সৌদি বাদশাহ সালমান ২০১৭ সালের জুনে ভাতিজা মোহাম্মদ বিন নায়েফকে সরিয়ে সিংহাসনের উত্তরসূরি করেন ছেলে মোহাম্মদ বিন সালমানকে। এরপর থেকে বদলের হাওয়া বইতে শুরু করেছে ‘রক্ষণশীল’ দেশ বলে পরিচিত সৌদি আরবে। মোহাম্মদ বিন সালমান ক্রাউন প্রিন্স হওয়ার পর থেকে নারীদের ওপর থেকে একের পর এক বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হচ্ছে। নারীরা এখন মাঠে বসে কনসার্ট ও খেলা দেখার সুযোগ পাচ্ছেন, গাড়ি চালানোর সুযোগ পাচ্ছেন। এরই ধারাবাহিকতায় সেনাবাহিনীতেও নারীদের নিয়োগ কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। এবার এ তালিকায় যোগ হলো নারীদের বিচারক হবার স্বাধীনতা। প্রথমবারের মতো বিচারকের আসনে বসতে যাচ্ছেন ধর্মীয়ভাবে রক্ষণশীল দেশ সৌদি আরবের নারীরা।
সৌদি মানবসম্পদ ও সামাজিক উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ক আন্ডারসেক্রেটারি হিন্দ আল-জাহিদ এমন তথ্য জানিয়েছেন। বললেন, এ দেশে শীঘ্রই বিচারকের আসনে বসতে যাচ্ছেন নারীরা। আর তা বাস্তবায়নে বিভিন্ন পর্যায়ে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
আল-আরাবিয়াকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, নারীর ক্ষমতায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে সৌদি আরব। বিশেষ করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হবে।
নারীর অধিকার অর্জনে সৌদি অগ্রগতি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জানিয়ে তিনি জানান, সৌদি শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। বর্তমানে এই অংশগ্রহণের হার ৩১ শতাংশে পৌঁছে গেছে।
তিনি বলেন, সরকারি চাকরিতে সৌদি নারীদের অংশগ্রহণ ৩৯ থেকে ৪১ শতাংশ। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে নারীদের অংশগ্রহণ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে।
প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সংস্কার কর্মসূচি ‘ভিশন ২০৩০’ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বর্তমানে সৌদি নারীরা বিভিন্ন সুবিধা পাচ্ছেন। কর্মক্ষেত্রে সৌদি নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানোরও পরিকল্পনা করা হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে নারীর সংখ্যা ৩১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে মোট জনশক্তির এক-তৃতীয়াংশ করতে চায় দেশটি।
সৌদির রাজধানী রিয়াদে এখন বিপুল সংখ্যক ছাত্রীকে স্কুলে যেতে দেখা যায়, ৬৫ বছর আগে যা ভাবাই যেত না। সৌদির মেয়েদের প্রথম স্কুল দার আল হানান। আর রিয়াদ কলেজ অব এডুকেশন সৌদি নারীদের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৯৭০ সালে চালু হয়।
দেশটির নারীদের পরিচয়পত্র পাওয়ার অগ্রাধিকার দেয়া হয় একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে এসে। সৌদি আরবে নারীদের পরিচয়পত্র নিতে হলে আগে পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি প্রয়োজন হতো। ২০০১ সালে সৌদি নারীরা পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই পরিচয়পত্র নেয়ার সুযোগ পান।
২০০৫ সালে সৌদি আরবে নারীদের জোরপূর্বক বিয়ে নিষিদ্ধ করা হয়। ২০০৯ সালে সৌদি আরবের কেন্দ্রীয় সরকারে প্রথম নারী মন্ত্রী নিয়োগ করেন বাদশাহ আব্দুল্লাহ। নূরা আল কায়েজ নারী বিষয়ক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিসেবে সে বছর সরকারে যোগ দেন। ২০১২ সালে প্রথমবারের মতো অলিম্পিকে অংশ নেন সৌদি নারীরা।
২০১৫ সালে সৌদি আরবের পৌরসভা নির্বাচনে নারীরা প্রথমবারের মতো ভোট দেয়ার এবং নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ পান। ২০১৫ সালে সৌদি আরবের ওই নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছিলেন ২০ জন নারী।
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে সৌদি আরব দেশটির স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারপারসন হিসেবে সারাহ আল সুহাইমির নাম ঘোষণা করে আরেক ইতিহাস সৃষ্টি করে।
এদিকে ২০১৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সৌদি আরবের নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি সংক্রান্ত এক আদেশ জারি করে। ২০১৮ সালের জুন মাসে এই আদেশ কার্যকর হয়েছে। ফলে গাড়ি চালাতে সৌদি নারীদের আর কোনো পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি নিতে হবে না। এছাড়া গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পাচ্ছেন তারা। সেনাবাহিনীতেও নারীদের নিয়োগ কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। ধাপে ধাপে অধিকার পাওয়া সৌদি নারীরা এবার দেশটির বিচারকের আসনে বসতে যাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কট্টর রক্ষণশীল দেশ হিসেবে পরিচিত সৌদি আরব দেরি হলেও নিজেদের বুঝতে পারার চেষ্টা করছে। তবে অনেকে মনে করেন, নারীরা ধীরে ধীরে নিজেদের অধিকার বুঝে পেতে শুরু করলেও এখনো তারা তেমন অর্থে মুক্ত নয়। পোশাক পরার স্বাধীনতা, রেস্টুরেন্টে বন্ধুর সাথে বসে কফি খাওয়ার স্বাধীনতা, নিজেদের ইচ্ছায় বিয়ে করার স্বাধীনতা, বিদেশ ভ্রমণের স্বাধীনতা ছাড়াও অন্যান্য কাজে এখনো পিছিয়ে আছে। বিশেষ করে পরিবারের নিজেদের গুরুত্ব তুলে ধরার সুযোগ থেকে এখনো তারা বঞ্চিত। তবে সৌদি নারীদের বিচারকের আসনে বসার অনুমতি প্রদান সৌদি নারীদের জন্য যুগান্তকারী এক সিদ্ধান্ত বটে। বিশ্বের অন্যান্য স্বাধীন নারীদের মতো সৌদি আরবের নারীরাও নিজেদের স্বাধীনতা ফিরে পাবেন এমন প্রত্যাশা লক্ষণীয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৩৩
আপনার মতামত জানানঃ