শুধু মানুষই নয়, জগতের সকল জীবজন্তুই খাদ্য, বাসস্থান এবং স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপনের অনুকুল পরিবেশে থাকার জন্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিরন্তর গমন করেছে। সেখানে ভালো না লাগলে বা প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে অথবা অধিকতর ভালো জায়গার সন্ধান ফেলে তাতেই পাড়ি জমিয়েছে।
এটি সেই প্রাণিজগতের জীবজন্তুর জীবনযাত্রা শুরু থেকে এখনও চলছে। মানুষ অপেক্ষাকৃত অনুভূতি, বোধ, বুদ্ধি এবং সচেতন হওয়ায় সেও বিবর্তনের কালযাত্রায় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছুটে চলেছে। এটি সম্ভবত জীবজগতের চিরন্তন বৈশিষ্ট্য। মানুষ এর থেকে মোটেও ব্যতিক্রম হওয়ার কোনো কারণ নেই। অন্য জীবজন্তুরা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গিয়েছে নিজেদের খাদ্য ও নিরাপত্তার প্রয়োজনে। কিন্তু মানুষ খাদ্য, বাসস্থান, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, অধিকতর ভালো থাকা ইত্যাদির জন্যই শুধু অভিগমন করেনি, সম্পদ সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজ গঠন করেছে।
উন্নত সমাজ ব্যবস্থাকে অধিকতর উন্নত করার জন্য জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে প্রকৃতিকে মানব কল্যাণে ব্যবহার ও পরিবর্তন করেছে। এর মাধ্যমে অতীব সরল-সহজ সাধারণ জীবনব্যবস্থা থেকে শুরু করে মানুষ ক্রমাগত মানুষের জীবনকে যেভাবে পরিবর্তন করে চলেছে, অর্থনীতি, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক যেভাবে তৈরি করে চলছে তার মূলে রয়েছে মানুষের অভিবাসন প্রক্রিয়ার বড় ধরনের ভ‚মিকা। ইতিহাসে এ নিয়ে বিস্তর জানার সুযোগ রয়েছে। ইতিহাস মানুষের সামনে অভিবাসনের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত নানা বৈশিষ্ট্যের যেসব ধারণা উপস্থাপন করছে তা আমাদের অবশ্যই চিন্তা করতে সুযোগ করে দিবে কিভাবে একবারে অবচেতনে সেই আদিম মানব প্রজাতির স্তর থেকে বর্তমান আধুনিক বিশ্বের উন্নত চিন্তাশীল মানুষ তা করে চলছে সেটি এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা।
ফিরে দেখা যেতে পারে মানব ইতিহাসের অভিবাসনের অভিজ্ঞতাকে। আদি পর্ব মানুষের ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। তবে চিন্তাশীল তথা হোমো সাপিয়েনদের যাত্রা শুরু হয়েছিল এখন থেকে প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার বছর আগে। সেই সময়টি আদিম মানব সমাজ ইতিহাসের একটি নতুন পর্ব। এর আগে আরও প্রায় ৬ মিলিয়ন তথা ৬০ লাখ বছরের বেশি সময় ছিল যখন প্রজাতির পর প্রজাতি যারা আমাদেরই পূর্বপুরুষদেরও পূর্বপুরুষ, তারা অবশ্য আমাদের মতো অত বুদ্ধিমান ছিল না। কিন্তু জীব জগতের নানা বৈশিষ্ট্যের অনেককিছু তাদেরও ছিল। তাঁদেরও খেতে হতো লতাপাতা, ফলফুল ইত্যাদি। বাস করতে হতো কখনোও বড় বড় গাছের গুহায় কিংবা পাহাড়ের গুহায়। খাদ্য সংগ্রহের জন্য তাদেরও ছুটে বেড়াতে হতো এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়।
বংশ বিস্তারে প্রাকৃতিক নিয়ম তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ছিল। এদের নৃতত্ত্ব এপ প্রজাতি হিসেবে নামকরণ করেছে। সেটি পূর্ব আফ্রিকার ইথিওপিয়া, কেনিয়া, তাঞ্জানিয়া অঞ্চল থেকে শুরু করে দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। এখানেও তাদের জীবনধারণের জন্য খাদ্য, বসবাসের জায়গা, টিকে থাকার নিরাপত্তা ইত্যাদির সন্ধানে তারা পূর্ব আফ্রিকা থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত ছুটে গেছে। প্রায় ৪০ লাখ বছরের দিকে এ পদের চাইতে অপেক্ষাকৃত আকারে বড়, মগজে আরেকটু উন্নত এমন প্রজাতির মানবগোষ্ঠী পূর্ব আফ্রিকাতেই যাত্রা শুরু করে। এদের অস্ট্রালোপিথেকাস তথা দক্ষিণের মানব বলা হয়ে থাকে।
এরাও একইভাবে আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণ এবং পূর্ব অঞ্চলে খাদ্য ও বসবাসের সন্ধানে অভিগমন করেছে। প্রায় ২০ লাখ বছর তাদের এই অভিগমনে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যের কিছু অংশ মানুষের এই পূর্ব পুরুষদের আগমনে নতুনভাবে সেজে ওঠে। শেষের দিকে এরা শারীরিক শ্রম, কিছুটা অনুভ‚তিও বুদ্ধির চর্চা করেছে বলে নৃবিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদরা মনে করেন। তবে এদের চাইতে আরো উন্নত দৈহিক মানসিক গড়নে যে নতুন প্রজাতির নর পূর্ব আফ্রিকায় জন্ম নেয় তাদের হোমো হাবিলিশ বলা হয় এর অর্থ হচ্ছে সক্ষম মানুষ। যারা খাড়া হয়ে দাঁড়াতে সক্ষম ছিল।
এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় কিছু খুঁজু হয়েও যাতায়াত করত। এরা শ্রম দেয়া শুরু করে, পাথরের সঙ্গে এদের পরিচয় ঘটে, পাথর দিয়ে তারা নানা হাতিহার তৈরি করে যা পশু, পাখি ইত্যাদি শিকারে তারা ব্যবহার করে। এখান থেকেই পাথরের যুগ খ্রিস্টপূর্ব ২৫ লাখ বছরের দিকে শুরু হয়। এক ধরনের সামাজিক বন্ধন তাদের মধ্যে দেখা যায়। যা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় তাদের দলবদ্ধভাবে নিয়ে যায়। এরপর খ্রিস্টপূর্ব ২০ লাখ বছরের দিকে পূর্ব আফ্রিকায় এরেক্টাস (কর্মঠ মানব প্রজাতি) উদ্ভব ঘটে। এর অনেকগুলো উপপ্রজাতি আফ্রিকায় জন্ম নিলেও অচিরেই এরা খাদ্য ও বাসস্থানের সন্ধানে ইউরেশিয়া মহাদেশে প্রবেশ করে। ইউরোপের অনেক জায়গায় তারা অভিগমন করে। এশিয়া মহাদেশেও এদের বসতি বিস্তার বৃদ্ধি পেতে থাকে।
আমরা জাভা মানবের কথা জানি যারা বর্তমানে ইন্দোনেশিয়া বসবাস করেছে। এদেরও আগমন সেই সুদূর আফ্রিকা থেকে। বলা হয়ে থাকে খ্রিস্টপূর্ব ১৮ থেকে ১৪ লাখ বছরের দিকে জাভা মানবদের উদ্ভব বসতি শুরু হয়েছে। অন্যদিকে পিকিং মানবদের কথাও আমরা জানি। নৃবিজ্ঞানীরা মনে করেন জাভা এবং পিকিং মানবরা প্রজাতিগতভাবে এক। তাহলে বুঝাই যাচ্ছে একস্থান থেকে অন্যস্থানে এদেরও গমন ঘটেছে। ৬ লাখ বছর আগে পূর্ব আফ্রিকা থেকে আরেক প্রজাতির মানুষ সাহারা হয়ে ভ‚মধ্যসাগর তীরবর্তী অঞ্চল দিয়ে এর আরেকটি অংশ ভ‚মধ্যসাগরের পূর্ব তীর দিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করেছে। এদের হাইডেলবার্গ মানব বলা হয়ে থাকে। এরা ইউরোপের মধ্যবর্তী অঞ্চল পর্যন্ত তাদের বসতি স্থাপন করেছে।
হাইডেলবার্গ মানবের মতোই আরেকটি প্রজাতি ইউরোপের জার্মান ভূখণ্ডে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। এদের নিয়ান্ডারথাল মানব বলা হয়। এরা আমাদের প্রত্যক্ষ পূর্ব পুরুষ। যারা বুদ্ধিমত্তায় আগের মানব প্রজাতির চাইতে অনেক উন্নত ছিল। ৪ লাখ বছর আগে এদের অন্যতম কীর্তি হিসেবে আগুনের ব্যবহার স্মরণীয় হয়ে আছে। এরা গোটা ইউরোপ চষে বেড়িয়েছে। এরপর হোমো সাপিয়ান তথা চিন্তাশীল মানব প্রজাতি ২,৩০,০০০ বছর পূর্বে পূর্ব আফ্রিকার ইথিওপিয়া তাঞ্জানিয়া অঞ্চলে জন্ম নেয়। এরা পূর্ববর্তী মানব প্রজাতিগুলো থেকে অনেক বেশি বুদ্ধিমান হওয়ায় খাদ্যের সন্ধান, বাসস্থান, সুখ-শান্তির ধারণা ইত্যাদি
প্রয়োজনে ইউরেশিয়ায় প্রবেশ করে। ইউরেশিয়া থেকে হোমো সাপিয়ানরা দ্রুত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন হোমো সাপিয়েনদের সঙ্গে নিয়ান্ডারথালরা বুদ্ধিতে এঁটে উঠতে পারেনি। যদিও নিয়ান্ডারথালরা দৈহিকভাবে হোমো সাপিয়েনদের চাইতে বড় ছিল কিন্তু নিয়ান্ডারথালরা একসময় এসে হোমো সাপিয়েনদের ভয়ে নিজেদের জায়গা ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়।
৭০ হাজার বছরের দিকে হোমো সাপিয়ানরা বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তায় বিপ্লবাত্মক পর্বে নিজেদের উন্নীত করে। তারা অনেক বেশি উদ্ভাবনী ক্ষমতায় নিজেদের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিতে থাকে। নিয়ান্ডারথালদের সাথে তাদের যুদ্ধও হয়। তাতে নিয়ান্ডারথালরা পরাস্থ হয়। জায়গা ছেড়ে পেছনে চলে যেতে বাধ্য হয়। হোমো সাপিয়ানরা ইউরোপের সর্বত্র ছড়িয়ে পরে। এশিয়া মহাদেশেও তখন তাদের গমনাগমন অপ্রতিরোদ্ধভাবে চলছিল।
খ্রিস্টপূর্ব ৬০ থেকে ৪৫ হাজার বছরের দিকে এই মানুষরাই ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত দ্বীপ অঞ্চলগুলোতে একের পর এক প্রবেশ করতে থাকে। অস্ট্রেলিয়ায় তাদের অভিগমন তখনই ঘটে। এমনকি আফ্রিকা থেকে সুদূর ভারত মহাসাগরের মাদাগাস্কারেও এরা প্রবেশ করে। এশিয়ার পূর্ব প্রান্তে চিন, জাপান হয়ে সাইবেরিয়া অতিক্রম করে খ্রি.পূ. ২৫-১৫ হাজার বছরের দিকে বেশকিছু মঙ্গোলীয় গোষ্ঠী বর্তমান আমেরিকা মহাদেশে প্রবেশ করে। মাত্র ২ হাজার বছরের মধ্যে এই মানুষগুলো বর্তমান উত্তর আমেরিকা হয়ে মধ্য আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকার সর্বত্র তাদের বসতি স্থাপন করে। এদের আমরা এই ভূখণ্ডের ওহফরমবহড়ঁং তথা আদি জনগোষ্ঠী বা রেড ইন্ডিয়ান বলেই জানি। মনে রাখতে হবে যেখানে এই হোমো সাপিয়ান তথা বুদ্ধিমান মানবরা প্রবেশ করেছে সেখানে প্রকৃতিতে বাস্তুতাত্ত্বিক নতুন সমস্যা যেমন তৈরি হয়েছে আবার মানব মানুষের সমাজ ব্যবস্থা, আর্থ-সামাজিক অবস্থা তথা সাংস্কৃতিক জীবন ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে।
মাত্র গত ৪০/৫০ হাজার বছরের মধ্যে সবকটি মহাদেশে মানুষ অভিবাসন ঘটিয়েছে। আদিম এই মানুষদের অভিবাসনটি মোটেও সহজ কোনো ব্যাপার ছিল না। পায়ে এটে জীবজন্তুর আক্রমন প্রতিহত করে নদী, সাগর, পাড়ি দিয়ে তবেই কেবল এক ভ‚খন্ড থেকে অন্য ভ‚খন্ডে মানুষের অভিগমন ঘটানো সম্ভব হয়েছে। এই অভিবাসন ঘটাতে গিয়ে কত মানুষ জীবজন্তুর আক্রমণ, সাপের বিষ, নদী সমুদ্রে কুমির, হাঙ্গরের আহারে পরিণত হয়েছে তার কোনো পরিসংখ্যান কারো জানা নেই। তবে এটি যে বিশাল সংখ্যার ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হোমো সাপিয়ানদের আগে যারা ইউরেশিয়া পর্যন্ত অভিবাসন ঘটিয়েছিল তাদের অভিবাসনকে মোটেও সহজ ভাবার কোনো কারণ নেই।
সেই মানুষদের বুদ্ধিজ্ঞান, দুর্গম পথ চেনাজানা, জীবজন্তুর আক্রমণ প্রতিহত করা, নদী, পানি পার হওয়া, মোটেও সহজ ছিল না। হোপো সাপিয়ানরা অবশ্য গত ৪০/৪৫ হাজার বছরে যা ঘটিয়েছে সেখানে ভেলা, নৌকা, ভাসমান কাঠ ইত্যাদির সাহায্য নিতে গিয়ে অনেক প্রতিক‚ল অবস্থাকে বুদ্ধি দিয়ে অতিক্রম করেছে। তারা নৌকা তৈরি করেছে, ভেলাও তৈরি করেছে, জোয়ার ভাটা চিনেছে আবার নতুন জায়গায় গিয়ে শুধু শিকার সংগ্রহের মধ্যেই নয় একসময় কৃষির মতো কাজ করতে মাটিতে চাষবাসের বুদ্ধিমত্তাও দেখিয়েছে।
এ মানুষরা যেখানেই গেছে সেখানেই প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছে। একই সঙ্গে তারা উৎপাদনের মতো সৃষ্টিশীল বিষয়কে উদ্ভাবন করেছে। সমাজবদ্ধ জীবনব্যবস্থা তাদের মূল শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। নারী পুরুষ সবাই হাত লাগিয়েছে কাজে, ঘর তৈরিতে, পাথর কেটে ভেঙে হাতিয়ার তৈরিতে। এভাবেই তারা উন্নত গোত্রীয় ব্যবস্থা তৈরি করেছে। ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া বিভিন্ন মহাসাগরে ভাসমান দ্বীপগুলোতে। কী বিস্ময়কর প্রাণশক্তি এই মানুষদের মধ্যে দেখা যায়। সমুদ্রে ভেসে একদিক থেকে অন্যদিকে যাওয়া এর জন্য ভেলা, নৌকা ইত্যাদি তৈরি করা মোটেও সহজ কাজ ছিল না।
আবার নদী ও সাগর সমুদ্রে মৎস্য, প্রাণী শিকার করা জীবন-জীবিকাকে বিস্তৃত করা সবই তারা তখন করেছিল শুধুমাত্র খাদ্য বাসস্থানের সন্ধানে নয়, নিজেদের অনুসন্ধিৎসু মনকে বিজয়ী করার জন্য। সে কারণেই দেখা যায় খ্রিস্টপূর্ব ১২ হাজার বছরের দিকে ভূমিতে বসবাসকারী মানুষ কৃষিবিপ্লব সংগঠিত করতে পেরেছিল। এটি মানুষের ইতিহাসকে মানুষ নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে সাহায্য করে। মানুষ এ সময়ে খাদ্য শস্য উৎপাদন করতে প্রযুক্তি তথা নতুন নতুন হাতিয়ার ব্যবহার করতে শিখেছে। এক অঞ্চলের মানুষ অন্য অঞ্চলের প্রকৃতিতে যা উৎপাদন করা সম্ভব তা করেছে।
এর মাধ্যমে গোটা মানুষের জীবনব্যবস্থা প্রকৃতির ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীলতা কাটিয়ে নিজেদের গড়া সমাজ সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটিয়েছে। এক অঞ্চলের মানুষ অন্য অঞ্চলে সেইসব অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিয়েছে। সেখানেও অভিবাসনের ধারা ক্রিয়াশীল থেকেছে, ইতিবাচক ভ‚মিকা রেখেছে। বলতে দ্বিধা নেই এই সময়টি ছিল মাটির পৃথিবী আর জলের নদী সমুদ্র মহাসাগরে মানুষের অভিবাসনের এক দুরন্তপনার অভিযাত্রা। কোথাও নেই বর্ডার, নেই রাষ্ট্রের সীমানা, নেই পুলিশি বাধা, নেই পাসপোর্ট। কারণ তখনও রাষ্ট্র বলে কোনো ধারণাই মানুষের ছিল না। গোটা প্রকৃতিতেই তার ছিল অন্য জীবজগতের প্রাণীদের মতো অবাধ বিচরণ।
স্বাধীনতার স্পৃহা, গমনাগমনের চ্যালেঞ্জ নেয়া, প্রকৃতির নিয়মে মানুষও গোটা ভূখণ্ড দেখা, জানা, বসবাস করা ইত্যাদিতে দেখেছে। মানুষ এখানে তখন ছিল প্রকৃতির অন্যান্য জীবজগতের মতোই স্বাধীনভাবে বিচরণকারী। এই বিচরণ চিরকাল বাধাহীন থাকেনি। মানুষের গড়া সমাজ, ভাষা-সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক, কার্যক্রম, সংঘবদ্ধ জীবনব্যবস্থা, ইত্যাদি এক সময় মানুষকে অবাধ বিচরণের স্বাধীনতাকে সীমিত করে দেয়। এটি পরবর্তী পর্বের ইতিহাস। প্রাচীন ও মধ্যযুগের অভিবাসন খ্রিস্টপূর্ব ৪ হাজার বছরের দিকে মানুষের অভিবাসন অনেকটা স্থির হতে থাকে। কৃষি এক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করে।
এই সময় বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষি অর্থনীতি মানুষকে স্থায়ী বসবাসের ধারায় যুক্ত করে। সেখান থেকেই প্রাচীন সভ্যতা যখন ছোট ছোট সংস্কৃতি অপেক্ষাকৃত বড় সভ্যতার দিকে দৃষ্টি পেরায় বড় বড় সভ্যতা তখন নগর রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। সেখানেই একেকটি অঞ্চল একেকটি সভ্যতা বেশকিছু জনগোষ্ঠীকে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে শাসনতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থায় ধরে রাখতে চাইল। সেখানে জোরজবরদস্তি ঘটেছে, দাসতন্ত্র তৈরি হয়েছে, স্বৈরতন্ত্র সেই ব্যবস্থাকে পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করেছে, শ্রেণিবৈষ্যমের সেই রাষ্ট্রব্যবস্থা মানুষের অবাধ স্বাধীনতাকে হরণ করেছে।
দরিদ্র মানুষদের শ্রম জোরপূর্বকভাবে চাষবাস, বাড়ি, রাস্তাঘাট ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণে বাধ্য করেছে। এভাবে নতুন যেব্যবস্থাটি তৈরি হয়েছে তাতে আগের মতো মানুষের অভিবাসন স্বাধীনভাবে আর গড়তে পারেনি। তবে সব জায়গায় প্রাচীন এই নগররাষ্ট্র বা সভ্যতা তৈরি হয়নি। যেখানে হয়নি সেখানে রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা হয়েছে। অনেকেই সেখান থেকে পালিয়ে গেছেন। আবার অনেকে আক্রমণকারীদের হাতে বন্দি হয়েছেন। তারপরও মুক্ত অঞ্চলে মানুষ খাদ্য বা জীবন জীবিকার সন্ধানে জায়গা খুঁজেছে।
যেখানে পেয়েছে কিছুকাল থেকেছে। অবশ্য রোমান সাম্রাজ্যের পতনের আগে ও পরে বিস্ময়কর কিছু অভিজ্ঞতা হলো। যে সাম্রাজ্রটি ইংল্যান্ড থেকে শুরু করে ইউরোপের পশ্চিম অঞ্চল, মধ্যপ্রাচ্য আফ্রিকা মহাদেশের উত্তরাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল সেটি একের পর এক যাযাবর গোত্রীয় বাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়েছিল। উত্তরের এই মানুষগুলো ছিল রাষ্ট্রহীন, সভ্যতাবিহীন। এরা কোনোদিন রাষ্ট্র দেখেনি, রাজপ্রাসাদও দেখেনি। তাদের হাতেই পরাজিত হলো তৎকালীন বিশ্বের সর্বশক্তিমান সাম্রাজ্য তথা রোমান সাম্রাজ্য। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর দাসদের অনেকেই মুক্ত হলো।
তারা ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দিকে অভিবাসন ঘটালো। এইসব অঞ্চলে দুর্বল কিছু সমাজ ও রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটলেও মানুষের জীবন জীবিকা সেই বৈষ্যমের শেখরে বাধা থেকে গেল। সেখান থেকেই আবারও কোনো কোনো অঞ্চলের মানুষ যাযাবরের মতো আশ্রয় খুঁজেছে, কোথাও পেয়েছে, কোথাও পায়নি। আমাদের এই ভারতবর্ষে তখন মানুষের জীবনযাত্রা ভারতবর্ষের মধ্যেই ঘুরাফেরা করেছে। বিদেশি কিছু অভিযান এখানে ঘটেছে। তারা এখানে দুর্বল রাষ্ট্রব্যবস্থাকে পরাস্থ করে শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে।
মধ্য এশিয়া, তুরস্ক, ইরান, আরব ইত্যাদি ভূ খণ্ড থেকে কেউ বা এসেছে শাসন করতে, কেউ বা এসেছে তেজারতি করতে, কেউবা ধর্মপ্রচার আবার অনেকেই কর্মসংস্থানের জন্য। মধ্যযুগে শেষ প্রান্তে ইউরোপ মানব জাতির দুর্দশার নানা কারণ যেমন জানাতে চেয়েছে তেমনি আবার ইউরোপের ধনিক গোষ্ঠী অর্থও সম্পদ আহরণের জন্যে দেশে দেশে অভিযান প্রেরণ করেছে। এদের আমরা ভৌগোলিক আবিষ্কারের নামে আসলেই নতুন ভূখণ্ড দখলের মাধ্যমে সম্পদ লুটেপুটে নেওয়ার শক্তি হিসেবে দেখি। এখান থেকে শুরু হয় ইতিহাসের নতুন পর্ব যেখানে অন্য দেশ মানুষ ও সম্পদ দখলের জন্যে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত একটি গোষ্ঠী নতুনভাবে আবিভর্‚ত হয়।
এটিকে উপনিবেশবাদ বলে আমরা জানি। ঔপনিবেশিক যুগে অভিবাসন পঞ্চদশ ষোড়শ শতকে ইউরোপের বেশকিছু শক্তি সমুদ্রপথে অন্যদেশ খোঁজার নামে নানা অভিযান প্রেরণ করে। এর মাধ্যমে অনেকেই ইউরোপ থেকে এশিয়াও আফ্রিকা মহাদেশে বাণিজ্যের নামে প্রবেশ করে। এর বাহিরে অনেকেই সমুদ্রপথে নতুন নতুন ভূখণ্ডের অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। ১৪৯২ সালে কলম্বাস ক্যারিবীয় স্পেনের রাজা ও রানীর ইচ্ছা পূরণের জন্য পুরাতন পৃথিবীতে যাওয়ার নাম করে বের হয়ে আবিষ্কার করলেন ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ। এখানে অচিরেই তারা উপনিবেশ স্থাপনে একের পর এক অভিযান প্রেরণ করে। দক্ষিণ আমেরিকা ভূখণ্ড স্পেন পর্তুগালের খরায়ত্ব হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় উপনিবেশ।
ইউরোপ থেকে দলে দলে মানুষ আটলান্টিক অতিক্রম করে লাতিন আমেরিকায় প্রবেশ করে। আমেরিকাও ভূখণ্ড ও ততদিনে ব্রিটিশদের দখলে চলে যায়। দুই মহাদেশেই ইউরোপীয়দের অভিবাসন চলে। সাথে তারা নিয়ে যায় আফ্রিকা থেকে ধরে ধরে নেওয়া কালো মানুষদের। যাদের তারা বিক্রি করেছে জমি চাষাবাদও বাগান তৈরির জন্য। সেখানেই আফ্রিকার মানুষদের অভিবাসন স্বেচ্ছাই ঘটেনি, ঘটেছে জোরপূর্বকভাবে। গোটা আমেরিকা মহাদেশেই এমন বৈপরীত্যের মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় এবং আফ্রিকানদের অভিবাসন ঘটেছে যেখানে আদিম রেড ইন্ডিয়ানদের জীবন সংকুচিত হয়েছে।
হারিয়েছে তাদের আদিম পরিচয় ও ভাষা-সংস্কৃতি। একইভাবে অস্ট্রেলিয়ায় ইউরোপীয়রা একে একে প্রবেশ ও দখল করে নিল। সেখানে ইউরোপীয়দের অভিবাসন নতুন করে ঘটল। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী অনড়ৎরমরহ রা বিলুপ্ত হতে থাকল। নতুন এই অভিবাসনটি একান্তই উপনিবেশবাদের স্বার্থে ঘটেছে। সে কারণে ইউরোপীয়দের আধিপত্য সেখানে ঘটেছে। তবে এর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব ভিন্নভাবে ঘটেছে। কেননা এইসব অঞ্চল যেভাবে ক্ল্যাসিকেল পদ্ধতিতে বিকশিত হচ্ছিল তাতে আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধির প্রকৃতি ততটা মানুষকে উন্নয়ন হয়তো দিতে পারতো না।
কিন্তু ইউরোপে গত তিন শতকে যে রেনেসাঁস, শিল্পবিপ্লব, ভৌগোলিক আবিষ্কার ১৮ শতকের আলোকিত যুগ, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, বিপ্লব ও শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন দিয়েছে যা উপনিবেশগুলোতেও কমবেশি প্রভাব ফেলেছে, অর্থনৈতিক পরিবর্তন এনেছে, জীবনব্যবস্থায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটিয়েছে। ফলে ইতিবাচক প্রভাব সারা পৃথিবীতে নতুন যে বার্তা দিয়েছে সেটি হলো আধুনিক রাষ্ট্র ও উন্নত জীবনব্যবস্থা। আধুনিক পর্বে অভিবাসন ইউরোপের উপনিবেশবাদীগণ ৩টি মহাদেশে তাদের উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে ইউরোপীয়দের স্থায়ী অভিবাসন করতে পেরেছে। এর দুটি হচ্ছে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ এবং তৃতীয়টি হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ। আগে অভিবাসনের যে ধারা ছিল এটি ঠিক তার বিপরীত চরিত্রের। ইউরোপবাসীদের জায়গার অভাব ছিল না।
খাদ্যেরও সংকট ছিল না। কিন্তু তারপরও তারা উন্নত রাষ্ট্র ও জীবনব্যবস্থা ছেড়ে একেবারেই অনুন্নত অপরিচিত ভূখণ্ডে শাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য, মিশনারি দায়িত্ব পালন, সরকারি দায়িত্ব পালন ইত্যাদি কাজেই তারা গেলেন। তাদের অনেকেই স্থায়ীভাবে থেকে গেলেন। অথচ ইউরোপের অনেকেই অপেক্ষাকৃত উন্নত জায়গা হওয়া সত্তে¡ও এশিয়ার কোনো দেশেই খুব একটা স্থায়ীভাবে থাকার কথা ভাবেনি। যদিও অনেকেই এখানেও শাসনকাজ, ব্যবসা-বাণিজ্য, মিশনারি দায়িত্ব ইত্যাদি পালন করেছিলেন। কিন্তু উপনিবেশ ভেঙে যাওয়ার পর তাদের প্রায় সবাই ইউরোপে ফিরে গেছেন। ফেরেনি উত্তর দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ থেকে অনেকেই।
ঐ তিনটি মহাদেশ এখন যদিও বর্ণ বৈচিত্র্যে ভরপুর। তারপরেও সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ উত্তরাধিকারসূত্রে ইউরোপীয় বংশোদ্ভ‚ত। ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে মার্কিন মুল্লুক এবং লাতিন আমেরিকায় স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা ও রাষ্ট্রব্যবস্থা শুরু হলে পরিস্থিতি নতুন রূপ লাভ করতে থাকে। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার ভাঙন সূচিত হতে থাকে। এশিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশে এর প্রভাব পড়ে ২০ শতকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই দুই মহাদেশে স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। ফলে পৃথিবী থেকে উপনিবেশবাদের অবসান প্রায় পুরোটাই ঘটে যায়। এর ফলে স্বাধীন রাষ্ট্রের উত্থানের যে ধারা তৈরি হয় তাতে পৃথিবীব্যাপী অভিবাসনের ইতিপূর্বেকার বাধাহীন অবস্থায় পরিবর্তন ঘটে। মানুষ চাইলেই এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে পারছে না। ভৌগোলিক সীমানা, পাসপোর্ট, বিদেশি- দেশি ইত্যাদি ধারণা রাষ্ট্রব্যবস্থায় আইন-কানুনের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ফলে অভিবাসনটি এই পর্বে অনেক বেশি কড়াকড়ি নিয়মকানুনের মধ্যে শ্লথ হয়ে পড়ে।
পৃথিবীর এক দেশের মানুষ অন্য দেশে যাওয়া আসার ক্ষেত্রে নাগরিকতার প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এটি ৪/৫ দশক আগে যতটা শিথিল ছিল এখন দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে। বিশেষত ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের ক্ষেত্রে। এই দেশগুলো এক সময় নাগরিকতা প্রদানে যতটা উদার ছিল এখন ক্রমেই তাতে নানা বিধিনিষেধ আরোপিত হচ্ছে। ফলে এইসব দেশে আগে যারা গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছেন এখন নতুনভাবে যারা যেতে চান তাদের যাওয়াটা যেমন কঠিন তেমনি থাকাটাও অনেক কিছুর ওপর নির্ভরশীল। তবে উন্নত আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক, রাষ্ট্র ব্যবস্থার কারণে ঐসব দেশে এখনও অভিবাসনের বৈধ সুযোগ সুবিধা নিয়ে অনেকেই যাচ্ছেন, থাকছেন।
কিন্তু এক সময়ের উপনিবেশগুলোর মধ্যে বেশকিছু রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে এখনো পিছিয়ে থাকায় কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে পারছে না তার ক্রমবর্ধমান জনশক্তিকে। তবে গত শতকের ৮০/৯০ এর দশক থেকে মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও উপক‚লবর্তী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের লাখ লাখ মানুষ কর্মসংস্থানের জন্য অভিগমন করা শুরু করে। এই অভিগমনটি মূলতই চাকরি সূত্রে যাওয়া। স্থায়ীভাবে থাকার সুযোগ এইসব দেশে নেই।
তারপরও লাখ লাখ মানুষ এইসব দেশে কর্মসংস্থানের জন্যই বৈধ-অবৈধ উপায়ে যাচ্ছে। পৃথিবীতে এখন কর্মসূত্রে অভিবাসনের যে নিয়ম চালু হয়েছে তাতে আমাদের দেশেও অনেক উন্নত দেশের নাগরিকরা কর্মসূত্রে আসছেন, কর্মশেষে দেশে ফিরে চলে যাচ্ছেন। তবে যে বিষয়টি ২১ শতকে এসে অভিবাসনের ক্ষেত্রে নানা ধরনের জটিলতা তৈরি করছে তাতে বিপুলসংখ্যক অনুন্নত দেশের যুবশক্তি উন্নত ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমাতে নানা বৈধ-অবৈধ পথের হাতছানিতে সাড়া দিচ্ছে। এ নিয়ে এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকা মহাদেশে আন্তর্জাতিক নানা অভিবাসন দালাল চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
মূলত উন্নত জীবনব্যবস্থার প্রতি স্বপ্নের ঘোর তৈরি হওয়ার কারণে এই তিন মহাদেশের লাখ লাখ তরুণ এই পথে পা বাড়াচ্ছে। আবার আমাদের দেশ থেকে অনেক বেকার যুবকেই মধ্যপ্রাচ্য এবং মালয়েশিয়া মুখী নানা অভিবাসন রুটে দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ছে। অনেকেই এমন অবৈধ অভিবাসনের দিকে পা দিয়ে জীবন হারাচ্ছে। প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১০ লাখ মানুষ বৈধপথে পূর্বে এবং পশ্চিমের মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে চাকরি নিয়ে যাচ্ছেন।
আবার অবৈধপথেও অসংখ্য তরুণ অভিবাসনে সর্বহারা হচ্ছে। সবচেয়ে ভয়ানক অভিজ্ঞতাটি হচ্ছে আমাদের দেশে হাজার হাজার তরুণ ইউরোপে কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কানাডায় পারি জমাতে অবৈধ পথে এমন সব অজানা অচেনা দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ছে যা তাদের অনেকের পরিবারের জীবনের জন্যই বিয়োগান্তক ঘটানার জন্ম দিচ্ছে। ভ‚মধ্যসাগর অবৈধভাবে অতিক্রম করতে গিয়ে আমাদের দেশেরও অসংখ্য তরুণ প্রাণ হারাচ্ছে আবার অনেকে হয়তো পারি জমাতে সক্ষম হচ্ছে।
এ এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। সারাবিশ্বে এখন অভিবাসন নিয়ে চলছে ব্যাপক কড়াকড়ি সমালোচনা এবং নজরদারী। তারপরও উন্নত দেশগুলোতে সুখের আশায় অনেকেই যেমন যেতে চায় আবার অনেকে কর্মসংস্থানের জন্যে সর্বস্ব হারাচ্ছে। অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত অনুন্নত দেশেও অভ্যন্তরীণভাবেও অভিবাসন চলছে। বাংলাদেশের প্রায় ৩০ লাখ বাঙালি এখন পাকিস্তানে আটকে পড়ে আছে। আবার পাকিস্তানের ২ লাখ বিহারি এখানে আতত্ত্বিকরণের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। ভারতে অবৈধভাবে বাংলাদেশের অনেকেই রয়েছে বলে সে দেশের সরকারি সূত্রগুলো দাবি করছে।
বাংলাদেশের প্রায় এক কোটিরও বেশি মানুষ এখন বিশ্বের প্রায় ১৯০টি দেশে কর্মসংস্থানের জন্য রয়েছে। অন্যান্য দেশেরও পরিসংখ্যান নিলে দেখা যাবে এক প্রান্তের মানুষ অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অভিবাসনের নিয়মকানুন, শর্ত, বিধি-ব্যবস্থা ইত্যাদির মধ্যেও পৃথিবীর এক প্রান্তের মানুষ অন্য প্রান্তে বৈধভাবেই যাচ্ছে, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে, যেখানে স্থায়ীভাবে থাকার সুযোগ রয়েছে সেখানে থেকে যাচ্ছে। এখনকার মানুষ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ভিন্ন বাস্তবতায় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় অভিবাসন করছে।
এমনকি ৪/৫ যুগ আগে আমাদের অনেকেরই শেকড় ছিল গ্রামে। একসময় মানুষ নিজ গ্রাম থেকে খুব একটা বাহিরে যেতো না। শহর দেখেছে এমন মানুষ খুব কমই ছিল। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর এই বাংলাদেশেই কোটি কোটি মানুষ এখন গ্রাম থেকে শহরে চলে আসছে। এখানেই এক প্রজন্ম বাসাবাড়ি করে থাকছে। তাদেরই উত্তরসূরিদের অনেকেই কর্মসূত্রে দেশের অন্যত্র চলে যাচ্ছে কিংবা দেশের বাহিরে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশে চলে যাচ্ছে। ওদের সন্তানরা কে কোথায় থাকবে অভিবাসন ঘটাবে তা কেবল ভবিষ্যৎই বলতে পারবে।
আসলে মানুষ ইতিহাসের শুরু থেকেই যে জায়গায় জন্ম নিয়েছে সেখানে আবদ্ধ থাকেনি। সারা পৃথিবী সে ছড়িয়েছে। পৃথিবীর কোনো মাটিই সে স্পর্শ না করে থাকেনি। সর্বত্র মানুষের হাতের স্পর্শে আর মস্তিষ্কের চিন্তাশক্তিতে বদলে গেছে। মানুষ উদ্ভাবন করেছে কর্মসংস্থান। প্রযুক্তি এবং অধিকতর উচ্চতর প্রযুক্তি যা মানুষকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। এখানে দক্ষতাই থাকে কোথায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে সে নিজেও জানে না। বাংলাদেশের অসংখ্য তরুণ আমেরিকার নাসা, গোগল, মাইক্রোসফট ইত্যাদির উচ্চপ্রযুক্তির কর্মক্ষেত্রে যুক্ত রয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে এরপর কোথায় মানুষের অভিবাসন ঘটবে? আগামীর অভিবাসন এখন সাড়া বিশ্বে বিজ্ঞান, শিল্পবিপ্লবের চতুর্থ প্রজন্মে প্রবেশ করেছে। স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির এই যুগে পৃথিবী কোনদিকে যাবে, মানুষ কী করবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। পথের সন্ধানও চলছে, কোনো কোনো বিজ্ঞানী মানুষকে নতুন গ্রহের সন্ধানের ভবিষ্যদ্বাণী করছে। মানুষ চাঁদে যাওয়া নিয়ে অনেক আগেই পদক্ষেপ নিয়েছে। এখন আরো দূরের মঙ্গলগ্রহে যাওয়ার আশ্বাস দিচ্ছে। আসলে এ হচ্ছে মানুষের দৃষ্টিকে অজানা অচেনা জগতের সন্ধানে নিরন্তর বুদ্ধিভিত্তিক চর্চায় মনোনিবেশ করার এক সফল অতীত অভিজ্ঞতার ধারাবাহিকতা।
পৃথিবীতে মানুষের অভিগমন ও অভিবাসনের ফলে প্রকৃতির ওপর যে ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে তাতে এই গ্রহে মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়েও সংখ্যা তৈরি হয়েছে। আদিম যুগ থেকেই মানুষ যখন নতুন নতুন জায়গায় প্রবেশ করেছে তখন সেখানে শিকার ও বসবাসের ফলে পশুপাখি, গাছপালা অনেক কিছুই মানুষের জীবন রক্ষার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আবার মানুষের স্পর্শে অনেক প্রাণীই বিলুপ্ত হয়েছে, মানুষ নিজেও বড় বড় প্রাণী শিকার করে জীবন ধারণ করেছে। এর বাস্তুতাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া প্রকৃতিতে পরেছে বলেই এখন আমরা জলবায়ুর পরিবর্তনের কথা বলছি। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন যে, পৃথিবীর কোনো কোনো অঞ্চল খুব নিকট ভবিষ্যতেই ডুবে যাবে।
আবার অনেক অঞ্চলই মরুভূমিতে পরিণত হবে। এভাবেই মানুষের অস্তিত্ব এই গ্রহে বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটেই বিজ্ঞানীরা নতুন ভূখণ্ড, গ্রহ, উপগ্রহ মানুষের বসবাসের জন্য খুঁজছেন। মানুষ কখনো এক জায়গায় থাকেনি, এখনও থাকছে না, ভবিষ্যতেও থাকবে না। এটি মানুষের জিনগত বৈশিষ্ট্য। সুতরাং মানব ইতিহাসে অভিবাসন অন্য অসংখ্য জিন বৈশিষ্ট্যের অন্যতম একটি।
আপনার মতামত জানানঃ