হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের রঙের উৎসব হোলিকে কেন্দ্র করে ভারতে যে কয়েকটি সাম্প্রদায়িক অশান্তির ঘটনা হয়েছে, তার মধ্যে মহারাষ্ট্রে একটি মসজিদের বাইরের ভিডিওটি নিয়েই সামাজিক মাধ্যমে সব থেকে বেশি আলোচনা হচ্ছে।
বিবিসির সংবাদদাতা রত্নাগিরিতে গিয়ে জানতে পেরেছেন, মসজিদের ফটকে গাছের গুঁড়ি দিয়ে আঘাত করা হচ্ছে বলে যে ভিডিও ছড়িয়েছে, সেটা আসলে বহু যুগ ধরে চলে আসা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একটা প্রথা।
হোলি উৎসবের অঙ্গ হিসাবেই আগের রাতে একটা গাছের গুঁড়ি নিয়ে গিয়ে জ্বালানো হয় এবং শহরের মসজিদের সামনে দিয়ে হিন্দুদের সেই মিছিল যাওয়ার সময়ে তারা মসজিদের সামনে ওই গাছের গুঁড়িটি রাখেন।
মুসলমানদের সঙ্গে কথা বলে আবার তারা এগিয়ে যান বলে বিবিসির সংবাদদাতা ময়ূরেশ কন্নুর জানতে পেরেছেন। তবে পুলিশ এটা স্বীকার করেছে যে গত ১২ই মার্চ ওই মসজিদের সামনে যখন গাছের গুঁড়িটি রাখা হয়, তখন কয়েকজন যুবকের টানাহেঁচড়া হয়েছিল। এই দৃশ্যই ধারণ করে ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে মসজিদের ফটক ভাঙ্গার চেষ্টা হচ্ছে বলে।
মহারাষ্ট্রের ঘটনা ছাড়াও ঝাড়খণ্ডের গিরিডি এবং পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমেও সাম্প্রদায়িক অশান্তি হয়েছে হোলি বা দোল যাত্রার দিনে। ঝাড়খণ্ডের পুলিশ বলছে জুম্মার নামাজ চলাকালীন সেখান দিয়ে হোলির একটি মিছিল যাওয়ার সময় হিন্দু আর মুসলমানদের মধ্যে অশান্তি বাঁধে। পুলিশ ২২ জনকে গ্রেফতার করেছে।
অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের সাঁইথিয়া অঞ্চলে অনেকটা একই ভাবে জুম্মার নামাজের সময়ে হিন্দু আর মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। সেই সময় কয়েকজন আঘাত পেয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে স্থানীয় সূত্রগুলি থেকে।
পুলিশ জানিয়েছে, ওই ঘটনায় ২১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ওই অঞ্চলে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দিয়েছিল সরকার, তবে সোমবার তা আবার চালু করে দেওয়া হয়েছে।
গত ১২ই মার্চ রত্নাগিরি জেলার রাজাপুর গ্রামের ঘটনাই ওই ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখানো হয়েছে বলে বিবিসি জানতে পারে। বিবিসির ময়ূরেশ কন্নুর বলছেন, “ওই ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়ে। অনেক নেতা সামাজিক মাধ্যমে মন্তব্য করেন ঘটনাটি নিয়ে। ভিডিওতে দেখা গেছে যে রাজাপুর গ্রামের জামা মসজিদের সামনে একটি মিছিল আসতে দেখা গেছে। সেখানে কিছু ধর্মীয় ঘোষণা শোনা যায়। এরপরেই দেখা গেছে যে পুলিশ চলে এসেছে – তারা কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছেন।
“সেই সময়ে ওখানে কিছুক্ষণের জন্য উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এরপরে যখন আমি খোঁজ খবর করে জানতে পারি যে রাজাপুর গ্রামটি মহারাষ্ট্রের উপকূলীয় এলাকা – যাকে কোঙ্কন বলা হয়, তার মধ্যেই পড়ে। এখানে এক সপ্তাহ ধরে হোলির উৎসব চলে। মহারাষ্ট্রের অন্যান্য এলাকায় বসবাসকারী কোঙ্কনীরাও এই সময়ে এখানে ফিরে এসে এই উৎসবে অংশ নেন,” জানাচ্ছিলেন ময়ূরেশ কন্নুর।
তিনি এও বলছেন, রাজাপুরে মুসলমানদের সংখ্যাও যথেষ্ট বেশি। তারাও এই হোলির উৎসবে সামিল হন, নিজেদের দায় দায়িত্বও পালন করেন উৎসবের সময়ে।
হোলির আগের দিন ‘হোলি কা দহন’ বলে একটি আচার পালন করা হয়। এখানে গাছের গুঁড়ি, শুকনো পাতা ইত্যাদি জ্বালানো হয়। সেদিন হিন্দুরা ওই হোলির দহনের জন্যই একটি গাছের গুঁড়ি নিয়ে যাচ্ছিল।
মি. কন্নুরের কথায়, “এই রাজাপুর গ্রামের দীর্ঘদিনের প্রথা এটা যে হোলির দহনের জন্য গাছের গুঁড়িটি নিয়ে যাওয়ার সময়ে জামা মসজিদের সামনে হিন্দুরা থামেন। ওই গাছের গুঁড়িটি রাখা হয়। দুই সম্প্রদায়ের মানুষ নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলেন, তারপর হিন্দুদের মিছিল আবার এগিয়ে যায়।”
“সেদিনও এটাই হয়েছিল। তবে কয়েকজনের মধ্যে গাছের গুঁড়িটি নিয়ে টানাটানি হয় – বিষয়টা ছিল কোথায় রাখা হবে সেটা, তা নিয়ে বিবাদ। এরপরেই দেখা যাচ্ছে পুলিশ সেখানে হস্তক্ষেপ করে দুই বিবদমান দলকে আলাদা করে দেয়। ইতিমধ্যে দুই সমাজের নেতারাও হাজির হন সেখানে,” জানিয়েছেন ময়ূরেশ কন্নুর।
এরপর কিছু স্লোগানও দেওয়া হয় সেখানে, কিন্তু ধীরে ধীরে মিছিলটি সরে যায় এবং হোলির উৎসব পালনও করা হয়। পুলিশ বলছে যে তারা এখন এটা তদন্ত করে দেখছে যে ঠিক কী কারণে সেদিন উত্তেজনা ছড়িয়েছিল। পুলিশ সন্দেহ করছে মিছিলের পুরোভাগে থাকা কয়েকজন যুবক নেশাগ্রস্ত অবস্থায় উগ্র আচরণ করে, মসজিদের সামনে গিয়ে স্লোগান দিতে থাকে।
রত্নাগিরির পুলিশ সুপার ধনঞ্জয় কুলকার্নি বিবিসিকে জানিয়েছেন, “কোঙ্কনের হোলি উৎসবের নানা চিরাচরিত প্রথা রয়েছে, যার মধ্যে এই রাজপুর গ্রামের প্রথা হল যে হোলির দহনের জন্য কেটে আনা গাছের গুঁড়িটি মসজিদের দোরগোড়ায় আনা হয় এবং মুসলমানরা হিন্দুদের নারকেল দিয়ে আপ্যায়নও করেন। এরপরে হিন্দুরা নেচে গান গাইতে গাইতে চলে যান।”
“কিছু মানুষ উদ্দেশ্যমূলক ভাবে সেই ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছেন। একটা চিরাচরিত প্রথার ভুল ব্যাখ্যা করবেন না দয়া করে,” বলছিলেন মি. কুলকার্নি।
ঝাড়খণ্ডের পুলিশ বলছে যে গত শুক্রবার হোলির দিন ১৫-১৬ জন হিন্দু ঘোড়থাম্বা চক দিয়ে যাচ্ছিল। সে সময়ে ওখানে মুসলমানরা জুম্মার নামাজ পড়ছিলেন। অন্য দিক দিয়ে হিন্দুদের মিছিলটি নিয়ে যেতে অনুরোধ করা হলে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। দুই পক্ষই একে অপরের দিকে পাথর ছোঁড়ে। কিছু দোকানে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালানো হয়।
সংবাদ সংস্থা পিটিআই পুলিশ কর্মকর্তা রাজেন্দ্র প্রসাদকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, “এলাকায় শান্তি ফিরিয়ে আনতে বড় পুলিশ বাহিনী পাঠানো হয়েছে। এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। তবে নজরদারি চালানো হচ্ছে। ওই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত অভিযোগে ২২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।”
তবে অভিযুক্তের সংখ্যা আরও বেশি। ঘটনার যে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে, সেখানে নাম উল্লেখ করা হয়েছে ৮০ জনের এবং দুই-আড়াইশো অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির কথাও বলা হয়েছে। গিরিডির ঘটনা যখন ঘটছে, সেই একই সময়ে পার্শ্ববর্তী পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বীরভূমেও প্রায় একই ঘটনা ঘটে।
সেখানকার পুলিশ অবশ্য এই ঘটনার কোনও আনুষ্ঠানিক বিবরণ প্রকাশ করে নি। তবে স্থানীয় সূত্রগুলি থেকে জানা যাচ্ছে যে জুম্মার নামাজ পড়ার সময়ে দোল যাত্রার একটি মিছিল যাওয়াকে কেন্দ্র করে বিরোধ শুরু হয়। সেটা গড়ায় সংঘর্ষে।
বিজেপি নেতাদের পোস্ট করা কয়েকটি ভিডিওতে দেখা গেছে যে একটি গ্রামের বেশ কিছু নারী পুলিশ কর্মকর্তাদের সামনে নারী নির্যাতনের অভিযোগ করছেন। এক স্থানীয় সাংবাদিক বলছেন, “এটা নিয়ে যত প্রচার হচ্ছে, তত বড় ঘটনা নয়। ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হচ্ছে।”
এই ঘটনা যাতে প্রকাশ না পায়, সেদিকে কড়া নজর ছিল স্থানীয় প্রশাসনের। তবে কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে বেশ কিছু ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পরে রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর থেকে ১৪ তারিখ রাতেই নির্দেশ জারি করে বীরভূমের কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেয়।
তবে সোমবার আবার তা চালু হয়ে গেছে। অন্যদিকে ঘটনার পরেই সেখানে বড়সড় পুলিশ বাহিনী পাঠানো হয়। বাড়তি সশস্ত্র বাহিনীও মোতায়েন করা হয়েছে। স্থানীয় সূত্রগুলি বলছে বাহিনী উপস্থিত থাকলেও এলাকায় চাপা উত্তেজনাও যেমন আছে, তেমনই স্বাভাবিক ছন্দেও ফিরেছে সেখানকার জনজীবন।
আপনার মতামত জানানঃ