ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য থেকে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের অন্য অংশে বিদ্যুৎ নিতে ৭৬৫ কেভি বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করতে চায় নয়াদিল্লি। আর এ সঞ্চালন লাইন নির্মাণে কারিগরি এ আর্থিক বিবেচনায় বাংলাদেশের সঞ্চালন প্রতিষ্ঠান পাওয়ার গ্রিডের কোনো প্রয়োজন না হলেও ভারতের স্বার্থ রক্ষায় একতরফাভাবে পাওয়ার গ্রিডের মাধ্যমে কাজ করার সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
ভারতের প্রয়োজনে বাংলাদেশ অংশে সঞ্চালন লাইন স্থাপনে বাংলাদেশের ওপর ছয় হাজার থেকে সাত হাজার কোটি টাকার ঋণের বোঝা চাপবে। এ বিষয়ে শেখ হাসিনা সরকারের শেষ সময়ে ১৮ থেকে ২১ জুলাই ভারতে অনুষ্ঠিত এ-সংক্রান্ত যৌথ স্টিয়ারিং কমিটির সভায় এককভাবে সম্মতি দিয়ে এসেছেন খোদ বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সৈয়দ মাসুম আহমেদ চৌধুরী।
বিদ্যুৎ বিভাগের এক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, ভারতের প্রয়োজনে ভারতের বরনগর হতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পার্বতীপুর হয়ে ভারতের অপর অংশ কাতিহারে ৭৬৫ কেভি সঞ্চালন লাইন স্থাপন করার উদ্যোগ নেয় নয়াদিল্লি। ২০১৬ সালে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।
কিন্তু কারিগরি ও আর্থিক বিবেচনায় এ সঞ্চালন লাইন স্থাপনে বাংলাদেশের কোনোই প্রয়োজন নেই। কারণ আদানি থেকে প্রায় এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেও প্রায় আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। এ জন্য আলাদা আলাদা সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে। ফলে এ অঞ্চলে আলাদা আরেকটি সঞ্চালন লাইন স্থাপনের তেমন কোনোই প্রয়োজন নেই। আর এ কারণে বাংলাদেশ থেকে এ সঞ্চালন লাইন স্থাপনে কালক্ষেপণ করা হচ্ছিল।
প্রথমে সিদ্ধান্ত ছিল এ সঞ্চালন লাইনের কাজ ভারত নিজেই করবে। কিন্তু পরবর্তীতে বাংলাদেশ ভারত যৌথ কোম্পানি গঠন করে ওই কোম্পানির মাধ্যমে এ সঞ্চালন লাইন নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। গত ২০২৩ সালের মে মাসে বাংলাদেশ-ভারতের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত দুই দেশের বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতাসংক্রান্ত যৌথ স্টিয়ারিং কমিটির সভায় এমন সিদ্ধান্ত হয়।
কমিটির ২১তম এ সভা অনুষ্ঠিত হয় খুলনায়। ওই সময় সিদ্ধান্ত হয়, দুই দেশের সঞ্চালন কোম্পানির অংশীদারিত্বে একটি যৌথ বিদ্যুৎ সঞ্চালন কোম্পানি গঠিত হবে। তারা ভারতের কাতিহার থেকে বাংলাদেশের পার্বতীপুর হয়ে আবার দেশটির বরানগর পর্যন্ত ৭৬৫ কেভির (কিলোভোল্ট) বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, চাহিদা না থাকায় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জলবিদ্যুৎ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারছে না দেশটি। বিদ্যুৎ করিডোর পেলে ভারতের এ অংশের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ অপর অংশে নেয়া সহজ হবে। তাই দেশটি দীর্ঘ দিন ধরে এ বিষয়ে বাংলাদেশের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এ বিদ্যুৎ মূলত নদীতে বাঁধ দিয়ে উৎপাদন করা হবে, যাতে ভাটির দেশ বাংলাদেশে পানির প্রবাহ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিদ্যুৎ বিভাগের কিছু কর্মকর্তা ভারতের স্বার্থ রক্ষার জন্য বরাবরই মরিয়া ছিলেন। বিদ্যুৎ সিস্টেমকে ধ্বংস করার এজেন্ডা বাস্তবায়নের সব সময়ই সোচ্চার ছিলেন তারা। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সৈয়দ মাসুম আহমেদ চৌধুরী।
তাকে সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের মহাপরিচালক হিসেবে জনপ্রশাসন থেকে আদেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি বহাল তবিয়তেই বিদ্যুৎ বিভাগে পড়ে রয়েছেন। এর আগেও তাকে এনআইডি প্রকল্পের ডিজি করা হয়েছিল। তিনি নানাজনের কাছে তদবির করে জনপ্রশাসনের এ আদেশ বাতিল করেছিলেন।
পিজিসিবি এক সমীক্ষা করেছে, ৭৬৫ কেভি সঞ্চালন লাইন স্থাপনে প্রতি কিলোমিটারের জন্য ব্যয় হবে প্রায় ৩ মিলিয়ন ডলার। প্রায় ৩০০ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপনে ব্যয় হবে ৯০০ মিলিয়ন বা ৯০ কোটি ডলার; যা স্থানীয় মুদ্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ওপরে। ভারতের প্রয়োজনে এ লাইন স্থাপনে এক্সিম ব্যাংক অব ইন্ডিয়া এ অর্থ ঋণ দেবে। বাংলাদেশকে ঋণের দায় বহন করতে হবে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ-ভারত যৌথ স্টিয়ারিং কমিটিতে বাংলাদেশ অংশে তিনজন সদস্য রয়েছেন। তার মধ্যে অন্যতম হলেন সৈয়দ মাসুম আহমেদ চৌধুরী। অভিযোগ রয়েছে পাওয়ার গ্রিডের সঞ্চালন সিস্টেমকে (পাওয়ার গ্রিডের জন্য ক্ষতিকারক হলেও) ভারতের চাহিদা মোতাবেক তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে দীর্ঘ দিন ধরে ভারতের স্বার্থ রক্ষার্থে কাজ করছিলেন তিনি।
পাওয়ার গ্রিডের কারিগরি মতামত উপেক্ষা করে এবং ৭৬৫ কেভি বরনগর (ভারত)-পার্বতীপুর (বাংলাদেশ)-কাতিহার (ভারত) সঞ্চালন লাইন নির্মাণে কারিগরি ও আর্থিক বিবেচনায় পাওয়ার গ্রিডের কোনো প্রয়োজন না হলেও পাওয়ার গ্রিডের মাধ্যমে কাজটি সম্পন্ন করার একতরফা সিদ্ধান্ত ভারতকে দিয়ে এসেছে ভারতে অনুষ্ঠিত গত ১৮-২১ জুলাই যৌথ স্টিয়ারিং কমিটির (ঔঝঈ/ঔডএ) সভায়। এ জন্য কোনো প্রকার কারিগরি স্টাডি সম্পন্ন করা হয়নি।
এতে বাংলাদেশের পক্ষে তিনজন সদস্য স্বাক্ষর করার কথা থাকলেও তিনি একতরফাভাবে একাই প্রাথমিক এ সিদ্ধান্ত স্বাক্ষর করে এসেছেন। বাংলাদেশকে করিডোর হিসেবে ব্যবহার করে ভারতের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে বিদ্যুৎ সঞ্চালন করতে এ সঞ্চালন লাইনটি প্রথমে ভারত তাদের নিজস্ব টাকায় করতে রাজি থাকলেও আলোচ্য সভায়
এ কাজটি পিজিসিবি করবে বলে সিদ্ধান্ত দিয়ে আসেন এই কর্মকর্তা। এটা পিজিসিবিকে দেউলিয়া হিসেবে প্রমাণ করার প্রচেষ্টা এবং প্রাইভেট কোম্পানিকে দেয়ার প্রচেষ্টা মাত্র বলে উল্লেখ করেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে সৈয়দ মাসুম আহমেদ চৌধুরীর বক্তব্য নিতে গতকাল সন্ধার পর কয়েক দফা ফোন করেও তার কোনো বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি
আপনার মতামত জানানঃ