বিজ্ঞানের একেবারে মৌলিক শাখা হলো পদার্থবিজ্ঞান। বিজ্ঞানের এমন কোনো শাখা নেই, যেখানে পদার্থবিজ্ঞানের ভূমিকাকে গৌণ করা যায়। মানুষের রোগনির্ণয় ও চিকিৎসায় পদার্থবিজ্ঞানের অবদান অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। সবচেয়ে সরল যে যন্ত্রটি রোগনির্ণয়ে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়, তার নাম থার্মোমিটার।
মানুষের শরীরের স্বাভাবিক কাজকর্ম বাধাগ্রস্ত হলে শরীরের তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ধরা হয় ৯৮ দশমিক ৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শিশুদের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা এর চেয়ে কিছুটা বেশি থাকে।
শরীরের তাপমাত্রা ৯৯ বা ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট হয়ে গেলে আমরা অনেক সময় খুব বিচলিত হয়ে পড়ি। কিন্তু চিকিৎসকেরা তিন মাসের কম বয়সী শিশুদের শরীরের তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট কিংবা তিন মাসের বেশি বয়সী শিশুদের শরীরের তাপমাত্রা ১০১ ডিগ্রি ফারেনহাইট হলেও তাকে স্বাভাবিক বলে ধরে নেন।
চিকিৎসকেরা জানেন যে শরীরের তাপমাত্রার পরিবর্তনটা রোগ নয় বটে, কিন্তু অন্য কোনো রোগের কারণ। রোগের কারণ শনাক্ত করার জন্য চিকিৎসকেরা আগে দেখে নেন শরীরের তাপমাত্রার কোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন হয়েছে কি না।
মানুষ তাপ ও তাপমাত্রা মাপার চেষ্টা শুরু করেছিল হাজার বছর আগে। আজ থেকে ১ হাজার ৮৫০ বছর আগে ১৭০ খ্রিষ্টাব্দে গ্রিক বিজ্ঞানী গ্যালেন সর্বপ্রথম থার্মোমিটার তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাপ কী, কেন তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটে ইত্যাদি মৌলিক বিষয় সম্পর্কে সঠিক ধারণা ছিল না তখন কারও।
তার পরের প্রায় দেড় হাজার বছরে তাপমাত্রা মাপার ব্যাপারে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। স্পর্শের মাধ্যমে তাপমাত্রার তারতম্য নির্ণয় করা গেলেও তাপমাত্রার সঠিক পরিমাপের কোনো কার্যকর পদ্ধতি আবিষ্কার করা যায়নি ১৫৯৩ সাল পর্যন্ত।
সে সময় গ্যালিলিও তাপমাত্রা বাড়লে বাতাসের আয়তন বেড়ে যাওয়ার ধর্মকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করলেন একধরনের বাতাসভরা থার্মোস্কোপ। এটা দিয়ে বাতাসের তাপমাত্রার বাড়া-কমা পর্যবেক্ষণ করা যায়, কিন্তু তাপমাত্রার সঠিক পরিমাপ করা গেল না। আসলে তখনো তাপমাত্রার কোনো একক নির্ধারিত হয়নি।
১৬১২ সালে আরেকজন ইতালিয়ান বিজ্ঞানী সান্তোরিও থার্মোস্কোপের সঙ্গে একটি আনুপাতিক স্কেল যোগ করে মানুষের শরীরের তাপমাত্রা পরিমাপ করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এর প্রায় ৪০ বছর পর ১৬৫৪ সালে ইতালির তাসকানির গ্র্যান্ড ডিউক দ্বিতীয় ফার্দিনান্দ প্রথম একটি থার্মোমিটার তৈরি করেন।
এর মূল গঠন ও কার্যপ্রণালি আধুনিক থার্মোমিটারের মতো। তাপ দিলে অ্যালকোহলের আয়তন বেড়ে যায়। অ্যালকোহলের এই ধর্মকে কাজে লাগিয়ে তিনি একটি কাচের চোঙের মধ্যে অ্যালকোহল রেখে তাপমাত্রার পরিবর্তনের সঙ্গে অ্যালকোহলের আয়তনের পরিবর্তনের হারকে তাপমাত্রা মাপার কাজে লাগান। তিনি অ্যালকোহলের চোঙায় ৫০টি সমান দাগ দিয়ে তাপমাত্রার এককের নাম দেন ‘ডিগ্রি’। কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট তাপমাত্রার সঙ্গে এই ডিগ্রির সমন্বয় না থাকার কারণে ফার্দিনান্দের থার্মোমিটারে তাপমাত্রার পরিমাপ ছিল অনুমাননির্ভর।
এর ১০ বছর পর ১৬৬৪ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী রবার্ট হুক থার্মোমিটারে শূন্য ডিগ্রির প্রচলন শুরু করেন। যে তাপমাত্রায় পানি জমাট বেঁধে বরফে পরিণত হয়, সেই তাপমাত্রাকে শূন্য ডিগ্রি ধরে নিয়ে হিসাব কষতে শুরু করেন তিনি। থার্মোমিটারের অ্যালকোহলের আয়তনকে সমান ৫০০ ভাগে ভাগ করে শূন্য থেকে ৫০০ ডিগ্রি পর্যন্ত তাপমাত্রা মাপার ব্যবস্থা করেন।
কিন্তু তখনো ডিগ্রি বলতে ঠিক কতটুকু তাপমাত্রা, তা নির্দিষ্ট করা যায়নি। ১৭০১ সালে স্যার আইজাক নিউটন একটি থার্মোমিটার তৈরি করেন, যা ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে আধুনিক এবং সার্থক থার্মোমিটার। তিনি কাচের সরু নলের মধ্যে কিছু তেল প্রবেশ করিয়ে নলের বাকি অংশ থেকে বাতাস বের করে নলটির দুই মাথা বন্ধ করে দেন। তারপর তিনি থার্মোমিটারের স্কেল তৈরি করেন।
পানির গলনাঙ্কের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা আর মানুষের শরীরের তাপমাত্রাকে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ধরে নিয়ে এই দুই তাপমাত্রার পার্থক্যকে অনেকগুলো ভাগে ভাগ করেন। বলা যায় প্রথম সার্থক থার্মোমিটার তৈরি হয় স্যার আইজাক নিউটনের হাত দিয়ে।
এর ১০ বছর পর ১৬৬৪ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী রবার্ট হুক থার্মোমিটারে শূন্য ডিগ্রির প্রচলন শুরু করেন। যে তাপমাত্রায় পানি জমাট বেঁধে বরফে পরিণত হয়, সেই তাপমাত্রাকে শূন্য ডিগ্রি ধরে নিয়ে হিসাব কষতে শুরু করেন তিনি
১৭০২ সালে ডেনমার্কের গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী ওলে রোমার তাপমাত্রার প্রথম ‘স্কেল’ চালু করেন। সেটাই পরে তাপমাত্রার রোমার স্কেল নামে পরিচিতি লাভ করে। রোমার গলন্ত বরফের তাপমাত্রাকে ৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি, আর ফুটন্ত পানির তাপমাত্রাকে ৬০ ডিগ্রি ধরে তাঁর থার্মোমিটার তৈরি করেন। ১৭১৪ সালে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল গ্যাব্রিয়েল ফারেনহাইট রোমারের স্কেলকে পরিবর্তন করে নতুন স্কেলের প্রবর্তন করেন।
সেটাই তিন শ বছর ধরে আমরা ব্যবহার করছি—ফারেনহাইট স্কেল। ফারেনহাইট বরফ, লবণ ও পানির মিশ্রণের তাপমাত্রাকে ধরেন শূন্য ডিগ্রি ফারেনহাইট, পানির গলনাঙ্কের তাপমাত্রাকে ধরেন ৩২ ডিগ্রি ফারেনহাইট, আর পানির স্ফুটনাঙ্কের তাপমাত্রাকে ধরেন ২১২ ডিগ্রি।
রোমারের এক ডিগ্রিকে প্রায় চার ভাগ করে ফারেনহাইটের এক ডিগ্রি হিসাব করা হয়েছে। এই ফারেনহাইট স্কেল এখন আর তাপমাত্রার আন্তর্জাতিক স্কেল না হলেও আমেরিকায় এখনো ফারেনহাইট স্কেল ব্যবহৃত হয়। আমরাও জ্বর মাপার জন্য এখনো ফারেনহাইট স্কেল ব্যবহার করি। বিজ্ঞানী ফারেনহাইট প্রথম থার্মোমিটারে পারদ ব্যবহার করেন। পারদ স্বাভাবিক কক্ষ-তাপমাত্রায় তরল অবস্থায় থাকে।
তাপমাত্রার সামান্য পরিবর্তনেও পারদের আয়তনের পরিবর্তন ঘটে। তার স্বাভাবিক উজ্জ্বলতার কারণে কাচের নলের ভেতর দিয়ে পারদের ওঠা–নামা পরিষ্কারভাবে দেখা যায় বলে থার্মোমিটারের জন্য পারদ খুবই উপযোগী।
কিন্তু ফারেনহাইট স্কেল ব্যবহারকারীদের জন্য খুব একটা সহজবোধ্য নয়, খুব একটা যুক্তিগ্রাহ্যও নয়। পানি জমে বরফ হয়ে যাওয়ার তাপমাত্রা কেন ৩২ ডিগ্রি হবে, আর গরম হয়ে ফুটতে শুরু করবে কেন ২১২ ডিগ্রিতে? এর কোনো সদুত্তর নেই। ১৭৪২ সালে সুইডেনের বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী অ্যান্ডার্স সেলসিয়াস ফারেনহাইটের স্কেলকে সহজ করার ব্যবস্থা করলেন।
তিনি পানির গলনাঙ্ককে ১০০ ডিগ্রি এবং স্ফুটনাঙ্ককে শূন্য ডিগ্রি ধরে একটি স্কেল চালু করলেন। এই সেলসিয়াস স্কেল সহজ হলেও কেমন যেন উল্টো মনে হলো সবার কাছে। তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিগ্রির পরিমাণ বাড়া উচিত। সেলসিয়াস তাঁর স্কেল ঠিক করার আগেই ১৭৪৪ সালে মারা যান মাত্র ৪৩ বছর বয়সে।
সেলসিয়াসের মৃত্যুর পর উদ্ভিদবিজ্ঞানী কার্ল লিনিয়াস সেলসিয়াস স্কেলকে উল্টে দিয়ে ঠিক করে দেন। নতুন স্কেলে শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পানি জমে বরফ হয়ে যায়, আর ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পানি ফুটতে শুরু করে। তখন কিন্তু ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বলা হতো। কিন্তু কোণের পরিমাণও ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হিসাবে মাপা হয় বলে ১৯৪৭ সালে তাপমাত্রা মাপার একককে ‘ডিগ্রি সেলসিয়াস’ হিসেবে প্রচলন করা হয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে পদার্থবিজ্ঞানের অনেক উন্নতি ঘটে। বিজ্ঞানীরা গ্যাসের আয়তনের ওপর তাপ ও চাপের প্রভাব এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক খুঁজে বের করেন। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জেমস জুল তাপগতিবিদ্যার আলোকে তাপমাত্রার আধুনিক সংজ্ঞা দেন। তাপমাত্রা হলো পদার্থের মধ্যস্থিত কণাগুলোর গড় গতিশক্তির পরিমাপ। কণাগুলোর গতিশক্তি যত বেশি, তার তাপমাত্রাও তত বেশি। অর্থাৎ বস্তু তাপ শোষণ করে গরম হওয়ার অর্থ হলো বস্তুর কণাগুলোর গতি বেড়ে যাওয়া। আবার ঠান্ডা হওয়ার অর্থ হলো কণাগুলোর গতি কমে যাওয়া। যেমন পানি স্বাভাবিক তাপমাত্রায় তরল।
পানিকে ঠান্ডা করতে থাকলে পানির অভ্যন্তরীণ কণাগুলোর গতি ক্রমেই কমে যায় এবং পানি জমে বরফ হয়ে যায়। আবার যখন অনেক বেশি গরম করা হয়, তখন কণাগুলোর গতি বেড়ে যেতে যেতে তারা বাষ্প হয়ে গ্যাসে পরিণত হয়।
১৮৬২ সালে স্কটল্যান্ডের পদার্থবিজ্ঞানী উইলিয়াম থমসন লর্ড কেলভিন ‘পরম শূন্য’ তাপমাত্রার ধারণা দেন। তিনি দেখান যে -২৭৩ দশমিক ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পদার্থের কণাগুলোর গতি একেবারে থেমে যায়। গতিশক্তি শূন্য হয়ে যাওয়ার কারণে তখন পদার্থের চাপও শূন্য হয়ে যায়।
এই তাপমাত্রাকে পরমশূন্য তাপমাত্রা ধরে তাপমাত্রার নতুন একটি স্কেল চালু হয়, যা কেলভিন স্কেল নামে পরিচিত। পরমশূন্য তাপমাত্রাকে শূন্য ডিগ্রি কেলভিন ধরা হয়। এই তাপমাত্রার নিচে আর কিছুতেই যাওয়া সম্ভব নয়, কারণ এই তাপমাত্রায় পদার্থের তাপ, চাপ, পারমাণবিক গতি সব শূন্য হয়ে যায়।
সাধারণ পারদ-থার্মোমিটার দিয়ে আমরা শরীরের তাপমাত্রা মাপি। কিন্তু পারদ-থার্মোমিটার ব্যবহারে অনেক বিপদও আছে। মুখের ভেতর থার্মোমিটার ঢুকিয়ে তাপমাত্রা পরিমাপ করার সময় যদি থার্মোমিটার ভেঙে যায়, তবে খুব ক্ষতি হতে পারে। তাই আস্তে আস্তে থার্মোমিটারের অনেক বিবর্তন ঘটেছে। এখন ডিজিটাল থার্মোমিটার ব্যবহার করা হচ্ছে প্রায় সবখানে। ডিজিটাল থার্মোমিটারে কোনো পারদ থাকে না। তাপমাত্রার পরিবর্তনের সঙ্গে পদার্থের রেজিস্ট্যান্সের পরিবর্তন ঘটে। ডিজিটাল থার্মোমিটারে রেজিস্ট্যান্সের পরিবর্তনে বিদ্যুৎ-প্রবাহের যে পরিবর্তন ঘটে, তার হিসাব করে তাপমাত্রার পরিমাপ করা হয়।
আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থায় ডিজিটাল থার্মোমিটার ছাড়াও ব্যবহৃত হয় ইনফ্রারেড বা অবলোহিত থার্মোমিটার। ছোট শিশুদের তাপমাত্রা সহজে নির্ণয় করার জন্য এই থার্মোমিটার খুব উপযোগী। কানের ছিদ্রে এই থার্মোমিটার প্রবেশ করিয়ে শরীরের তাপমাত্রা মাপা যায়। আবার কপালে স্পর্শ করিয়েও তাপমাত্রা মাপা যায় এ ধরনের থার্মোমিটার দিয়ে।
উত্তপ্ত বস্তু তাপ বিকিরণ করে। আমাদের শরীরে তাপ আছে এবং তা বিকীর্ণ হচ্ছে। ইনফ্রারেড থার্মোমিটার শরীরের বিকিরণ শনাক্ত করে। এই বিকিরণের মাত্রা অনুযায়ী ডিজিটাল সিগন্যালে পরিণত হয়। এবং সিগন্যাল উপযুক্ত ইলেকট্রনিকসের মাধ্যমে তাপমাত্রায় রূপান্তরিত হয়। পারদ-থার্মোমিটারে যেখানে তাপমাত্রা মাপতে মিনিটখানেক সময় লাগে, সেখানে মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই তাপমাত্রা মাপা যায় ইনফ্রারেড থার্মোমিটার দিয়ে। মানুষের শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রার সামান্যতম পরিবর্তনও শনাক্ত করা যায় এ ধরনের থার্মোমিটারের সাহায্যে। অদূর ভবিষ্যতে আমাদের কোষের সামান্যতম অস্বাভাবিক পরিবর্তনও পর্যবেক্ষণ করা যাবে তাপমাত্রার পরিবর্তন লক্ষ্য করে। সুস্থ থাকা আরও বেশি সহজ হয়ে যাবে বিজ্ঞানের কল্যাণে।
আপনার মতামত জানানঃ