গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন ২৬ বছর বয়সী ইয়াসমিন লাবণী। সেখানে প্রায় তিন হাজার শ্রমিক কাজ করেন। পদ্মা শাতিল আরব ফ্যাশনস লিমিটেড নামে এই কারখানায় তৈরি পোশাক অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ফ্যাশন রিটেইলার কোম্পানি মোজাইকে সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এই মোজাইকের দোষে এখন পথে বসার অবস্থা লাবণীর।
সম্প্রতি এই রিটেইলার নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। অথচ প্রতিষ্ঠানটির কাছে ২৫ লাখ ডলার পাওনা আছে পদ্মা শাতিল আরব ফ্যাশন্স লিমিটেডের। শুধু এই কারখানা নয়, আরও ২২টি কারখানার কাছে মোট ৩ কোটি ডলারের বকেয়া আছে মোজাইকের। এত বিশাল বকেয়ার কারণে লাবণীর মতো হাজার হাজার শ্রমিকের জীবন হুমকির মুখে পড়েছে। অস্ট্রেলিয়ার সংবাদমাধ্যম এবিসি নিউজ এক প্রতিবেদনে তাঁদের ভোগান্তির কথা তুলে ধরেছে।
পোশাকশ্রমিক লাবণী বলেন, ‘দুই সন্তানের মুখে ঠিকমতো খাবার তুলে দিতে পারব কি না—এই চিন্তায় আছি। চিকিৎসার খরচ, দরকারি জিনিস কেনাও কঠিন হয়ে পড়ছে। আমাদের যা বেতন, শুধু তা ই চাই আমরা। না হলে আমাদের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যাবে।’
লাবণী আরও বলেন, ‘মালিক তো আর নিজের পকেট থেকে সবার বেতন দিতে পারবে না, তিনি সর্বোচ্চ কয়েকজনকে দিতে পারেন।’
গত মাসে পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোম্পানি পরিচালনার ভার একাধিক প্রতিষ্ঠানের যৌথ দায়িত্বে ছেড়ে দেয়। কোম্পানিটির এই সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের পোশাক খাতে বিপর্যয় নেমে এসেছে। মোজাইকের কাছে পাওনা প্রায় ৩ কোটি ডলার নিয়ে পরিশোধ নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
পদ্মা স্যাটেল আরব ফ্যাশনসের পরিচালক জাবেদ আহমেদ বলেন, ‘জুন মাস থেকে আমরা বারবার তাঁদের কাছে পাওনা পরিশোধের আহ্বান জানিয়েছি, কিন্তু তাঁরা বিক্রি কমে যাওয়ার অজুহাত দেখিয়েছে। শিগগিরই পাওনা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাকি শিপমেন্ট পাঠিয়ে দিতে বলেছে।’
ফ্যাক্টরি ম্যানেজার মোহাম্মদ আলম মিয়া বলেন, ‘মোজাইক যদি টাকা পরিশোধ না করে, তাহলে অনেকের চাকরি যাবে। তাঁরা সময়মতো পাওনা পরিশোধ করুক— শুধু এটাই চাই।’
হাইড্রোক্সাইড নিটওয়্যারের মালিক ওহমার চৌধুরী বলেন, মোজাইকের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য যোগান দিতে তিনি উৎপাদন বাড়িয়েছিলেন। এমনকি বেশি বেতনে অতিরিক্ত শ্রমিক নিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু তারা দামে বড় ছাড় দিতে বলছে, এটাতো সম্ভব নয়। এটা সম্পূর্ণ প্রতারণা! মোজাইক অবিশ্বাস্য ভণ্ডামি করেছে!
মোজাইকের জন্য পোশাক সরবরাহকারী কারখানা সুলতানা সোয়েটার্সের ম্যানেজার সারওয়ার হোসেন বলেন, মোজাইকের কাছে আমার ১০ লাখ ডলার পাওনা। মাসের পর মাস কর্মীদের বেতন আটকে আছে। ব্যাংকগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত কারখানাগুলোকে ঋণ দিতে চাচ্ছে না। এই পরিস্থিতি সহ্য করার মতো না। মজুরি ছাড়াও কাঁচামাল, বিদ্যুৎ, পরিবহন ও অন্যান্য খরচের বিষয়েও চিন্তায় পড়ে গেছেন তারা।
গত বছর থেকে মোজাইকের পাওনা আটকে থাকা শুরু হয়। তবুও অর্ডার পূরণে পোশাক পাঠিয়েছেন তারা। সেটি বেশ বড় ভুল সিদ্ধান্ত ছিল বলে মনে করেন সারওয়ার হোসেন। তিনি বলেন, মোজাইকের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখতে এবং বড় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে খ্যাতি ধরে রাখতে এবং দায়িত্ব ঠিকমতো চালিয়ে যেতে এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। পাওনা পরিশোধের বিষয়ে আবারও চাপ তৈরির প্রয়োজনে পণ্য পাঠাতে হয়েছিল।
মোজাইক কোম্পানির অধীনে ৯টি ফ্যাশন ব্র্যান্ড আছে। এগুলোর মধ্যে গত সেপ্টেম্বরে রকম্যানস, অটোগ্রাফ, ডব্লিউ. লেন, ক্রসরোডস ও বেমের কার্যক্রম বন্ধ ও পুনর্গঠনের ঘোষণা দেয় মোজাইক। বাকি ব্র্যান্ডগুলোতে বিনিয়োগ অব্যাহত থাকবে বলে জানায় তারা।
মোজাইকের নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এরিকা বার্চটোল্ড বলেন, ‘এখন আমাদের পূর্ণ মনোযোগ থাকবে প্রধান ব্র্যান্ডগুলোর দিকে। গ্রাহক সেবা ও নতুন গ্রাহক আকর্ষণই হবে মূল লক্ষ্য। দেউলিয়া অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ঋণদাতাদের সঙ্গে বৈঠক চলছে। কোম্পানি কার্যক্রম পুনর্গঠন করতে এবং কোম্পানির টেকসই পরিস্থিতি মূল্যায়নের কাজও অব্যাহত আছে।’
পোশাক সরবরাহকারীরা এবিসি নিউজকে জানান, মোজাইকের আগ্রাসী বাণিজ্য কৌশল কোম্পানিটির ব্যর্থতা ও সমস্যাগুলোকে আরও প্রকট করে তুলেছে। এ বিষয়ে মোজাইকের পরিচালনার দায়িত্বে থাকা এফটিআই কনসালটিংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো সাড়া মেলেনি।
মোজাইক দেউলিয়া ঘোষণার পর তাদের মুখপাত্র হিসেবে কেপিএমজি এবিসি নিউজকে একটি ইমেইলে জানায়, মোজাইক তাদের কার্যক্রম স্থিতিশীল করতে সব সরবরাহকারীদের সঙ্গে কাজ করছেন। এক্ষেত্রে বাণিজ্যিক শর্ত পুনঃস্থাপনের সুযোগ থাকতে পারে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, কোভিড মহামারি ও সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে বিপর্যস্ত পোশাক শিল্পের জন্য এটি বড় ধাক্কা। মোজাইকের বিষয়ে অস্ট্রেলিয়া হাই কমিশন বিজিএমইএকে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।
বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, অস্ট্রেলিয়ার ভাবমূর্তি ঝুঁকির মুখে। দেশটির হাইকমিশনে একাধিকবার বিষয়টি উত্থাপন করা হলেও অস্ট্রেলিয়ান ব্র্যান্ড পাওনা পরিশোধ করেনি। এভাবে দায় এড়িয়ে যাওয়ায় দেশটির মান কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? মোজাইক দাবি করে তারা শ্রমিকদের কল্যাণ নিয়ে ভাবে কিন্তু তারা পণ্য নিয়ে পাওনা পরিশোধ করছে না এবং এ নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া যাচ্ছে না। তারা দায়বদ্ধতা এড়িয়ে যাচ্ছে।
তৈরি পোশাক শিল্প খাত থেকে প্রতি বছর ৩৪ বিলিয়ন ডলার আয় করে বাংলাদেশ, যা দেশের রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশ। এশিল্পে কর্মরত আছে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক।
বৈশ্বিক উন্নয়ন সংস্থা অক্সফাম অস্ট্রেলিয়া বলছে, মোজাইকের বকেয়া পরিশোধ না করার এই ঘটনা আমাদের সামনে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে চলমান শোষণের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে।
আপনার মতামত জানানঃ