‘গিলগামেশ’, ‘এনুমা এলিস’, ‘নিমরুড’ বা ‘আজেকা ইনস্ক্রিপশন’— বিশ্বের প্রাচীনতম গ্রন্থের প্রসঙ্গ কথা উঠলেই একবাক্যে উচ্চারিত হয় এইসব ট্যাবলেটের নাম। যার মধ্যে সবচেয়ে ‘প্রবীণ’ গিলগামেশ মহাকাব্য। মজার বিষয় হল, এই প্রতিটি গ্রন্থই লেখা হয়েছিল এশিয়ায়।
পাওয়া গিয়েছিল অ্যাসিরিয়ার সম্রাট অসুরবনিপালের লাইব্রেরি থেকে। প্রশ্ন থেকে যায়, সমসাময়িক সময়ে কি কোনো গ্রন্থই লেখা হয়নি ইউরোপে? ইউরোপ মহাদেশের দিক থেকে দেখতে গেলে প্রাচীনতম গ্রন্থই বা কোনটি?
১৯৬২ সাল। উত্তর গ্রিসের (Greece) থেসালোনিকি অঞ্চলের ৬ মাইল উত্তরে এক আশ্চর্য প্রত্নক্ষেত্রের সন্ধান পান গবেষকরা। মূলত যা একটি প্রাচীন শ্মশান। তবে ‘আশ্চর্য’ বলা এই কারণে, কেন-না ছাই-এর স্তূপের মধ্যেই উদ্ধার হয়েছিল বেশ কিছু অক্ষত মানব-খুলি।
অনুমান, প্রতিটি খুলিই চ্যালকোলিথিক বা তাম্রপ্রস্তর যুগের। স্বাভাবিকভাবেই এই আবিষ্কারের পর শুরু হয়েছিল প্রত্নতাত্ত্বিক খনন। আর তাতে উঠে আসে একের পর এক আশ্চর্য সামগ্রী। সেই তালিকায় রয়েছে একাধিক ধাতব পাত্র, হাতিয়ার, দৈনন্দিনের সরঞ্জাম ও পুড়ে যাওয়া একট প্যাপিরাসের রোল।
গ্রিসের থেসালোনিকি থেকে উদ্ধার হওয়া এই প্যাপিরাসের রোলটিই এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত হওয়া ইউরোপের সবচেয়ে প্রাচীন গ্রন্থ। প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে যা পরিচিত ‘ডেরভানি প্যাপিরাস’ (Derveni Papyrus) নামে। ‘ডেরভানি প্যাপিরাস’-কে বিশ্বের প্রাচীনতম ম্যানুস্ক্রিপ্ট বা পাণ্ডুলিপি বললেও ভুল হয় না এতটুকু।
কারণ, এশিয়ায় প্রাপ্ত বিশ্বের প্রাচীনতম গ্রন্থ ‘গিলগামেশ’ লেখা হয়েছিল আদতে মাটির তৈরি ট্যাবলেটের ওপরে। অন্যদিকে ইউরোপের এই প্রাচীন নিদর্শন প্যাপিরাসে লেখা। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, প্রাচীন এই গ্রন্থের বিষয় বস্তু কী?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতেই কয়েক দশক লেগে গিয়েছিল গবেষকদের। তার অন্যতম কারণ, বছরের পর বছর মাটি ও ছাইয়ের তলায় চাপা পড়ে থাকায় জুড়ে গিয়েছিল প্রাচীন এই গ্রন্থের পৃষ্ঠাগুলি।
রোলটিকে সম্পূর্ণভাবে খুলে, পাতাগুলিকে আলাদা করাই হয়ে উঠেছিল গবেষকদের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। তবে দুঃসাধ্য এই কাজ শেষ হলেও, সম্পূর্ণ গ্রন্থটি পড়া সম্ভব হয়নি আজও। কারণ, আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়ে গেছে প্রতিটি পাতার নিচের অংশ।
‘ডেরভানি প্যাপিরাস’-এর অবশিষ্টাংশের বিশ্লেষণে জানা যায়, এই গ্রন্থ লেখা হয়েছিল ২৬টি কলামে ভাগ করে। যা মূলত প্রাচীন আরফিক কবিতার একটি রূপক ভাষ্য।
বিষয়, দেবতাদের জন্মবৃত্তান্ত এবং গ্রিক দর্শন। মূল চরিত্র হিসাবে এই গ্রন্থে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে গ্রিক দেবী ও জিউসের কন্যা পার্সিফোন এবং সুধারসের দেবতা ডায়োনিসাসকে। তাঁদের পরলোক-যাত্রার পর পুনরায় জীবিত অবস্থায় পৃথিবীতে ফিরে আসার ঘটনাই লিখিত হয়েছিল এই গ্রন্থে।
কার্বন ডেটিং অনুযায়ী, এই গ্রন্থের বয়স প্রায় ২৩০০ বছর। আনুমানিক ৩২০ বা ৩৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে লেখা হয়েছিল ‘ডেরভানি প্যাপিরাস’। তবে তার লেখক আদতে কে, তা জানা যায়নি আজও। পাশাপাশি কেনই বা তা পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল সমাধিক্ষেত্রে— তাও রহস্য হয়েই রয়ে গেছে আজও। বছর কয়েক আগে ‘মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ প্রকল্পে গ্রিসের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবাহী প্রত্নসামগ্রী হিসাবে এই প্রাচীন গ্রন্থকে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো।
তবে ‘ডেরভানি প্যাপিরাস’-ই ইউরোপে লেখা প্রথম বই নয়। বরং, এই পাণ্ডুলিপি থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়, এর আগেও গ্রিসে লেখা হয়েছিল বেশ কিছু গ্রন্থ, যারা হারিয়ে গেছে সময়ের আবহে। সূত্র: প্রহর।
আপনার মতামত জানানঃ