবস্থা খতিয়ে দেখতে। সেই রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসতেই দেশজুড়ে হইচই শুরু হয়ে গেল। প্রগতিশীল পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পরিস্থিতি দেখে তো তাজ্জব হতে হয়। সাচার সাহেবের উৎসাহে আমি একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানাই-মুসলমানের কথা। সেই ছবি বানাতে গিয়েই অপর সম্প্রদায়ের সঙ্গে মেলামেশা। গ্রামে গ্রামে গিয়ে তাদের জীবনযাত্রার খোঁজ নেওয়া। ছবির প্রিমিয়ার শো হলো কলকাতার প্রেস ক্লাবে। উপচে পড়ল ভিড়। অত মুসলিম দর্শক আগে কখনো দেখিনি। শো শেষ হলে আমার সেক্যুলার বন্ধুরা ছি ছি করতে করতে বের হলেন। এ নাকি বড় সাম্প্রদায়িক ফিল্ম! অপরদিকে মুসলিম সমাজ বুকে টেনে নিলেন পরম ভালোবাসায়। আসলে তারা ছবিটি রিলেট করতে পেরেছেন। আমরা অনেকেই যা পারিনি। দু-একজন প্রগতিশীল প্রশ্ন তুললেন, মুসলমানের ছবি অথচ কোথাও বিরিয়ানি বা সুফি গান নেই কেন! তাদের এখনো বোঝাতে পারি না, গ্রাম-বাংলার মুসলমান নবাব-বাদশাহ নয় যে তারা পোলাও-বিরিয়ানি খাবে। সবাই সুফি গান শোনেন না। ওয়াহাবি মতের সঙ্গে সুফি মতের দ্বন্দ্ব আজও রয়ে গেছে, তা পড়শি জনগণের বোধগম্য নয়। মুসলিম সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানসে ভীষণভাবে একমাত্রিক। ফলে মিডিয়া, নাটক, সিনেমায় সাধারণভাবে তারা অদৃশ্য। যেটুকু যা, তা স্রেফ দাড়ি, টুপি বা বোরকা, হিজাব। নাটক, সিনেমায় এখনো মুসলিম চরিত্র বলতেই দেখা যায় ভৃত্য বা সন্ত্রাসী। নায়েব বা জমিদারের খেদমত খাটা ভৃত্য কর্তার মনোরঞ্জনে বেজায় সজাগ। আমার মনে হয়, পুরোনো জমিদারি সংস্কৃতি বংশপরম্পরায় থেকে গেছে বলেই আজও পশ্চিমবঙ্গে কোনো মুসলমানের অন্তত সিনেমার পর্দায় বা নাটকের মঞ্চে জমিদার, নায়ক হয়ে ওঠা হলো না। ভোটের পরদিন কাগজে ছবি বের হয় দলবদ্ধভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের ভোট দিতে আসার। সবাই দাড়ি, টুপি, মেয়েরা বোরকায় আপাদমস্তক ঢাকা। আসলে এ প্রোটোটাইপ চরিত্র নির্মাণের উদ্দেশ্যে মুসলিম সমাজের পিছিয়ে থাকা নিয়ে অনুকম্পা। ভোট দিতে যাওয়ার ছবি দেওয়ার অর্থ হচ্ছে, সে দেশের প্রতি সমর্পিত প্রাণ। মহররম বা ঈদের পর লেখা হয়-শান্তিতে বা নির্বিঘ্নে শেষ হলো মহররম কিংবা ঈদ। যেহেতু মুসলমান সম্প্রদায়, তাই অশান্তি হয়নি সেটাই খবর। মুসলমান আর অশান্তি যেন সমার্থক শব্দ।
আগেই বলেছি, কয়েক বছর আগে আমিও সেভাবে জানতাম না বাঙালি মুসলমানদের যাপন। কলকাতার কালচারাল হাব, কফি হাউজে বসে গোদার, আইজেনস্টাইন, সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন অথবা গ্রামসি নিয়ে কফির কাপে তুফান তুলতাম; কিন্তু সে আলোচনায় মুসলমান তরুণের উপস্থিতি শূন্য। এখনো খোদ কলকাতার এলিট স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে মুসলমান তরুণ-তরুণীকে দুরবিন দিয়ে খুঁজতে হয়। শুধু ছাত্রছাত্রী নয়, অধ্যাপকের সংখ্যাও দু-চারজনের বেশি নয়। ঘটনাচক্রে এখন যেখানে থাকি তা অভিজাত এলাকা। ঝাঁ চকচকে রাস্তা, অত্যাধুনিক শপিংমল, ওয়াটার পার্ক বহুতল, চমৎকার সাজানো-গোছানো রেস্তোরাঁ, কী নেই! অথচ তার দুই কিলোমিটারের মধ্যেই মুসলমান অধ্যুষিত রাজারহাট, শাসন, কামদুনী, বেড়াচাঁপা, বেলেঘাটা, হাড়োয়া নিত্যদিন অন্ধকারে ডুবে থাকে। ডাঙ্গর বা মীনা খাঁর অবস্থাও তথৈবচ। চাঁদরাতে ওইসব এলাকা কোনো এক জাদুমন্ত্রে জেগে ওঠে। মেলা বসে। নাগরদোলা চেপে পরম আনন্দে দোল খায় সদ্য বালিকা। বাংলা গজলের সুর ভেসে আসে এদিক-ওদিক থেকে। নতুন পোশাক কেনার লাইন বাড়তে থাকে পাড়ার দোকানে। এক মাস রোজা শেষের আনন্দ চারপাশে উপচে পড়ে। আকাশে চাঁদের আলো ঢেকে দেয় সারা বছরের সব মালিন্য।
‘মুসলমানের কথা’ করেছিলাম ২০১১ সালে। তখন আমি ছিলাম মুসলমান সমাজের অতিথি। যেটুকু যা জানার, বাইরে থেকেই দেখতাম। ঘরে ঢোকার অনুমতি ছিল না। এখন কিছুটা হলেও অন্দরে ঢোকার অনুমতি পেয়েছি। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গ্রামে পড়শি সমাজ আমাকে হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেছে। যদিও তাদের সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দের কিছুই আজও সেভাবে জানা হয়নি। ওয়াকফ সম্পত্তি কীভাবে লুট হয়েছে, দেখেও কিছু করতে পারি না। মাদ্রাসা বলতেই অনেকের ভাবনায় তা জঙ্গি তৈরির কারখানা। অথচ কত কত মাদ্রাসায় গিয়ে চমৎকার সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখেছি, কত হিন্দু শিক্ষক বরণ করে নিয়েছেন। এসব কত আর বলব? দশ-পনেরো বছরে বাঙালি মুসলমান সমাজে নতুন এক মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম হয়েছে। নতুন নতুন শিক্ষা মিশন গড়ে উঠেছে ব্যক্তিগত উদ্যোগে। তাতে প্রতিবছর অসম্ভব মেধাবী ছাত্রছাত্রী উঠে আসছে। ডাক্তার, সায়েন্টিস্ট, অধ্যাপক, শিক্ষক মুসলিম সমাজে এখন কম নেই। অদ্ভুতভাবে গ্রামে মুসলিম সমাজের মেয়েরা শিক্ষায় এগিয়ে যাচ্ছে ছেলেদের তুলনায়। রাজ্যে চাকরি না থাকায় ছেলেদের বেশির ভাগ অংশ ক্লাস এইট-নাইনে পড়াশোনা বাধ্য হয়ে ছেড়ে দিয়ে কাজের খোঁজে ভারতের অন্যান্য রাজ্যে চলে যাচ্ছেন, উচ্চশিক্ষিত মেয়েরা বিয়ে করতে বাধ্য হচ্ছে অনেক কম লেখাপড়া জানা ছেলেকে। এ নিয়ে সমাজে নতুন এক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানের অর্থ-প্রতিপত্তি বাড়ছে ঠিকই; কিন্তু সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তারা এখনো বাংলাদেশের মুসলিম সমাজের থেকে শত যোজন পিছিয়ে। তবে পশ্চিমবঙ্গের ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ কাঠামোয় মুসলমান নিঃসন্দেহে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। আজও রাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি কোথাও নীতিনির্ধারণে তার কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই।
আপনার মতামত জানানঃ