গ্রিক উপকথার স্বপ্নদেবতা মরফিউস। ঘুমের গভীরে মানুষকে স্বপ্ন দেখান তিনি। মরফিউসের বাহুতে নিদ্রারত মানুষ উপভোগ করে গভীর ঘুমের সুখ। দেবতাদের কাছ থেকে মানুষের কাছে প্রতিচ্ছবি ও গল্পের মাধ্যমে স্বপ্নবার্তা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব মরফিউসের। মানুষের স্বপ্নে যেকোনো আকৃতিতেই ধরা দিতে পারেন মরফিউস। স্বপ্নে যেকোনো মানুষের অনুকরণেই উপস্থিত হতে পারেন তিনি, ধারণ করতে পারেন যেকোনো রূপ। তিনি স্বপ্নের প্রভু হিসেবে মানুষের অন্তর্দৃষ্টিতে প্রতিচ্ছবি পাঠাতে পারেন। অন্তর্দৃষ্টিকে দিতে পারেন আকার, স্বপ্নে দেখা সৃষ্টিকে দিতে পারেন আকৃতি। গ্রিক শব্দ ‘মরফি’ অর্থ আকৃতি। যেহেতু তিনি স্বপ্নে যেকোনো আকৃতিতে ধরা দিতে পারেন, তাই তাঁর নাম হয়েছে মরফিউস।
মরফিউস কিন্তু মানুষকে দুঃস্বপ্ন বা অলীক স্বপ্ন দেখাতেন না। দুঃস্বপ্ন যিনি দেখাতেন, তিনি মরফিউসের ভাই ফোবিটর, যার নাম থেকে ইংরেজি ফোবিয়া অর্থাৎ ভয় শব্দটি এসেছে। তার আরেক ভাই ফ্যান্টাসাস দেখাতেন অলীক স্বপ্ন বা ফ্যান্টাসি। ফ্যান্টাসাস নাম থেকেই এসেছে ইংরেজি ফ্যান্টাসি শব্দটি। স্বপ্নদেবতা মরফিউস ঘুমাতেন বিশেষ এক গুহায়, সে গুহা ভরা থাকত পপি ফুলের বীজে।
রোমান সম্রাট অগাস্টাসের রাজত্বকালে রোমে এক বিখ্যাত কবি ছিলেন, নাম পাবলিয়াস ওভিডিয়াস নাসো। ওভিড নামেও ডাকা হয় তাঁকে। তিনি লিখতেন মেটামরফোসিস নামক কবিতা। সে কবিতায় তিনি লিখেছেন মরফিউসের কথা। ইংরেজ পণ্ডিত ও লেখক রবার্ট বার্টনও মরফিউসকে নিয়ে লিখেছেন তাঁর দ্য এনাটমি অব মেলাংকলি নামক বইতে। তবে চিকিৎসাশাস্ত্রে দেবতা মরফিউসকে অমর করে রেখেছেন একজন জার্মান ওষুধবিজ্ঞানী, নাম তাঁর ফ্রিডরিশ সার্টারনার।
তখন ১৮০৪ সাল। পপি ফুলের বীজাধার বা ক্যাপসুল থেকে ওষুধবিজ্ঞানী ফ্রিডরিশ সার্টারনার উদ্ভাবন করেন এক যুগান্তকারী ব্যথানাশক ওষুধ মরফিন। পপিগাছ, যার বৈজ্ঞানিক নাম পাপাভের সমনিফেরাম (Papaver somniferum), লাল–হলুদ ফুল ফোটে এতে। এ গাছের বীজাধার আড়াআড়ি বা লম্বালম্বিভাবে কাটলে তা থেকে বেরিয়ে আসে একধরনের আঠালো উপাদান বা ল্যাটেক্স। ল্যাটেক্স শুকিয়ে তৈরি করা হয় অপিয়াম। ফ্রিডরিশ সার্টারনার পপিগাছের অপিয়াম থেকে আলাদা করেন অ্যালকালয়েড নামে একজাতীয় উপাদান। সেই যে বলেছি, স্বপ্নদেবতা মরফিউস ঘুমাতেন যে গুহায়, তা ভরা থাকত পপি ফুলের বীজে। বিজ্ঞানী সার্টারনার তাই পপিগাছ থেকে পাওয়া সেই এলকালয়েডের নাম রাখেন ‘মরফিয়াম’, মরফিউসের নামানুসারে। পরে মরফিয়াম নামটি মরফিন নামে পরিচিতি পায়।
অপিয়াম থেকে নানা রকম এলকালয়েড পাওয়া গেলেও, যে এলকালয়েড সবার আগে আলাদা করা হয়, তা এই মরফিন। শুধু তা–ই নয়, উদ্ভিদ থেকে আলাদা করা এলকালয়েডগুলোর মধ্যে মরফিনই আলাদা করা হয় সবার আগে। আর সার্টারনার হলেন প্রথম বিজ্ঞানী, যিনি ঔষধি উদ্ভিদ থেকে অ্যালকালয়েড আলাদা করেন। এমনিভাবেই তাঁর হাত ধরে সূচনা হয় ‘অ্যালকালয়েড কেমিস্ট্রি’ নামে বিজ্ঞানের একটি শাখার। সার্টারনার মরফিনের কার্যকারিতা এবং অন্যান্য গুণাগুণ নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা চালাতে থাকেন ক্রমাগত। সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে অবশেষে জার্মানির বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি ‘মার্ক’ ১৮২৭ সালে ব্যথানাশক হিসেবে মরফিনের বাণিজ্যিক বিপণন শুরু করে।
এরপর থেকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে তীব্র ব্যথানাশক হিসেবে মরফিন এখনো ব্যবহার করা হচ্ছে। মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশান নামক হৃদ্রোগে এবং প্রসবকালে যে তীব্র ব্যথা হয়, তা কমাতে এ ওষুধ প্রায়ই ব্যবহৃত হয়। সাম্প্রতিক বছরের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যানসারের ব্যথা দূর করতেও মরফিন কার্যকর।
বমিভাব, কোষ্ঠকাঠিন্য, তন্দ্রাচ্ছন্নতা, মুখগহ্বরের শুষ্কতা, আসক্তি ইত্যাদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও মরফিন চিকিৎসার ক্ষেত্রে অপরিহার্য ।
ব্যথার অনুভূতি কমানোর জন্য মরফিন কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে সরাসরি কাজ করে। কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে রয়েছে কয়েক ধরনের ‘অপিঅয়েড রিসেপ্টর’। মরফিন এসব রিসেপ্টরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তা সক্রিয় করে; প্রকাশ করে মরফিনের কার্যকারিতা। চিকিৎসার ক্ষেত্রে যদিও তীব্র ব্যথা উপশম ও নিদ্রা উৎপাদন মরফিনের প্রাথমিক কাজ, পাকস্থলী ও অন্ত্রেও কাজ করে মরফিন, তৈরি করে কোষ্ঠকাঠিন্য। মরফিনের মতো কার্যকারিতার অন্যান্য উপাদান, যেমন হাইড্রোমরফোন, অক্সিমরফোন এবং হেরোইন তৈরিতেও ব্যবহৃত হয় মরফিন।
বমিভাব, কোষ্ঠকাঠিন্য, তন্দ্রাচ্ছন্নতা, মুখগহ্বরের শুষ্কতা, আসক্তি ইত্যাদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও মরফিন চিকিৎসার ক্ষেত্রে অপরিহার্য । মরফিন সেবনে মাদকাসক্তি তৈরি হয় বলে এর অপব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে। দীর্ঘদিন মরফিন ব্যবহারের পর হঠাৎ এর মাত্রা কমিয়ে দিলে বা সেবন বন্ধ করে দিলে দেখা দিতে পারে ‘উইথড্রয়াল সিনড্রোম’ নামক শারীরিক সমস্যা। গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী মায়েদের মরফিন সেবনে রয়েছে বিশেষ সতর্কতা, কারণ নবজাতকের শরীরে এর প্রভাব কাজ করতে পারে। চিকিৎসায় মরফিনের ব্যবহার যত দিন থাকবে, তত দিন স্বপ্নদেবতা মরফিউসের নাম অমর হয়ে থাকবে চিকিৎসাবিজ্ঞানে।
আপনার মতামত জানানঃ