তিস্তা বহুমুখী ব্যারেজ প্রকল্প নিয়ে দ্বৈরথে ভারত ও চীন। এমনটাই ধারণা দিলেন দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। তাদের মতে, দৃশ্যপটে ভারতের উপস্থিতি আচমকা নয়। অনেকদিন ধরেই তার আভাস পাওয়া যাচ্ছিলো। তবে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রার এই সফরে বিষয়টি যে আসবে তা সেগুনবাগিচার ধারণার বাইরে ছিল।
কারণ ভারতে এখন নির্বাচন চলছে। তাছাড়া কোয়াত্রার সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতে আমন্ত্রণ জানানোই ছিল মুখ্য। এখানে দ্বিপক্ষীয় বিষয়াদি নিয়ে আলোচনার সুযোগ কম ছিল। কর্মকর্তারা এটা নিশ্চিত করেছেন যে, পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে আলোচনায় এনিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি দিল্লির বিদেশ সচিব। তিস্তা প্রকল্পে অর্থায়নের আগ্রহ তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে ব্যক্ত করেছেন।
তবে সেখানেও কোন ফর্মে কতোটা অর্থায়ন করবে নয়াদিল্লি, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো আলোচনা করেননি বিনয় মোহন কোয়াত্রা। ভারতের ওই প্রস্তাবের পর চার দিন পার হয়েছে। এর মধ্যে সেগুনবাগিচায় অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত চীনা কূটনীতিকরা। কিন্তু এতদিন ধরে তিস্তা প্রকল্প নিয়ে উচ্চকণ্ঠ চীনের প্রতিনিধিরা এ বিষয়ে একটি কথাও বলেননি।
যা রহস্যজনক ঠেকেছে সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে। তবে সেগুনবাগিচা বলছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থানে কোনো হেরফের নেই। নয়াদিল্লি ও বেইজিং উভয়ের কাছে ঢাকার বার্তা স্পষ্ট এবং অভিন্ন। তিস্তা অববাহিকার মানুষের জীবন-জীবিকার তাগিদে মহাপরিকল্পনাটি এগিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর বাংলাদেশ।
এ নিয়ে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ভারত বা উন্নয়ন সহযোগী চীনের নিজস্ব ভাবনা থাকতে পারে। এক বন্ধুরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অন্য বন্ধুরাষ্ট্রকে সক্রিয় করার কোনো হীনচেষ্টা যে বাংলাদেশের নেই- তা উভয়ের কাছে খোলাসা করা হয়েছে। ২০১৯ সালের সমাপনীতে ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’ গ্রহণ করে বাংলাদেশ সরকার।
২০২০ সালের জুলাইতে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ‘তিস্তা নদী সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প’ বিষয়ক প্রাথমিক প্রস্তাব পাঠায় পরিকল্পনা কমিশনে। প্রকল্পটির ফিজিবিলিটি স্টাডির জন্য টোকিও’র সহায়তা নেয়ার চিন্তা করে ঢাকা। কিন্তু ততক্ষণে পর্দার আড়ালে নানা পক্ষ সক্রিয় হয়ে উঠে। থেমে যায় আলোচনা।
নিজে থেকে প্রকল্পটিতে অর্থায়নের আগ্রহ দেখায় চীন। নীরবে পাল্টা প্রতিক্রিয়া তথা আপত্তি আসে ভারত থেকে। ভারতীয় মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে শোরগোল পড়ে যায়। অবস্থাদৃষ্টে ঢাকা ‘ধীরে চলো নীতি’তে প্রকল্পটি নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। বাতাসে নানা কথা ভাসতে থাকে। তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প বাংলাদেশের চেয়ে ভারত ও চীনের কাছে ভূ-রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে দাঁড়ায়।
তিস্তা প্রকল্পে চীনের আগ্রহকে কৌশলগত অবস্থান হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করেন দিল্লির বিশ্লেষকরা। এ নিয়ে খোলামেলাই কথাবার্তা আসে ভারত থেকে। হিমালয় থেকে উৎপন্ন তিস্তা ভারতের সিকিম এবং পশ্চিমবঙ্গের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। নদীটির পানির ন্যায্য হিস্যা পেতে প্রায় ৫২ বছর ধরে অপেক্ষায় বাংলাদেশ।
২০১১ সালে একটি চুক্তির খসড়া প্রায় চূড়ান্ত হয়। কিন্তু তা ঝুলে যায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তিতে। চুক্তি না করেই ঢাকা সফর শেষ করেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং। কংগ্রেস সরকারের তরফে তখন বলা হয় দ্রুতই পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আলোচনা করে চুক্তিটি সই হবে। আড়াই বছরের মাথায় দিল্লির মসনদে পরিবর্তন আসে। ক্ষমতায় আসে বিজেপি সরকার। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকারও প্রায় অভিন্ন প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে।
বলা হয়, মোদি-হাসিনা সরকারের আমলেই চুক্তিটি হবে। কিন্তু না, দফায় দফায় প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সই হয়নি আজ অবধি। এ নিয়ে চরম হতাশা থেকে ৪ বছর আগে বাংলাদেশ ‘তিস্তা নদী সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প’ গ্রহণ করে। যেখানে আগ বাড়িয়েই অর্থায়নে আগ্রহ দেখায় চীন।
গত বৃহস্পতিবার ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে। সাক্ষাৎ শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী তিস্তা প্রকল্প নিয়ে আলোচনার বিষয়টি প্রকাশ করেন। মন্ত্রী বলেন, তিস্তায় সরকার যে বৃহৎ প্রকল্প নিয়েছে, ভারত সেখানে অর্থায়ন করতে চায়। সহায়তা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, তিস্তায় যে প্রকল্পটি হবে, সেটি আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী হবে।
তাই আমাদের প্রয়োজন যেন পূরণ হয়, এটি ভারতকে বলা হয়েছে। লেখক ও নদী গবেষক শেখ রোকন মনে করেন- চতুর্থ দফায় সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানাতে চীন ও ভারতের মধ্যে যে প্রতিযোগিতা চলছে তাতে তিস্তায় প্রস্তাবিত ও বহুল আলোচিত ‘মহাপরিকল্পনা’ একটি ভূমিকা রাখছে।
তিনি প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বেইজিংয়ের তাড়া, দিল্লির আপত্তি এবং ঢাকার দ্বিধার বিষয়টি সবিস্তারে তুলে ধরেছেন একটি নিবন্ধে। সেখানে তিনি কিছু প্রশ্ন রাখেন। তার মতে, ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের সর্বশেষ সফরে তিস্তা প্রকল্পে ভারতের অর্থায়নের প্রস্তাবের মধ্যদিয়ে এবং নয়াদিল্লি ও বেইজিংয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর সামনে রেখে নদীটি নিয়ে ভারত-চীন দ্বৈরথের নতুন অধ্যায় কী শুরু হতে যাচ্ছে? ভারত এতদিন তিস্তায় পানিই দিতে চেয়েছে। এখন পানির বদলে প্রকল্পে অর্থায়ন করতে চাইছে কেন? যদি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন বা কার্যকর না হয়, তখন? হতে পারে, তখন ঝুলে থাকা চুক্তিটি স্বাক্ষর হবে এবং ভারত পানি দেবে। তখন দিতে পারলে, এখন দিলে অসুবিধা কী? তিনি বলেন- কথা হচ্ছে, তিস্তায় আমাদের প্রয়োজন পানি।
অভিন্ন অববাহিকার দেশ হিসেবে অভিন্ন নদীটিতে বাংলাদেশের যে অভিন্ন অধিকার রয়েছে, বিদ্যমান প্রবাহের ন্যায্য হিস্যার মধ্যদিয়ে সেটি নিশ্চিত হতে পারতো। কিন্তু প্রায় পৌনে শতাব্দী ধরে ভারতের দিক থেকে তিস্তায় পানির বদলে কেবল প্রতিশ্রুতিই গড়িয়েছে। বস্তুত, তিস্তায় সোজা পথে যখন পানি আসছিল না, তখনই বাংলাদেশ বাধ্য হয়েছিল ঘুরপথে যেতে।
আরও ভেঙে বললে, ভারতের দিক থেকে ধর্তব্য ভরসা না পেয়েই চীনের সহায়তায় ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’ বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিতে বাধ্য হয়েছিল বাংলাদেশ। এই প্রশ্ন ইতিমধ্যে কেউ কেউ তুলেছেন যে, চীনা অর্থায়নে তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা গেলে ভারতীয় অর্থায়নে অসুবিধা কী? পাল্টা প্রশ্ন তোলা যায়, প্রকল্পে অর্থায়ন করতে পারলে পানির ন্যায্য হিস্যা দিতে অসুবিধা কী?
বাস্তবতা হচ্ছে, উজানের দেশ ভারত থেকে তিস্তায় প্রাপ্য পানি না আসায় বাংলাদেশ যে চীনা অর্থায়নের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছিল, তার মধ্যদিয়ে এক ধরনের ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ তৈরি হতো। এখন যদি ভারতীয় অর্থায়নে তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়, তাহলে পানির মূল উৎস এবং বিকল্প কারিগরি ব্যবস্থা-সংবলিত প্রকল্প উভয়টির নিয়ন্ত্রণই কার্যত ভারতের হাতে থাকবে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের হাতে কী রইলো?
আপনার মতামত জানানঃ