পিলখানা হত্যাকান্ডের নেপথ্যে দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্র ছিলো। এ হত্যাকান্ড অপারেশন ডালভাতের জন্য হয়নি। এটি একটি দীর্ঘ পরিকল্পনার অংশ। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন।
এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক। এছাড়া এ ঘটনায় সহযোগিতা করেছেন আওয়ামী লীগের বেশ কিছু নেতা। ভারতের মদদে পিলখানা হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশকে ভারতের অঙ্গরাজ্য বানানোর উদ্দেশ্যে এই হত্যাকাণ্ড। এই হত্যাকান্ডের পরিকল্পনায় যুক্ত ছিল দেশের কিছু বিশ্বাসঘাতক, ছিল ভারতের চক্রান্ত।
বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন সাবেক সেনা কর্মকর্তারা। পিলখানা হত্যাকাণ্ড নিয়ে সেনাবাহিনীর তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের বিষয়ে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) আবদুল মতিন আরও বলেন, এই হত্যাযজ্ঞের রেশ ধরেই এসেছে ৫ মে শাপলা চত্বরের গণহত্যা, ভোটারবিহীন নির্বাচন, শিক্ষা ব্যবস্থা-বিচার ব্যবস্থা ধ্বংস, দুর্নীতির মহোৎসব, গুম-খুনের অবাধ রাজত্ব। এ ঘটনায় অনেকে চাকরি হারান, অনেকে পদোন্নতি বঞ্চিত হন। সঠিক তদন্তের মাধ্যমে এই হত্যাযজ্ঞের বিচার না করা হলে এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় না আনা হলে ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে পাওয়া নতুন স্বাধীনতা মুখ থুবড়ে পড়বে।
সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, বিডিআর হত্যাকা-ের আগে ১৩ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টায় রাজধানীর বনানীতে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ সেলিমের বাসায় বিডিআরের ডিএডি হাবিব, ডিএডি জলিল, ল্যান্সনায়েক রেজাউল, হাবিলদার মনির, সিপাহি সেলিম, কাজল, শাহাবউদ্দিন, একরাম, আইয়ুব, মঈন, রুবেল, মাসুদ, শাহাদত ও জাকির (বেসামরিক) বৈঠক করেন। এর আগে-পরেও বিডিআর সদস্যরা বেশ কয়েকটি বৈঠক করেন। সুবেদার গোফরান মল্লিক নবীন সৈনিকদের উদ্দেশ্যে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন পিলখানার ভেতরে গেলেও সেনা কর্মকর্তাদের কোন খবর নেননি। সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ জড়িতদের পালাতে সহায়তা করেছেন। নানাভাবে খুনীদের সহযোগিতা করেছেন রাজনৈতিক নেতা হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরী, মির্জা আজম, ব্যারিষ্টার ফজলে নুর তাপস, জাহাঙ্গীর কবির নানক, এমপি রেজা, ওয়ারসেত হোসেন বেলালসহ অনেকেই।
মেজর জেনারেল (অব.) আবদুল মতিন বলেন, ২০০৮ সালের ১৭-১৮ ডিসেম্বর ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসের বাসাতেও হাবিলদার মনির, সিপাহি শাহাব, সিপাহি মনির বৈঠক করেন। নির্বাচনের আগের দিন সন্ধ্যায় বিডিআর দরবার সংলগ্ন মাঠে সিপাহি কাজল, সেলিম, মঈন, রেজা এবং বেসামরিক ব্যক্তি জাকিরসহ কয়েকজন বৈঠক করেন।
সেনা তদন্ত কমিটি নানারকম বাধার মুখে পড়ে এবং সংশ্লিষ্ট অনেক সংস্থা ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের’ নির্দেশনার কথা বলে সহযোগিতা করা থেকে বিরত থাকে। ওই তদন্ত কমিটির চেয়েছিল হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কারা জড়িত, কাদের পরিকল্পনায় হয়েছে তা পরিষ্কার করতে। কিন্তু তদন্তে তারা কারো সহযোগিতা পাননি। বিশেষ করে সামরিক গোয়েন্দা পরিদপ্তর ( ডিজিএফআই), র্যাপিড একশন ব্যাটেলিয়ান (র্যাব) জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই)সহ অনেক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সহযোগিতা করেনি। র্যাবের সাবেক ডিজি হাসান মাহমুদ খন্দকারও কোন সহযোগিতা করেননি। এছাড়া সাবেক ডিজিএফআই প্রধান লে. জেনারেল মোল্লা ফজলে আকবর, সাবেক জেনারেল আজিজ, সাবেক লে. জেনারেল সোহরাওয়ার্দী, সাবেক মেজর জেনারেল মঈন ও সাবেক মেজর জেনারেল রেজা নুর নানাভাবে সেনা তদন্ত কমিটিকে অসহযোগিতা করেছেন। সাংবাদিক মুন্নি সাহা সংবাদ প্রকাশ করে দ্রুত খবর ছড়িয়ে দেন। তদন্তের নামে প্রহসন করেন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা আবদুল কাহার আকন্দ।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, হত্যাকাণ্ডের অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলামত নষ্ট করা হয়েছে। বিশেষ করে বিডিআর বিদ্রোহের পর সাবেক মহাপরিচালক প্রয়াত মেজর জেনারেল শাকিলের সরকারি বাসায় ওঠেন নতুন মহাপরিচালক। তারপর নতুন মহাপরিচালক অনেক আলামত নষ্ট করে। সেনাবাহিনী কর্তৃক তদন্ত কমিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা যখন সঠিক তদন্ত শুরু করেন এবং সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহ করার চেষ্টা করেন তখন ওই তদন্ত কমিটির অনেক কর্মকর্তাকে বিনা নোটিসে চাকরিচুত করা হয়। কাউকে কাউকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। এই হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত এবং পরিকল্পনায় যুক্ত কিছু সেনা কর্মকর্তাকে সর্বোচ্চ সুবিধা দিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব) তারিক আহমেদ সিদ্দিকীসহ কিছু সেনা কর্মকর্তার সহযোগিতা ছিল। তারা প্রত্যেকে আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে সুবিধা পেয়েছে। বিডিআর বিদ্রোহের নামে হত্যাকা-ের মূল নেতৃত্বে ছিল ৪০ রাইফেলস ব্যাটেলিয়ন। ওই ব্যাটেলিয়ানের সিও ছিলেন সেনাবাহিনী ১৪ লং কোর্সের লেফটেন্যান্ট কর্নেল সামস। এ হত্যা কাণ্ডের সময় তার ভূমিকা ছিল রহস্যজনক।
সংবাদ সম্মেলনে আরো জানানো হয়, কথিত বিদ্রোহের প্রথম দিন ২৫ ফেব্রুয়ারি যখন পিলখানায় গোলাগুলি শুরু হয়, তখন ভেতরে আটকে থাকা সেনা কর্মকর্তাদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের উদ্ধারে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো দল অভিযান করতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের অভিযান পরিচালনা করতে দেওয়া হয়নি উপরের নির্দেশে। সেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কারা তা পরিষ্কার করা হয়নি।
হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের একটি গ্রুপকে বিমানে করে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই গ্রুপটিতে কারা ছিল তাদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। পিলখানায় হত্যাকান্ডের সময় আশেপাশের বাসা বাড়ির লোকজন মোবাইলে কিছু ভিডিও ধারণ করেছিলেন। সেই ফুটে যে হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অনেকেরই ছবি এবং কর্মকাণ্ড প্রমাণ ছিল। তৎকালীন ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালকের নির্দেশে মাঠ পর্যায়ে সদস্যরা সেই ফুটেজ বাসায় বাসায় গিয়ে ডিলিট করে দেয়। পিলখানার ভেতর অনেক আলামত নষ্ট করে ফেলা হয়। সূত্র: ইত্তেফাক।
আপনার মতামত জানানঃ