দুই যুগের মধ্যে গত বছর ডেঙ্গু সব রেকর্ড ভেঙে দেয়। মশাবাহিত রোগটিতে মারা যান ১ হাজার ৭০৫ জন; হাসপাতালে ভর্তি হন প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষ। অথচ আগের ২৩ বছরে ডেঙ্গুতে প্রাণহানি ছিল ৮৬৮ জন। প্রিয়জন হারিয়ে ঘরে ঘরে মাতমের মধ্যে ওই বছরের মাঝামাঝি আশার আলো দেখায় ভাইরাসটি শনাক্তে র্যা পিড অ্যান্টিজেন কিট উদ্ভাবনের ঘোষণা।
বাংলাদেশ রেফারেন্স ইনস্টিটিউট ফর কেমিক্যাল মেজারমেন্টসের (বিআরআইসিএম) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মালা খানের নেতৃত্বে কিটটি উদ্ভাবন হয়। ঘটা করে তিনি কিটের সংবেদনশীলতা শতভাগ সঠিক এবং কোনো ভুল রিপোর্ট দেননি দাবি করেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন কিটের কার্যকারিতার পক্ষে সাফাই গান। তবে সমকালের অনুসন্ধানে কিট উদ্ভাবন নিয়ে বেরিয়ে এসেছে ভয়াবহ জালিয়াতির তথ্য।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কিটটি ডেঙ্গু ভাইরাস শনাক্তে শতভাগ কার্যকর নয়। দেশীয়ভাবে উদ্ভাবনও করা হয়নি। চীন থেকে কাঁচামাল এনে বাজার থেকে দেশীয় উপকরণ কিনে সংযোজন হয়েছে। এখানে নতুন উদ্ভাবনের কিছু নেই। এমনকি কিটের সক্ষমতা যাচাইয়ে সে সময় যে তিন ল্যাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়, তাদের মূল্যায়নেও ডেঙ্গু ভাইরাস শনাক্তে এর কার্যকারিতা মেলেনি। ব্যক্তিগত সখ্যের কারণে তৎকালীন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান ১৪৫ কোটি টাকার প্রকল্পটি মালা খানকে দেন। এমনকি তাঁর সহযোগিতায় কিটটি চলতি বছর ‘শ্রেষ্ঠ উদ্ভাবনী উদ্যোগ’ নির্বাচিত হয়।
কিট উদ্ভাবনে জড়িত নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিআরআইসিএমের এক কর্মকর্তা জানান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমানের সহযোগিতায় ১৪৫ কোটি টাকার প্রকল্প পেতে ডেঙ্গু কিট উদ্ভাবনের নাটক সাজানো হয়। মালা খান কিট উদ্ভাবন নিয়ে যেসব তথ্য গণমাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন, সবই ভিত্তিহীন।
বিআরআইসিএমের একাধিক কর্মকর্তা জানান, দেশে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, হেপাটাইটিস-বি, ম্যালেরিয়া, কভিডসহ বিভিন্ন রোগ শনাক্তের কিট আমদানি করতে হয়। এ প্রবণতা কমাতে দেশীয়ভাবে কিট উৎপাদনে ১৪৫ কোটি টাকার প্রকল্প নেয় সরকার। ইয়াফেস ওসমানের সঙ্গে বিশেষ সখ্য থাকায় মালা খানের নেতৃত্বে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা হয়। এর পর প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদনে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয় এবং গত বছরের ১৩ নভেম্বর প্রকল্প প্রস্তাবের ওপর পরিকল্পনা কমিশনে মূল্যায়ন কমিটির সভাও হয়। কিন্তু ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন হওয়ায় সব ভেস্তে গেছে।
সূত্র জানায়, গত বছর যে তিন ল্যাবের মূল্যায়ন প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে মালা খান কিটের সংবেদনশীলতা শতভাগ প্রমাণিত ঘোষণা করেন, সম্প্রতি প্রতিবেদনগুলো সমকালের হাতে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, র্যা পিড কিটটির ভাইরাস শনাক্তের কার্যকারিতা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ের নয়।
প্রথমে কিটটি আইসিডিডিআর,বিতে পরীক্ষা করা হয়। এখানে মাত্র পাঁচটি পরীক্ষা করা হয়। মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিআরআইসিএমের র্যারপিড কিট ডেঙ্গু ভাইরাস শনাক্তে গ্রহণযোগ্য ফলাফল দিচ্ছে না। কিছু কিটে এক ধরনের সাদা দাগ দেখা দিচ্ছে, যা ফলাফল ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ব্যবহারকারীকে বিভ্রান্ত করে।
কিটটি পরীক্ষার সঙ্গে জড়িত আইসিডিডিআর,বির এক বিজ্ঞানী বলেন, ব্রিকম দাবি করলেও তাদের ডেঙ্গু কিট কোনো উদ্ভাবনের মধ্যে পড়ে না। এর কাঁচামাল চীন থেকে আনা এবং বাকি উপকরণ দেশীয় বাজারের। সব একসঙ্গে সংযোজন করা হয়েছে, এটি চাইলে যে কেউ করতে পারে।
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের ল্যাব মূল্যায়ন প্রতিবেদনেও কিটের গ্রহণযোগ্য ফল মেলেনি। বলা হয়েছে, কিটের মান উন্নয়ন ও বৃহৎ পরিসরে গবেষণা করতে হবে। একইভাবে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন এবং রেফারেল সেন্টারের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মালা খানের কিট ডেঙ্গু শনাক্তে শূন্য শতাংশ কার্যকর। অথচ তড়িঘড়ি করে মালা খানের কিট শর্তসাপেক্ষে অনুমোদন দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।
কিটটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে বিক্রির পরিকল্পনা ছিল মালা খানের। গত মে মাসে এক সেমিনারে কিটের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। সে সময় সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন কার্যকারিতার বিষয়ে নিশ্চয়তা দিয়ে কেনার আশ্বাস দেন।
কিটের কাঁচামাল আনে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান শিকদার এন্টারপ্রাইজ। মালা খানের সঙ্গে সখ্য থাকায় বিআরআইসিএমের বেশির ভাগ কাজ পেয়ে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। কিটের কাঁচামাল আনার মতো পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও তাদের কাজটি দেওয়া হয়।
শিকদার এন্টারপ্রাইজের কর্ণধার আউয়াল শিকদার বলেন, ‘বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মালা খানের নির্দেশনায় চীন থেকে কিটের কাঁচামাল আনা হয়। আমার প্রতিষ্ঠানের কোনো অফিস নেই। পরিচিতদের অনুরোধে কিছু কাজ করে থাকি। মালা খান আমার পূর্বপরিচিত।’
অভিযোগের বিষয়ে মালা খান সমকালকে বলেন, ‘কোনো উদ্ভাবনই শুরুতে শতভাগ কার্যকর ফলাফল দেয় না। এ জন্য দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা প্রয়োজন। তিন ল্যাবের মূল্যায়ন প্রতিবেদনের সুপারিশ আমলে নিয়ে কিটের মানোন্নয়নে কাজ করছি।’ ২০২৩ সালে কেন শতভাগ কার্যকর বলেছিলেন– প্রশ্নে মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
আপনার মতামত জানানঃ