“গ্রেট বেনিন, যেখানে রাজারা বাস করে, লিসবনের চেয়েও বড় এই শহরের রাস্তাগুলোর কোনো শেষ নেই, যতদূর চোখ যায় চোখে পড়বে শুধু ঐশ্বর্যময় শহরের চোখ ধাঁধানো রূপ,” পর্তুগিজ ক্যাপ্টেন লরেন্সো পিন্টোর ১৬৯১ সালের ডায়েরিতে চোখে পড়বে এই বাক্যগুলো।
“বিশাল বিশাল সব বাড়ি, বিশেষ করে রাজার প্রাসাদটা। দেয়ালে ঝুলছে অসাধারণ সব ট্রফি, সাথে রয়েছে বিশাল সব কলাম। শহরে প্রাচুর্যের অভাব নেই, আর লোকগুলোও কর্মঠ। এখানে চুরি বলে কোনো শব্দ নেই, এমনকি এদের বাড়িতে দরজা পর্যন্ত নেই!”
আফ্রিকার জঙ্গলের গভীরে অবস্থান করা সত্ত্বেও অন্যান্য আফ্রিকান রাজ্য আর নাইজার নদীর মাধ্যমে আটলান্টিক মহাসাগরের সাথে সংযুক্ত এই গ্রেট বেনিন শহর ছিল এমন একটি সাম্রাজ্যের রাজধানী, যা ছিল বর্তমান নাইজেরিয়ার আয়তনের পাঁচভাগের একভাগ।
ইউরোপীয়দের সাথে বেনিনবাসীর পরিচয় ঘটে ১৪৮০ এর দশকে, যখন পর্তুগিজ ব্যবসায়ীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে সাহারার আশেপাশে, ব্যবসা করার নতুন জায়গা খুঁজে বের করার জন্য। ওলন্দাজদের আগমন আরো ১০০ বছর পর, দু’শ বছর পর ভিড় জমিয়েছে ইংরেজ, ফরাসি, জার্মান আর স্প্যানিশরা।
তাদের সবার মুখে মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে বেনিনের অপরিমেয় সম্পদের গল্প। কিন্তু আপনি যদি কোনো পশ্চিমাকে জিজ্ঞাসা করেন, এমনকি কোনো পর্তুগিজকেও, যারা চারশ বছর ধরে বেনিনের সাথে ব্যবসা করে এসেছে, তারাও আপনার দিকে ফাঁকা চোখে তাকাবে! ঠিক কী হয়েছিল বেনিনবাসীর? কীভাবেই বা এই ঐশ্বর্যময় শহর হারিয়ে গেল কোনো ধরনের চিহ্ন রেখে যাওয়া ছাড়াই?
বেনিনের আদিবাসী এদোদের লোককথা অনুযায়ী, বেনিনকে আসলে ডাকা হতো ইগোডোমিগোডো নামে। নামকরণ করা হয়েছিল ওগিসো (যার অর্থ আকাশের শাসক) রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ইগোডোর নামে। যদিও ইগোডোর পর আরো ৩১ জন শাসক বংশানুক্রমে এই বেনিন সাম্রাজ্য শাসন করে গিয়েছে, দ্বাদশ শতাব্দীর আগপর্যন্ত বেনিন তার সেরা সময়ে পৌঁছেনি।
বছরের পর বছর ধরে চলা রাজনৈতিক টানাপোড়েন আর ক্ষমতার দ্বন্দ্বের পর ইগোডোমিগোডোর রাজা প্রতিবেশি রাজ্য ইফের রাজা ওদুদুওয়ার কাছে দূত পাঠালেন তার ছেলেকে ইগোডোমিগোডো শাসন করার জন্য! ওদুদুওয়া তার ছেলে ওরানমিয়ানকে পাঠালেন ইগোডোমিডোতে, কিন্তু কিছুদিন পরেই ইগোডোমিডোর লোকজনের ষড়যন্ত্রে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে চলে গেলেন নিজের রাজ্যে। ক্ষমতা দিয়ে গেলেন তার ছেলে ইওয়েকার হাতে।
ওরানমিয়ান বেনিনের নাম দিয়েছিলেন ‘ইলে ইবুনু’, অর্থাৎ রাগের ভূমি। যা-ই হোক, ইওয়েকার হাত ধরেই শুরু হলো বেনিনের ‘ওবা (রাজা)’ যুগ। ১২৫৫ সালে ইওয়েকার মৃত্যুর পর তার ছেলে ওবা ইওয়েদো সাম্রাজ্যের নাম পরিবর্তন করে রাখলেন উবিনি, যা পরে পর্তুগিজরা বিনি নামে ডাকা শুরু করে, আর সেখান থেকে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান বেনিন রূপ লাভ করেছে।
ওবা পদ্ধতি চালু হওয়ার পর থেকেই বেনিনের সামাজিক নিয়মে পরিবর্তন আসা শুরু করলো। সমাজ ভাগ হয়ে গেলো দুই ভাগে, এক ভাগ অভিজাত সমাজ, যাদেরকে বলা হয় ‘উজামা (চিফ)’। রাজার পাশাপাশি উজামারাই রাজ্য চালাতো। প্যালেস চিফরা রাজপ্রাসাদ সম্পর্কিত সবকিছু দেখাশোনা করতো, টাউন চিফরা খাজনা আদায় করতো, সেনাবাহিনীর দেখাশোনা করতো। অন্যান্য চিফদের দায়িত্ব ছিল বিভিন্ন রকম, শিকার থেকে শুরু করে জ্যোতিষশাস্ত্র নিয়ে গবেষণা, এমনকি রাজার প্রাসাদের জন্য বিভিন্ন ধরনের ট্রফি তৈরি করাও ছিল তাদের কাজ।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষদিক থেকে শুরু করে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত বেনিন সাম্রাজ্য বেড়ে চললো যুদ্ধবাজ রাজাদের একের পর এক অভিযানের মাধ্যমে। তবে শুধু নতুন এলাকা জয় নয়, বরং একইসাথে চললো রাজ্য উন্নয়ন, শিল্পকলা চর্চার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি আর বাণিজ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন। আর বহিরাগত শত্রু থেকে বেনিনকে রক্ষা করার জন্য ছিল সুসংগঠিত আর নিয়মিতভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাবাহিনী।
ওবা প্রথম ইউয়ারের হাত ধরে বেনিন প্রবেশ করলো নতুন এক যুগে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়নের পাশাপাশি শিল্প-সংস্কৃতির দিকেও আগ্রহী ছিলেন তিনি, বিশেষ করে ব্রোঞ্জ, আইভরি আর কাঠসামগ্রী, যা এখনো সারা বিশ্বে সমাদৃত। ইউয়ারে স্থাপত্যকলার দিকেও নজর দিয়েছিলেন, শহর পরিকল্পনা আর জনসাধারণের জন্য নতুন উৎসবের প্রচলন ঘটিয়েছিলেন।
বহিরাগত শত্রুদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য তৈরি করেছিলেন পুরু দেওয়াল আর পরিখা, যার আয়তন ছিল প্রায় সাড়ে ছয় হাজার বর্গ কিলোমিটার! ছয় শতাব্দী আগে তৈরি এই পরিখাকে আজও প্রি-মেকানিক্যাল যুগের আশ্চর্য হিসেবে ধরা হয়। ১৯৭৪ সালে গিনেস বুকে এই পরিখাকে তাদের রেকর্ড বুকে তালিকাভুক্ত করে, চীনের মহাপ্রাচীরের পর এটিই মানুষের তৈরি সবচেয়ে বড় স্থাপনা।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে বেনিনবাসীর সংস্পর্শে আসে পর্তুগিজরা এবং খুব দ্রুতই বাণিজ্য শুরু করে। পর্তুগাল আর বেনিনের সম্পর্ক এতটাই ভালো ছিল যে ওবা এসিগি পর্তুগালে দূত পাঠান, যার ফলে পরবর্তীতে বেনিনের শিল্প-সংস্কৃতিতে ইউরোপীয় প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এসিগি পর্তুগিজ ভাষা চমৎকারভাবে রপ্ত করেছিলেন, আর এটি সাহায্য করেছিল পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের সাথে সম্পর্ক বাড়ানোর জন্য। এদিকে পর্তুগিজরা বেনিনের স্থানীয় ফল নিজেদের দেশে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেল, অন্যদিকে বেনিনে বেশ কিছু গির্জাও স্থাপন করলো আফ্রিকায় যীশুর বাণী পৌঁছিয়ে দেওয়ার জন্য। বেনিন থেকে পর্তুগালে রপ্তানিকৃত দ্রব্যগুলোর মধ্যে ছিল আইভরি, মরিচ আর সামান্য পরিমাণ ক্রীতদাস।
এই সময়ে দাসব্যবসায়ের প্রচলন তখনো খুব একটা ঘটেনি, তাছাড়া বেনিনের দাস ছিল যুদ্ধবন্দী মহিলারা। অন্যদিকে যুদ্ধবন্দী হিসেবে আটকা পড়া দাসদেরকে ব্যবহার করা হতো যুদ্ধের কাজে। বেনিন তখন অর্থনৈতিক এবং সামরিক দিক থেকে এতটাই শক্তিশালী ছিল যে দাসব্যবসা করার কোনো প্রয়োজনই ছিল না।
কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দী আসতে আসতে বেনিন সাম্রাজ্যের পতন শুরু হলো। যোগ্য নেতার অভাব, অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ আর শাসকশ্রেণির মধ্যে রেষারেষিই ছিল এর কারণ। আইভরির দামের পতন এবং দাস-ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পড় বেনিনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বেশ বড় একটা ধাক্কা খেল। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ওবা এরেসোনিয়েনের শাসনামলে বেনিন কিছুটা উন্নতি করলেও তা পতন ঠেকানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। সাম্রাজ্যের আয়তন কমতে থাকলো ধীরে ধীরে, কারণ দূরবর্তী অঞ্চলের লোকেরা ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সুরক্ষার জন্য ব্রিটিশদের উপর নির্ভর করা শুরু করলো। ১৮৯২ সালের দিকে ব্রিটিশরা ওবাকে বাধ্য করে চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য, ফলে বেনিন সাম্রাজ্য ইংরেজদের আশ্রিত রাজ্য হিসেবে চলে আসে। ইংরেজরা এসেই নরবলির প্রচলন বন্ধ করে, বাণিজ্যের দিকে মনোযোগ দেয় এবং দাসব্যবসা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়।
এদিকে ওবা ওভোরমোয়েন বুঝতে পেরেছিলেন, ইংরেজরা শীঘ্রই পুরো বেনিন দখল করে নেবে, অনেকটা ভারতবর্ষে লর্ড ক্লাইভের দ্বৈত শাসনের মতো অবস্থা চলছে তখন। ১৮৯৭ সালে ওবার নির্দেশে ইংরেজ অফিসারদের এক ক্যারাভানে আক্রমণ করে বসে তার সৈন্যরা। দুই-তৃতীয়াংশ অফিসার বেঁচে গেলেও ওবার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়ে যায়।
আক্রমণের প্রতিশোধ নিতে ইংরেজরা তাদের বাহিনী পাঠায় বেনিন দখল করার জন্য। ওবা আর তার অনুসারীরা পালিয়ে যায়, যদিও তারা পরবর্তীতে ফিরে আসে এবং আত্মসমর্পণ করে। ওবা অনুরোধ করে তার অবস্থান ফিরিয়ে দিতে, কিন্তু ইংরেজরা তাকে অপদস্থ করে এবং নাইজেরিয়ায় নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়। ওখানেই ১৯১৪ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে ওবা।
এদিকে বেনিনে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো শুরু করে ব্রিটিশরা, তবে তার আগে লুটপাট করে নেয় বেনিনের অঢেল সম্পদ। কিছু অমূল্য ঐতিহাসিক জিনিস তারা বিক্রি করে দেয় অভিযানের খরচ উঠানোর জন্য, তবে বেশিরভাগই নিয়ে যায় ইউরোপে, যেগুলো এখন সংরক্ষিত রয়েছে ইউরোপের বিভিন্ন জাদুঘরে এবং ব্যক্তিগত সংগ্রহে। ১৯১৪ সালে, ওভোরামোয়েনের ছেলে দ্বিতীয় ইউয়েকাকে বসানো হয় বেনিনের সিংহাসনে, যদিও সেটি ব্রিটিশ ঔপনেবেশিক গভর্নরের তত্ত্বাবধানে। বেনিন টিকে আছে সেই হারিয়ে যাওয়া সোনালী যুগের ছায়া হয়েই, বিশাল পরিখার মতো শক্তিশালী কোনো কিছুই আর অবশিষ্ট নেই একসময়ে পশ্চিম আফ্রিকায় রাজত্ব করা এই সভ্যতার। সূত্র: রোয়ার বাংলা
আপনার মতামত জানানঃ