আজ থেকে ঠিক ২৩ বছর আগের কথা। এমনই এক গ্রীষ্মের রাতে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর নারায়ণহিতি রাজপ্রাসাদে রাজপরিবারের সদস্যরা একসঙ্গে নৈশভোজে বসেছেন। হুট করেই আনন্দঘন পারিবারিক সেই নৈশভোজ পরিণত হয় মৃত্যুর উৎসবে। একে একে প্রাণ যায় সবারই।
২০০১ সালের ১ জুন নেপালের ইতিহাসে কালো রাত বটে! অতর্কিত মুহুর্মুহু গুলিতে প্রাণ যায় নেপালের রাজা বীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব, রানি ঐশ্বরিয়া রাজ্য লক্ষ্মী দেবীসহ রাজপরিবারের ৯ সদস্যের। এ সময় নিহত অন্যরা হলেন- বীরেন্দ্রর ছেলে নিরজন, প্রিন্সেস শ্রুতি রাজ্যলক্ষ্মী, রাজার ছোট ভাই ধীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব, রাজার বোন শান্তি ও শারদা, শারদার স্বামী কুমার খাদগা এবং রাজার চাচাতো বোন জয়ন্তী। আহত হন রাজা বীরেন্দ্রর বোন শোভা, যুবরানি শ্রুতির স্বামী কুমার গোরখ, রাজার ভাই জ্ঞানেন্দ্রর স্ত্রী কমল ও ছেলে পরশ এবং রাজার চাচাতো কেটাকী চেষ্টার।
খুনের জন্য দায়ী রাজা বীরেন্দ্রর ছেলে দীপেন্দ্রও গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। বীরেন্দ্রর মৃত্যুর পর রাজা ঘোষণা করা হয়েছিল দীপেন্দ্রকে। গুলিবিদ্ধের পর তখনও তিনি কোমায় ছিলেন। তবে চারদিন পর তিনি মারা যান। এরপর সিংহাসনে বসেন বীরেন্দ্রর বেঁচে থাকা একমাত্র ভাই জ্ঞানেন্দ্র বীরবিক্রম শাহ দেব।
রাজপ্রাসাদে এই হত্যাকাণ্ড নেপালসহ পুরো বিশ্বকেই অবাক করে দিয়েছিল। সপরিবারে নিহত রাজা বীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব জনগণের কাছে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশ পছন্দের ব্যক্তি ছিলেন। ফলে ঘটনাটি নেপালের জাতীয় পরিসরে তো বটেই, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মহলেও ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
এই হত্যাযজ্ঞের ঘটনা তদন্তে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি করা হয়। মাত্র এক সপ্তাহের তদন্তের ভিত্তিতে প্রতিবেদন দেয় কমিটি। তারা এই হত্যাযজ্ঞের জন্য দীপেন্দ্রকে দায়ী করে। তবে তিনি কেন এই হত্যাযজ্ঞ ঘটালেন, সে বিষয়ে কমিটি কিছু বলেনি। তবে এই হত্যাযজ্ঞের পেছনের কারণ নিয়ে নানা ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ ছড়ায়। বহুল চর্চিত ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্বটি’ হচ্ছে দীপেন্দ্রর প্রেম-ভালোবাসা-বিয়ে ঘটিত।
ইটন কলেজে পড়ার সময় দীপেন্দ্রর সঙ্গে নেপালের একসময়ের সাবেক শাসক জঙ্গ বাহাদুর রানা পরিবারের মেয়ে দেবযানী রানার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সে সময় দেবযানীও যুক্তরাজ্যে পড়ছিলেন। দেবযানীর বাবা পশুপতি রানা নেপালের একজন নেতৃস্থানীয় রাজনীতিবিদ। তিনি মন্ত্রীও ছিলেন। তার মা ঊষা রাজে সিন্ধিয়া ভারতের সিন্ধিয়া রাজপরিবারের মেয়ে।
কিন্তু দীপেন্দ্র-দেবযানির সম্পর্ক মানতে চাইছিলেন না বীরেন্দ্র-ঐশ্বরিয়া। এ নিয়ে রাজ পরিবারে অসন্তোষ ছিল। তা নিয়ে জটিলতায় ক্ষিপ্ত হয়ে যুবরাজ দীপেন্দ্র মাতাল অবস্থায় সেই রাতে রাজপ্রাসাদের নৈশভোজে গুলি করে মা-বাবা, ভাইবোন, চাচা, ফুফুসহ সবাইকে গুলি করে হত্যা করেন। পরে নিজেকেও গুলি করে আত্মাহুতি দেওয়ার চেষ্টা করেন। চার দিন পর তিনিও হাসপাতালে মারা যান।
তবে তদন্ত কমিটির এই ভাষ্য মানতে পারেননি নেপালের বেশিরভাগ জনগণ ও রাজনৈতিক নেতারা। বিজয় থাপা নামের একজন বলেন, ‘আমরা যেটা জানি, যুবরাজ দীপেন্দ্রকে রাজপ্রাসাদের যে সাঁকোর নীচ থেকে উদ্ধার করে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে নেয়া হয়, সেখানে কোনো স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র পাওয়া যায়নি। তাহলে সেই অস্ত্র কেন উদ্ধার করা গেল না? সেই অস্ত্র গেল কোথায়? কীভাবে নিশ্চিত হওয়া গেল যে, যুবরাজই খুন করেছেন। রাজপরিবারে থেকে কেউ কি এতটা নৃশংস হওয়ার শিক্ষা পেতে পারেন?
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা নিশ্চিত না হয়ে এটি বিশ্বাস করতে চাই না যে, রাজপরিবারের কেউ এই খুনের সঙ্গে জড়িত। কে খুন করেছে রাজাকে, আমরা শুধু সেই প্রশ্নের সত্যতা জানতে চাই।’
অনেকেই মনে করেন, জ্ঞানেন্দ্রর রাজ সিংহাসনে বসার একটি মাত্র উপায় ছিল, রাজা বীরেন্দ্র ও তার দুই ছেলে দীপেন্দ্র ও নিরঞ্জনের মৃত্যু। সেদিন দীপেন্দ্রর বাবা-মা, ভাইদের সঙ্গে বোন, ফুফু ও তাদের স্বামীদেরও হত্যা করে। সবাইকে হত্যা করেও জ্ঞানেন্দ্রর কিছু হয়নি। কারণ, ওই দিন জ্ঞানেন্দ্র নিজে রাজপ্রাসাদে উপস্থিত ছিলেন না। তার স্ত্রীর হাতে গুলি লাগলেও অন্যদের তুলনায় তার আঘাত ছিল খুবই সামান্য। এমনকি জ্ঞানেন্দ্রর ছেলে পরশ কোনো প্রকার আঘাত ছাড়াই বেঁচে যান। যা সবাইকে ভীষণ অবাক করে।
প্রায় দুই যুগ হতে চললেও বিশ্বের বহু রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের মতো নেপালের রাজপ্রাসাদ হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কেও প্রকৃত তথ্য জানতে পারেনি মানুষ। যারা সব জানতেন, তাদের সবাই সেদিন মারা যান। ফলে পুরো বিষয়টিই রয়ে গেছে রহস্যের অন্তরালে। সূত্র : বিবিসি
আপনার মতামত জানানঃ