পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদের ইস্যু ও প্রধানমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস-২) গাজী হাফিজুর রহমান এবং উপ-প্রেস সচিব (ডিপিএস) হাসান জাহিদ তুষারের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল নিয়ে আওয়ামী লীগে তোলপাড় চলছে। দলটির নেতারা মনে করছেন, এসব ইস্যু সরকার ও দলের ভাবমূর্তিতে আঘাত করেছে। বিষয়গুলো বিব্রতকর বলেও মন্তব্য করেছেন তারা। আওয়ামী লীগের ধারণা-বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট এসব ইস্যুতে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চায়। এজন্য ক্ষমতাসীন দলটির পক্ষ থেকে এরইমধ্যে সতর্ক অবস্থান নেয়া হয়েছে।
এ নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে বিশেষ বার্তাও দেয়া হয়েছে। ওই বার্তায় বলা হয়েছে, দলের সাধারণ সম্পাদক ছাড়া অন্য কেউ যেনো এসব নিয়ে কোনো ধরনের মন্তব্য না করেন। বেফাঁস কথা না বলেন। দলের টাঙ্গাইল জেলার এক নেতাকে আলাদাভাবে এসব বিষয় নিয়ে কথা বা মন্তব্য না করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কারণ অতীতে নির্বাচন নিয়ে ওই নেতার করা এক বক্তব্যে দল বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে।
এদিকে বিরোধী জোট যেনো বিষয়গুলো নিয়ে ইস্যু করতে না পারে সেজন্য দলের সাধারণ সম্পাদক প্রায় প্রতিদিনই এসব নিয়ে সাংবাদিকদের করা বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। তিনি বার্তা দেয়ার চেষ্টা করছেন যে, এসব দুর্নীতি ও অনিয়মের দায় একান্তই তাদের ব্যক্তিগত। এর সঙ্গে সরকার বা আওয়ামী লীগের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তাই তাদের কোনো অনিয়মের দায়ভার সরকার নেবে না। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা মানবজমিনকে বলেছেন, তৃণমূল নেতাকর্মীদের নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের। তৃণমূলের অভিমত-সরকার ও দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজরা যেনো পার না পায় সে অনুরোধও করছেন তারা। কেন্দ্রীয় নেতারা বলেন, সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী ভালোভাবে অবগত। এরইমধ্যে তিনি সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বার্তা দিয়েছেন। বর্তমানে মন্ত্রী ও দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা মানবজমিনকে বলেছেন, অভিযুক্তদের কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ইতিবাচক কোনো সাড়া মেলেনি। পরে দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গেও তারা যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন।
প্রভাবশালী এক নেতা অভিযুক্ত একজনকে কোনো ধরনের যোগাযোগ না করার বার্তা পাঠিয়েছেন। ওই মন্ত্রীর অভিমত, সরকার তাদেরকে দেশের স্বার্থ রক্ষায় দায়িত্ব দিয়েছিল। সেটাকে পুঁজি করে যদি কেউ ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করে তাহলে দায়ভার কেন সরকার নেবে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক পর্যায়ের কয়েকজন নেতার মন্তব্য জানতে চাইলে মানবজমিনকে তারা বলেন, আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদক বিষয়গুলো নিয়ে একাধিকবার কথা বলেছেন। তিনি যে বার্তা দিয়েছেন সেটাই আমাদের বার্তা।
তাই এসব ইস্যু নিয়ে নতুন কোনো ধরনের মন্তব্য করতে চায় না। তাছাড়া এসব নিয়ে দলের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। আমরা সেসব নির্দেশনার বাইরে যেতে চায় না। দেশে হাজার কোটি টাকার সম্পদের তথ্য নিশ্চিত হওয়ার পর এবার পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিদেশে কোনো সম্পদ আছে কিনা তার খোঁজ করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটির কাছে প্রাথমিক তথ্য এসেছে- অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে বেনজীর পরিবারের সম্পদ থাকতে পারে। এই তথ্য নিশ্চিত হতে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) চিঠি দিয়েছেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। এ ছাড়া দেশেও বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের আরও বিপুল সম্পদের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
এদিকে, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে করা দুর্নীতির অভিযোগ শিডিউলভুক্ত হলে অনুসন্ধানের জন্য আমলে নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, অভিযোগ আমলযোগ্য হলে সেটা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। অন্যদিকে বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস-২) গাজী হাফিজুর রহমান এবং উপ-প্রেস সচিব (ডিপিএস) হাসান জাহিদ তুষারের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করেছে সরকার। এই তিন ইস্যুতেই বার্তা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সাবেক আইজিপি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে দুদক তদন্ত করছে। আরও তদন্ত হবে। মামলা হলে তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। কোনো অপরাধী শাস্তি ছাড়া পার পাবে না।
অনেকে ভাবছে, বেনজীর আহমেদের বাড়ি টুঙ্গিপাড়া, সে ক্ষমা পেতে পারে। কিন্তু তা হবে না। অপরাধ করলে শাস্তি পেতে হবে। তিনি আরও বলেন, বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে দুদক স্বাধীন তদন্ত করছে। দুদককে এ স্বাধীনতা শেখ হাসিনা সরকার দিয়েছে। তিনি বলেন, বেনজীর ইস্যুতে সরকার বিব্রত নয়। কারণ সরকারের বিচার করার সৎ সাহস আছে। সরকার তাদের অপরাধ অস্বীকার করে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয়নি। দুর্নীতির ব্যাপারে সরকারপ্রধান আপসহীন। সাবেক সেনাপ্রধানের বিষয়ে তিনি বলেন, যিনি সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন, তিনিও যদি অপরাধী হন, তার বিরুদ্ধেও দুদক তদন্ত করতে পারবে। অপরাধী হলে শাস্তি পেতে হবে। অন্যদিকে একইদিনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দুই কর্মকর্তার নিয়োগ বাতিল প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের বলেন, দায়িত্ব পালনে কোনো প্রকার বিচ্যুতি ঘটেছে বলেই তাদের নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের দুর্নীতির বিষয়ে ব্যবস্থা প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দুই গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। সে বিষয়ে আপনারা কি আগে রিপোর্ট করেছিলেন? সেটা এখন পাচ্ছেন আপনারা। তাদের (দুই কর্মকর্তার) বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো অভিযোগ আছে কিনা সেটা আমি জানি না। একই প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেছেন, অপরাধী যতই প্রভাবশালী বা ক্ষমতাধর হোক সরকারের কোনো সহযোগিতা পাবে না। তাদের শাস্তি পেতে হবে। আইন তার নিজ গতিতে চলবে।
আপনার মতামত জানানঃ