বাঙালির জীবনযাপনের সঙ্গে ‘বাটা’ বেশ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। আদতে এটির সঙ্গে যে বাংলার কোনো যোগসূত্র নেই—এমনটা বললে হয়ত অনেকেই বিশ্বাস করবেন না। এর নামের সঙ্গে মিল রেখেই ঢাকায় একটি জায়গার নাম রাখা হয়েছে ‘বাটা সিগন্যাল’। তাছাড়া একসময় বাটার জুতা পরেননি, এমন মানুষের সংখ্যা ছিল খুবই হাতেগোনা।
‘অ্যাপেক্স’, ‘লোটো’, কিংবা ‘বে’—ছোট বড় নানা দামের নানা মানের জুতা মেলে বাজারে। কিন্তু অবিসংবাদী নেতা একশ বছরের পুরোনো ব্র্যান্ড ‘বাটা’। বহুজাতিক জুতা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় সুইজারল্যান্ডের লুসানে অবস্থিত। ৫০টিরও অধিক দেশে বাটা কোম্পানির শাখা রয়েছে। ২৬টি দেশে বাটার জুতা তৈরির কারখানা রয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাটা কোম্পানি ১৪ বিলিয়নেরও অধিক জুতা বিক্রি করেছে।
১৮৯৪ সালের কথা। সদ্য বেরিয়েছে রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’। মধ্য ইউরোপে বরফঢাকা আল্পসের এপার-ওপার জুড়ে তখন রাজত্ব করছে বিখ্যাত অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্য। আজকে যেখানে চেক প্রজাতন্ত্র, এককালে তারই নাম ছিল মোরাভিয়া। তার এক ছোট্ট শহর জিন, একেবারেই গঞ্জের মত। সেখানে একটি জুতার দোকান খোলে তিন ভাইবোন। বড়ভাই টমাস বাটা, তার দুই ভাইবোন, আঁতোয়া ও অ্যান। জাতে চেক। পারিবারিক সূত্রেই তাদের চামড়ার ব্যবসা ছিল। অবস্থা যদিও সুবিধার ছিল না। হাতে সম্বল ছিল মায়ের দেওয়া আটশো গাল্ডেন, অস্ট্রিয়ার সেকালের মুদ্রা।
কিন্তু শুরু থেকেই উদ্ভাবনীর দিকে জোর দিয়েছিলেন তারা। মাত্র দশজন কর্মী ছিল। কিন্তু চামড়ার বদলে ক্যানভাস দিয়ে জুতা বানানো শুরু করেন টমাস। বেজায় জনপ্রিয় হয়েছিল সেই জুতা। ব্যবসা বাড়তে শুরু করলো। উৎপাদন বাড়াতে টমাস নিয়ে এলেন মেশিন। কীভাবে আরো উন্নত মেশিন নিয়ে আসা যায় জানতে জাহাজে চড়ে আমেরিকার বস্টন শহর থেকেও ঘুরে এলেন তিনি। ফল মিলেছিল হাতেনাতে। ১৯০৪ সালের মধ্যেই বাটার প্রতিদিন জুতার উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ২২০০ জোড়া। ১৯১২ সালের মধ্যে কর্মী বেড়ে দাঁড়ালো ৬০০ জনে।
ততদিনে ইউরোপের রাজনীতির আকাশে ছেয়ে আসছে যুদ্ধের কালো মেঘ। একদিকে প্রুশিয়ার উত্থান, অন্যদিকে বলকান জাতীয়তাবাদের মাথাচাড়া দেওয়া, মাঝে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির টালমাটাল দশা। ১৯১৪ সালের ২৮ জুন সারাজেভো শহরে অস্ট্রেলিয়ার যুবরাজ ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দের হত্যার পরে গোটা বসনিয়া জুড়ে যেন আগুন জ্বলে উঠল।
তারপর একে একে গোটা ইউরোপ গ্রাস করা সেই বিধ্বংসী আগুনের নাম ‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধ’। সৈনিকদের মধ্যে ভালো জুতার তীব্র চাহিদা দেখা দিল বাজারে। একধাক্কায় বাটার জুতার বিক্রি বেড়ে গেল কয়েক গুণ। ব্যবসা ইউরোপ থেকে ছড়িয়ে পড়ল মধ্যপ্রাচ্যে, আমেরিকায়, এশিয়ায়।
১৯৩২ সালে সরকারিভাবে বাটা পা রাখে ভারতে। তখনও ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী কলকাতা, তথা পূর্ব ভারত। বাটার প্রথম ফ্যাক্টরি খুলেছিল হুগলির তীরে, কোন্নগরে। দুই বছর পরে, ১৯৩৪ সালের জানুয়ারিতে নদীর আরও দক্ষিণে, বন্দরের খুব কাছেই বিরাট জায়গা নিয়ে নতুন কারখানা শুরু করে বাটা। কার্যত সেই কারখানা ও তার বিক্রির টানেই হুড়মুড়িয়ে বেড়ে যায় জনসংখ্যা। ছোটখাটো একটা শহরই হয়ে যায় সেখানে। বাটার জুতার হাত ধরেই আজ যার নাম ‘বাটানগর’। এককালে এটিই ছিল এশিয়ার সবচেয়ে বড় জুতার কারখানা।
বস্তুত, বিশ্বজুড়েই টমাস বাটার ‘স্ট্র্যাটেজি’ ছিল এরকমই। ছোটখাটো গঞ্জ দেখে কারখানা খুলতেন, তারপর তাকে ঘিরে তৈরি হত শহর। নেদারল্যান্ডসের ‘বাটাডোর্প’, ফ্রান্সের ‘বাটাভিল’, কানাডার ‘বাটাওয়া’, ব্রাজিলের সাও পাওলোর কাছে ‘বাটাতুবা’ এমনকি পাকিস্তানেও রয়েছে ‘বাটাপুর’—সৌজন্যে বাটার জুতার কারখানা।
১৯৬০ সালে। বাংলাদেশ তখনো পূর্ব পাকিস্তান। বাংলার মানুষ সবেমাত্র ভাষার অধিকার আদায় করেছে, তখনই বাটা আসে। পশ্চিমের শাসকদের নিত্য বঞ্চনা, বৈষম্য পূর্ব ভূখণ্ডের মানুষের প্রতি। পণ্য উৎপাদন হয় পূর্বে, কারখানা হয় পশ্চিমে। আয় করে পূর্ব, সুবিধা ভোগ করে পশ্চিম। প্রতিদিন বড় হচ্ছে বঞ্চনার তালিকা, আর একটু একটু করে তৈরি হচ্ছে অসন্তোষ।
পাকিস্তানিরা বাংলাভাষীদের গুরুত্বের সঙ্গে না দেখলেও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান বাটা এ ভূখণ্ডের সম্ভাবনা দেখতে পায়। ১৯৬২ সালে তারা একটি কারখানা তৈরি করে পূর্ব পাকিস্তানে। সেই কারখানাটাই হয়ে যায় বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অংশ।
১৯৭০ সালে হল্যান্ডে জন্ম নেয়া অস্ট্রেলীয় নাগরিক উইলিয়াম এ এস ওডারল্যান্ড বাংলাদেশে এসেছিলেন বাটার নির্বাহী পরিচালক হিসেবে। পাকিস্তানি সৈন্যদের ধ্বংসযজ্ঞ, ওডারল্যান্ড তার পক্ষ নির্ধারণ করে ফেলেন। শুধু তা–ই নয়, ওডারল্যান্ড নিজেও জীবন বিপন্ন করে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। তার নেতৃত্বে টঙ্গী-ভৈরব রেললাইনের ব্রিজ, কালভার্ট ধ্বংস করে যোগাযোগব্যবস্থা বিপর্যস্ত করেন মুক্তিযোদ্ধারা।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বিদেশি এই বন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ওডারল্যান্ডকে ভূষিত করে বীর প্রতীক খেতাবে। ওডারল্যান্ডই একমাত্র বিদেশি, যিনি এই রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত হয়েছেন।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৬৪ একর জায়গা নিয়ে বাটার দুটি কারখানা; একটা ধামরাই আরেকটা টঙ্গীতে। এখানে কাজ করেন ৩ হাজার কর্মী। শুধু দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখা নয়, বাটা বাংলাদেশের মানুষের জীবনে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ও পরম আস্থার নাম।
আপনার মতামত জানানঃ