এ সময়ের একটি আলোচিত শব্দ হলো নির্বাচন। এটি বিবেচনায় রেখে তৈরি হয়েছে অনেকগুলো পক্ষ। কেউ নির্বাচন চায়, কেউ চায় না। কেউ আগে চায়, কেউ চায় ধীরেসুস্থে। যারা জেতার সম্ভাবনা বেশি দেখে, তারা রোজই বলছে, শিগগিরই নির্বাচন হোক। যাদের জেতার তেমন সম্ভাবনা নেই, তারা আরও মুখর। এ নিয়ে কথা–চালাচালি আর কাইজা চলছে।
একটা খবরে রাজনীতির বাজার বেশ গরম। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের তরুণেরা নতুন দল তৈরি করছেন। এ নিয়ে কোনো কোনো পুরোনো দল নড়েচড়ে বসছে। তারা মনে হয় ব্যাপারটা ভালোভাবে নিচ্ছে না। হিন্দি সিনেমার একটি জনপ্রিয় গানের কলি মনে পড়ে গেল—মেরে অঙ্গনে মে তুমহারা ক্যায়া কাম হ্যায়?
এখন যে অন্তর্বর্তী সরকার, সেটি ছাত্র আন্দোলনের হাত ধরে এসেছে। সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীতে তাঁদের তিনজন আছেন। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, এখানে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট (স্বার্থের দ্বন্দ্ব) তৈরি হবে? ক্ষমতায় থেকে দল তৈরির এই চেষ্টা (?) ভালোভাবে নেয়নি বিএনপি। তারা সরকারকে নিরপেক্ষ মনে করছে না। তারা বলেছে, এ রকম হলে তারা নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি তুলবে।
এ দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর দুটো মুখ। সরকারে থাকলে তারা একরকম বলে। সরকারের বাইরে গেলে তারা বলে অন্য রকম। বাংলাদেশের জন্মের শুরু থেকেই এ রকম হয়ে আসছে।
মনে আছে, ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে দেশের সংবিধান গৃহীত হলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করেন। গণপরিষদ বিলুপ্ত হলো। তবে শূন্যতা থাকেনি। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আবারও গঠিত হলো নতুন মন্ত্রিসভা। সব মন্ত্রীই ছিলেন আওয়ামী লীগের। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত হলো স্বাধীন বাংলার প্রথম সাধারণ নির্বাচন। মন্ত্রীরা বহাল থেকেই নির্বাচন করলেন। অনেক জায়গায় ভোট দেওয়ার আগে-পরে সন্ত্রাস এবং ফল গণনায় কারচুপি হয়েছিল।
১৯৮০-এর দশকজুড়ে এ দেশে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সব দল সোচ্চার ছিল। ক্ষমতাসীন এরশাদের সামরিক সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে ১৯৮৬ সালে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছিল। ১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে নির্বাচন হলো, তাতে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ও জামায়াতে ইসলামীর লিখিত সমর্থন নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করে। খালেদা জিয়া হন দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী।
একই সঙ্গে তিনি ছিলেন এ দেশের ইতিহাসের প্রথম অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে জয়ী হওয়া প্রথম প্রধানমন্ত্রী। এটি বিএনপির জন্য পরম শ্লাঘার বিষয়। অথচ পরবর্তী নির্বাচনটি তারা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আয়োজনের বিরোধিতা করে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে একতরফা নির্বাচনের একটা খারাপ উদাহরণ তৈরি করেছিল। তাদের সে সরকার দুই মাসের মতো টিকেছিল। তারা সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল আনতে বাধ্য হয়েছিল। নতুন করে আবার নির্বাচন হলে তাতে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে জাতীয় পার্টি ও জাসদের (রব) সমর্থন নিয়ে। শেখ হাসিনা হন প্রধানমন্ত্রী।
আওয়ামী লীগ এখন পলাতক। তাদের পাপের বোঝা এত ভারী যে নিজেদের তারা কোনোভাবেই জায়েজ করতে পারছে না। এখন তারা সওয়ার হয়েছে তাদের পৃষ্ঠপোষক ভারতের ওপর। ভারতের প্রায় সব রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিচ্ছে। কারণ, এ দেশটা তারা ‘হারাতে’ চায় না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দেশ চায় না। তারা চায় ক্ষমতা।
এভাবেই চলছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০১ সালে আবার নির্বাচন হলে বিএনপি ক্ষমতায় ফিরে আসে। একটা বিষয় লক্ষণীয়। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন না হলে একই দল বারবার নির্বাচনে জিততে পারে না। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে বিরোধী দলের জয়ের সম্ভাবনা থাকে। যারা ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চান, এ ব্যবস্থা তাঁদের ভালো লাগে না। নির্বাচনে জয়ের শতভাগ নিশ্চয়তা পেতে শুরু হয় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার বিকৃতি।
২০০৬-০৭ সালে বিএনপিদলীয় রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে একটা যেনতেন প্রকারের তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার আড়ালে নির্বাচন করিয়ে ক্ষমতায় থেকে যেতে চেয়েছিল। এক-এগারোর কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। সে জন্য এক-এগারোর ভূত এখনো তাদের তাড়া করে বেড়ায়। আমার এখনো বিশ্বাস, বিএনপি নির্বাচনকে ম্যানিপুলেটের চেষ্টা না করলে এক-এগারো হতো না। কোনো কিছু স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয় না। তার একটা প্রেক্ষাপট লাগে। এক-এগারোর শর্ত বিএনপি নিজেই তৈরি করেছিল। তাদের ‘ষড়যন্ত্র’কে টপকে গিয়েছিল অধিকতর পাকা খেলোয়াড়দের ‘ষড়যন্ত্র’।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় এল। তারা দেখল, এ তো ভারী মজার খেলা! তারা সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাই দিল তুলে। ফলে নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের হারানোর আর কোনো সুযোগ থাকল না। কিন্তু তাদের পতনের শর্ত তারাই তৈরি করল। তার একটা নিষ্পত্তি দেখলাম ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। কিন্তু এখানেই শেষ নয়।
আওয়ামী লীগ এখন পলাতক। তাদের পাপের বোঝা এত ভারী যে নিজেদের তারা কোনোভাবেই জায়েজ করতে পারছে না। এখন তারা সওয়ার হয়েছে তাদের পৃষ্ঠপোষক ভারতের ওপর। ভারতের প্রায় সব রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিচ্ছে। কারণ, এ দেশটা তারা ‘হারাতে’ চায় না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দেশ চায় না। তারা চায় ক্ষমতা।
নির্বাচন কখন হবে, তা নিয়ে আছে অনিশ্চয়তা। সরকার ও অন্যান্য রাজনৈতিক মহল থেকে পরস্পরবিরোধী কথাবার্তায় ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। বিএনপি একটি বড় দল। আওয়ামী লীগ গর্তে ঢুকে যাওয়ায় মাঠ এখন অনেকটাই তাদের দখলে। নির্বাচন নিয়ে তাদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। ১৮ বছরের অপেক্ষা। আর কত? এর মধ্যে নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী এসে জুটেছে। তরুণেরা নতুন রাজনৈতিক দল করলে তা বিএনপির সামনে একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারে। অভিযোগ উঠেছে, অন্তর্বর্তী সরকার ‘কিংস পার্টি’ তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে, যাতে তারা দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থেকে যেতে পারে।
এ প্রসঙ্গে আমার একটা কথা মনে পড়ে গেল। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসী নীতি নিয়ে অনেকেই সরব। ট্রাম্প সেই সব মার্কিনের প্রতিনিধিত্ব করেন, যাঁরা নতুন অভিবাসী চান না। ব্যাপারটা বেশ মজার। ওই দেশের প্রায় সবাই অভিবাসী। পাঁচ শ বছর ধরে বেশির ভাগ এসেছেন ইউরোপ থেকে। জাতিতে তাঁরা অ্যাংলো-স্যাক্সন। মানেটা দাঁড়াচ্ছে, পুরোনো অভিবাসীরা নতুন অভিবাসী চান না। ‘কিংস পার্টি’ নিয়ে বিএনপি নেতাদের অভিযোগ অনেকটা ওই রকম।
রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে দল বানিয়ে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি পাকিস্তানে প্রথম চালু করেন ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান। বাংলাদেশে সেই ফর্মুলা প্রথম ব্যবহার করেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। তার পরম্পরা বজায় রাখেন জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। মাঝখানে এক-এগারোর সময় জেনারেল মইন ইউ আহমেদ ডিজিএফআইয়ের মাধ্যমে দলছুট বা রাজনীতিতে পরিত্যক্ত ফেরদৌস আহমদ কোরেশী কিংবা জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমকে দিয়ে কিছু একটা করতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মাঠ জমানো যায়নি।
বিএনপি জানে তার জন্ম-ইতিহাস। যদিও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এটি একটি রাজনৈতিক দলের চরিত্র অর্জনে সক্ষম হয়েছিল। তারা একই ফর্মুলায় আরেক প্রতিদ্বন্দ্বীর আবির্ভাব পছন্দ করছে না। রাজনীতি তো আর সেবামূলক কাজ নয়। রাজনৈতিক দল তো আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম নয়।
ক্ষমতার রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা বাড়ুক, এটা কে চায়? রাজনীতির মাঠে নতুন কোনো অক্ষশক্তি তৈরি হোক, এটা বিএনপি চাইবে না। এখন একটা শূন্যতা আছে। এটাই তাদের জন্য সবচেয়ে বড় সুযোগ। যত দিন যাবে, পরিস্থিতি ঘোলাটে হবে। বিএনপি জনপ্রিয়তা হারাতে থাকবে।
রাজনীতি একটা রিলে রেসের মতো। স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে দুর্বৃত্তায়ন হয়েছিল, আওয়ামী লীগাররা ভেগে যাওয়াতে রেসের ব্যাটন এখন বিএনপির লোকদের হাতে। মারামারি, জমি-ব্যবসা দখল, চাঁদাবাজি সমানে চলছে। সব জায়গায় অভিযোগের আঙুল বিএনপির লোকদের দিকে। অনেক জায়গায় দখল বা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে তারা নিজেদের মধ্যেও মারামারি করছে।
গুটিকয় আন্ডারগ্রাউন্ড বা প্রবাসী ফেসবুকার-ইউটিউবার ছাড়া সাধারণ মানুষ আওয়ামী লীগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বিএনপিকেও তারা একই কাতারে ফেলছে বা ফেলবে। বিএনপির জন্য এটি একটি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিতে পারে। এর মধ্যে আবার নতুন এক ‘উপদ্রব’—তরুণদের রাজনৈতিক দল গঠনের ‘পাঁয়তারা’। বিএনপি কি একটা ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছে? লেখক: মহিউদ্দিন আহমদ।
আপনার মতামত জানানঃ