পর্দাপ্রথা ঠিক কবে, কীভাবে এ উপমহাদেশে চালু হয়েছিল তার কোনো সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ কিংবা বন্দোবস্তের কথা বলা সম্ভব নয়। আর পর্দা বলতে কোনো এক ধরনের পোশাক, কিংবা অন্তঃপুরও চোখে ভেসে ওঠে না। পর্দাপ্রথা নিয়ে তর্কবিতর্কের শেষ নেই। ধর্ম, সম্প্রদায়, সমাজের বিবর্তন, আধুনিকতা—এমন জটিল, বিশদ সব আইডিয়া জড়িয়ে আছে পর্দাপ্রথার সঙ্গে।
ইউরোপীয়রা এ অঞ্চলে আসার পর অন্তঃপুরের নারীদের জীবন নিয়ে আগ্রহী হয়েছিলেন। জেনানা মহলে কী ঘটে, কেমনতর তার জীবন—এসব জানতে মেমসাহেবরা যেতেন অন্তঃপুরে। আধুনিকতার নানা স্রোতে ইউরোপে পর্দা সরিয়ে নারীরা প্রকাশ্য জীবনে চলে এসেছেন আরো আগে। তাই ভারতীয় নারীদের জীবন তাদের কাছে পশ্চাৎপদ মনে হতে থাকে।
ইউরোপীয় মানসে পর্দার নানা সত্য-মিথ্যা কাহিনী রচিত হতে থাকে। হিন্দু সমাজ তখন ‘দায়’ এড়ালেন মুসলিম শাসকদের অজুহাতে। তারা বলতে শুরু করলেন, পর্দাপ্রথা আমাদের সংস্কৃতি নয়। মুসলিমদের হাত থেকে মান বাঁচাতে আর তাদের রীতির অনুকরণে কালে কালে হিন্দু সমাজে পর্দা চালু হয়েছে।
কিন্তু এমন ইতিহাস শুনিয়ে শিক্ষিত বাবুসমাজ নিশ্চিন্ত হতে চাইলেও তখন প্রশ্ন উঠল, যদি এমনটাই হবে তাহলে ‘অসূর্যম্পশ্যরূপা’, অন্তঃপুরিকা’—এমন শব্দগুলো কোথা হতে এলে? এগুলো তো আরবি কিংবা ফারসি শব্দ নয়। আদতে মুসলিম শাসনের সূচনার অনেক আগে থেকেই অবগুণ্ঠন. ঘোমটার প্রচলন ছিল ভারতে।
সংস্কৃত-প্রাকৃত সাহিত্যে এ অবগুণ্ঠনের উল্লেখ পাওয়া যায়। আর পর্দা বা অন্তঃপুর মূলত ছিল অভিজাত ঘরের নারীদের জন্য। সাধারণের জীবনে পর্দা মেনে চলা কঠিন ছিল।
বৌদ্ধ মহাযান সাহিত্য ‘ললিতাবিস্তার সূত্র’তে পাওয়া যায়, নায়িকা অবগুণ্ঠন ব্যবহার না করায় সমালোচনা শুরু হয় সমাজে। সে সমালোচনার জবাব দেন নায়িকা। এমনকি একসময় তার যুক্তিতর্কের সামনে হার মানে সমাজপতিরা। এ কাহিনী খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের।
অন্তত উদাহরণটি বুঝিয়ে দেয়, পর্দা ভারতীয় সংস্কৃতিতে মুসলিমদের আগমনের আগেই উপস্থিত ছিল। ভারতে নারীদের পর্দা বা অবরোধ প্রথাকে আনুষ্ঠানিক বা লিখিত রূপ দিয়েছিলেন অর্থশাস্ত্রের জনক কৌটিল্য বা চাণক্য। তিনি রাজপরিবারের নারীদের অন্তঃপুরে রাখার ব্যবস্থা চালু করার কথা লিখেছেন। এবং সে অন্তঃপুরের গঠন কেমন হবে তা-ও সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বহু কক্ষবিশিষ্ট হারেম তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন, যেখানে একটি কামরা থাকবে আরেকটি কামরার মধ্যে।
কৌটিল্য যে মৌর্য সাম্রাজ্যের কিংমেকার ছিলেন সে যুগে রাজঘরানার নারীদের জীবন কাটত প্রাচীর ও পরিখাবেষ্টিত অন্তঃপুরে। তাদের পাহারায় থাকতেন আবার নারী রক্ষীবাহিনী।
রাজপরিবারের নারীদের জীবন কাটত অসূর্যম্পশ্যা হয়ে। মেগাস্থিনিসের বিবরণীতেও এমন বন্দোবস্তের কথা জানা যায়। অন্তঃপুরে নজরদারি করার জন্য রাজার ছিল বিশেষ নারী গুপ্তচর। অন্তঃপুর ছিল রীতিমতো এক গুপ্তচরশালা।
ভূস্বামী, জমিদার ক্ষমতাবানরা দুর্বল ঘরের নারী, স্ত্রীর দিকে হাত বাড়াতেন—এমন ঘটনার উদাহরণ মেলে অনেক ভারতীয় রচনায়। রাজায় রাজায় যুদ্ধে পরাজিতের সম্পদ, নারী হরণ ছিল নিয়মের মতো। নারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি খুবই স্থানীয় পর্যায় থেকেই বিবেচনার বিষয় ছিল।
আবার রানী কিংবা অভিজাত ঘরের নারীরা অনেক সময় যুক্ত হতেন প্রাসাদ রাজনীতিতে। তাতে সিংহাসনে বিদ্যমান রাজার জীবন শঙ্কায় পড়ত। এমন ঘটনা রোধ করতে কৌটিল্য ছিলেন কঠোর। তিনি কড়া নির্দেশ রেখে গেছেন যেন অন্তঃপুরের নারীদের বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেয়া না হয়। নিজের দেয়া বিধানের সপক্ষে কৌটিল্য একটি ঘটনাও তুলে ধরেছিলেন,
রাজা ভদ্রসেনকে হত্যা করেছিলেন তার নিজের ভাই। আগে থেকেই সে বিশ্বাসঘাতক লুকিয়েছিল মহারানীর কক্ষে। একইভাবে রানীর পালঙ্কের তলায় আশ্রয় নিয়ে মহারাজা কুরুশকে হত্যা করেছিল তার নিজের পুত্র। আবার কাশীরাজকে হত্যা করেন স্বয়ং মহারানী। খইয়ের সঙ্গে মধুর বদলে বিষ মাখিয়ে দেন তিনি।
এদিকে রাজা বৈরাণতেয়কে রাজমহিষী হত্যা করেছিলেন এক অভিনব উপায়ে। তার পায়ের নূপুরে ছিল বিষের প্রলেপ। মেখলার রত্নখচিত কটিবন্ধে বিষ লেপন করে রাজা সৌবীরকে হত্যা করেছিলেন তার রানী। দর্পণে বিষ মাখিয়ে রাজা জালুথাকে হত্যা করা হয়েছিল। সে হত্যাকাণ্ডের পেছনেও ছিল মহারানীর হাত। আর রাজা বিদুরথকে সরাসরি অস্ত্র দ্বারাই হত্যা করেছিলেন তার মহারানী। সে অস্ত্র লুকিয়ে রাখা ছিল রাজমহিষীর অলকদামে।
বিশিষ্ট ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্র তার মধ্যযুগের ভারত গ্রন্থে লিখেছেন—এ যুগে নারীদের আলাদা রাখা এবং বাইরের মানুষদের সামনে তাদের ঘোমটা টানার রীতি অর্থাৎ, পর্দাপ্রথা অভিজাত ঘরের নারীদের মধ্যে বিস্তৃতি লাভ করে। অশ্লীল দৃষ্টি থেকে বাঁচাতে নারীদের আলাদা রাখার চর্চা উচ্চবংশীয় হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। এমন চর্চা ছিল প্রাচীন গ্রিস ও ইরানে।
আরব ও তুর্কিরাও এমন ঐতিহ্য গ্রহণ করেছিল এবং তাদের হাত ধরে এ রীতি ভারতেও এসেছিল। তাদের মাধ্যমে পর্দাপ্রথা এ অঞ্চলে বিশেষত উত্তর ভারতে বিস্তৃতি লাভ করে। পর্দাপ্রথার বিস্তৃতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণটি ছিল সম্ভবত সামাজিক—এটা সমাজে উচ্চবংশীয়দের মর্যাদার প্রতীক হয়ে ওঠে। আর যারাই সমাজে সম্মানীয় হতে চাইছিলেন তারা এ প্রথা অনুকরণ শুরু করেন।
একই সঙ্গে এর পেছনে ছিল ধর্মীয় যুক্তিও। কারণ যা-ই হোক এ প্রথা সে যুগে নারীদের পুরুষের ওপর আরো বেশি নির্ভরশীল করে তুলেছিল।
বাংলার মধ্যযুগের সাহিত্যে পর্দার তেমন উল্লেখ নেই। ধারণা করা হয়, মূলত মোগল যুগে উত্তর ভারত থেকে পর্দাপ্রথা বাংলায় জনপ্রিয় হয়েছিল। উনিশ শতকের পত্রপত্রিকায় নারীর পর্দাপ্রথার সমর্থনে নানা ধরনের লেখা প্রকাশিত হতে দেখা যায়।
১৮৬৪ সালের আগস্টে বামাবোধিনী পত্রিকায় লেখা হয়েছে, স্ত্রীলোকেরা প্রকাশ্য স্থানে বাহির হইলে যখন কিছুমাত্র উপকার না হইয়া কেবল অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা তখন প্রকাশ্য স্থলে যাওয়া ঈশ্বরের নিয়মবিরুদ্ধ আচরণ করা হয়। অতএব ইহাকে যথার্থ স্বাধীনতা না বলিয়া স্বেচ্ছাচারিতা বলা যায়।
তাহারা বাহির হইলেই ইন্দ্রিয় পরাধীন দুরাত্মারা তাহাদিগকে আক্রমণ করিয়া এককালে বিনাশ করিয়া ফেলিবে অতএব এরূপ অনুচিত কর্ম্মে এখন কাহার যোগ দেওয়া উচিত বোধ হয় না।
শনিবার, ২৪ মে, ১৯৩০। পটুয়াখালী শহরে শোনা গেল এক অদ্ভুত ঘটনার কথা। পটুয়াখালী তখন পূর্ববঙ্গের বাকেরগঞ্জ জেলার একটি শহর। এদিন পটুয়াখালীতে গান্ধীর সত্যগ্রহ আন্দোলনের পক্ষে হরতাল ডাকা হয়। ভোরবেলা নারীরা দল বেঁধে ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের তাদের দপ্তরে যেতে বাধা দিলেন।
ভারতীয় বিচারক যখন আদালতে পৌঁছলেন নারীরা তাকেও আটকে দিলেন। এদিনের ঘটনা ছিল বিচ্ছিন্ন। কিন্তু কয়েকদিন পর, ৪ জুন একই রকম ঘটনা ঘটল নোয়াখালীতে। নারীরা আদালতে যাওয়ার পথগুলো অবরোধ করলেন। ২২ জুন শোনা গেল কলকাতা শহরে নারীদের বিক্ষোভের কথা। বাংলা সরকারের মুখ্য সচিব লিখলেন, নারীরা সত্যগ্রহ আন্দোলনের পক্ষে বিভিন্ন গণবিক্ষোভে অংশ নিচ্ছেন।
এ ঘটনাগুলো ছিল অভূতপূর্ব। নারীরা ঐতিহ্যগত প্রথা ভেঙে আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করছিলেন। সমাজেও ধীরে ধীরে সে বাস্তবতাকে গ্রহণের শর্ত তৈরি হয়েছিল।
আপনার মতামত জানানঃ