পরপর তিনবার ক্ষমতায় থাকায় একদিকে যেমন আওয়ামী লীগ দলটি শক্তি ও জনপ্রিয়তায় বড় হচ্ছে অন্যদিকে সংকুচিত হচ্ছে বিএনপিসহ অন্যান্য দল। ক্ষমতাসীন সরকার দলীয় স্থানীয় নেতাকর্মীদের প্রভাবে বিএনপিসহ অন্যান্য দলগুলো অনেকটাই বিলীন হতে বসেছে। ফলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়ছে নিজ দলের নেতাকর্মীদের মধ্যেই। এতে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলের প্রার্থীদের মধ্যে বাড়ছে দ্বন্দ্ব সংঘাত ও সহিংসতা। এতে প্রাণ হারিয়েছেন অনেকেই আহত হয়েছেন শতাধিক।
বিগত কয়েকদিন ধরেই ঢাকা দক্ষিণের বর্তমান মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ও সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের দ্বন্দ্ব চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। পরস্পরের দিকে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে বিদ্ধ হয়েছেন পরস্পর। দ্বন্দ্ব আদালত পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছিল। তার আগে নোয়াখালির বসুরহাট এলাকাতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ভাই আব্দুল কাদের মির্জা মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েও দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও অত্যাচারের কথা ফাঁস করে টক অব দ্য কান্ট্রি হয়েছেন। বিভিন্ন সভা সেমিনারে নিজ দলের লোকদের অপকর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে আলোচনা আসা তিনি এখনো দলের নেতাকর্মীদের বিভিন্ন অপকর্ম তুলে ধরে মন্তব্য করে যাচ্ছেন মাঠজুড়ে।
জানা যায়, মেয়র পদের চেয়ে কাউন্সিলর পদে বেশি সহিংস ঘটনা ঘটছে। এর বড় কারণ হচ্ছে আইনগত দুর্বলতা। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে মেয়র বা চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে ভোট নেওয়ার বিধান আছে। কাউন্সিলর পদে নির্দলীয় প্রতীকে ভোট হচ্ছে। এতে রাজনৈতিক দলগুলো মেয়র পদে প্রার্থী মনোনয়ন দিলেও কেন্দ্রীয়ভাবে কাউন্সিলর পদ উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। স্থানীয়ভাবে এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান বা বড় নেতারা তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন দিচ্ছেন। ফলে একই দলের একাধিক কাউন্সিলর প্রার্থী থাকায় সহিংস ঘটনা বেশি হচ্ছে। যেসব নির্বাচনে মেয়র পদে একই দলের একাধিক প্রার্থী রয়েছে সেখানেও সংঘর্ষ ঘটছে।
গত কয়েকদিনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও কয়েকটি পৌরসভা নির্বাচনের প্রচারে দুপক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। এতে চার জন মারা গেছেন। আহত হয়ে হাসপাতালে গেছেন শতাধিক কর্মী-সমর্থক। সামনের নির্বাচনগুলো ঘিরে সহিংসতার আশঙ্কা আরও বেড়েছে।
গত মঙ্গলবার(১২ জানু) রাতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সহিংসতা ও গোলাগুলির ঘটনায় আলী আজগর বাবুল নামের সরকারি দলের একজন কর্মী মারা গেছেন। ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের দুই কাউন্সিলর প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাহাদুর ও আবদুল কাদেরের সমর্থকদের মধ্যে সহিংসতায় তিনি মারা যান। আহত হন আরও দুই জন। এ দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর একজন দলীয় সমর্থন পেয়েছেন এবং অপরজন বিদ্রোহী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
জানা গেছে, পৌরসভা নির্বাচন ঘিরে বুধবার(১৩ জানু) রাতে ঝিনাইদহের শৈলকুপায় ৮ নম্বর ওয়ার্ডের দুই কাউন্সিলর প্রার্থী শওকত হোসেন ও আলমগীর হোসেন খান বাবুর সমর্থকদের মধ্যে সহিংস ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় কাউন্সিলর প্রার্থী শওকত হোসেনের ভাই লিয়াকত হোসেন বল্টু মারা যান। ওই রাতেই ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী আলমগীর হোসেন খান বাবুর লাশ উদ্ধার করা হয়। প্রার্থী মারা যাওয়ায় ওই ওয়ার্ডের নির্বাচন স্থগিত করেছে ইসি। প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থীই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
একইভাবে বুধবার রাতে উঠান বৈঠক করার সময়ে নরসিংদীর মনোহরদী পৌরসভায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী আমিনুল ইসলামের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। ভাংচুর করা হয় মেয়র প্রার্থীর গাড়িসহ বেশ কয়েকটি যানবাহন। পুড়িয়ে দেওয়া হয় অন্তত ৮টি মোটরসাইকেল। এতে অন্তত ১২ জন আহত হন। একই দিন রাজশাহীর আড়ানী পৌরসভায় আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থী শহিদুজ্জামান শহিদের পথসভায় গুলি ও বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ভাগ্নে তুষার (২৮) আহত হন। তাকে সংকটাপন্ন অবস্থায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের তারাব পৌরসভা নির্বাচনে কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে মঙ্গলবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। ওই ঘটনায় কাউন্সিলর প্রার্থীসহ কয়েকজনকে আটক করেছে পুলিশ।
স্থানীয় পর্যায়ে সহিংসতার বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ ছহুল হোসাইন গণমাধ্যমকে জানান, স্থানীয় পর্যায়ের ইস্যু নিয়ে সহিংসতার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এর বড় কারণ হচ্ছে একই পদে একই দলের একাধিক প্রার্থী নির্বাচনী মাঠে থাকা। তিনি বলেন, একাধিক প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের নিজস্ব অবস্থান রয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ের ইস্যু নিয়ে তারা সহিংসতায় লিপ্ত হচ্ছেন। সরকারি দলের প্রার্থীদের মধ্যে এ প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বিগত অন্যান্য নির্বাচনের তুলনায় এবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থী ও সমর্থকদের মধ্যে সহিংস ঘটনা কম। তবে একই দলের একাধিক প্রার্থীর মধ্যে সহিংসতার প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। এমনকি বিভিন্ন পর্যায় থেকে যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে সেখানে এ ধরনের চিত্র উঠে আসছে। এছাড়া কোথাও কোথাও নির্বাচন ইস্যু বানাতে নানা তৎপরতার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। ওইসব তথ্য অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকার বিএনপিসহ অন্যান্য দলগুলোকে বিভিন্ন কৌশনে কোণঠাসা করে রাখার ফলে স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে সরকার দলীয় লোকদের অংশগ্রহণ বেশি এবং নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিজ দলের লোকদের মধ্যেই সহিংসতায় রুপ নিচ্ছে। তারা মনে করেন, গণতন্ত্রে প্রতিপক্ষ কোনো দল না থাকলে একটি দল থেকেই বিভিন্ন দিকে প্রতিপক্ষ তৈরী হতে থাকে এবং এতে নিজেদের মধ্যেই সহিংসতা চলতে থাকে। নির্বাচনের অপশন যেহেতু আছে সেখানে প্রতিপক্ষ বলে একটি অপশন অন্যান্য দলগুলোর অনুপস্থিতিতে নিজ দলের মধ্যেই বিভাজন তৈরী হয় এবং তা রুপ নেয় সহিংসতার দিকে। আর এতে সাধারণ লোক সহ অনেকেরই প্রাণহানি ঘটে, আহত হয়, সন্ত্রাস ও আতঙ্ক বাড়ে রাষ্ট্রে। এবিষয়ে সরকারসহ স্থানীয় প্রশাসনের কড়া নজরদারি দাবি করেন তারা।
এসডব্লিউ/ডিজে/কেএইচ/১৮০৪
আপনার মতামত জানানঃ