উলের ব্যবহার শুরু হয়েছিল প্রায় চার হাজার বছর আগে। মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা বস্ত্র। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ বিভিন্ন উপাদানের মাধ্যমে কাপড় তৈরি করছে। সেসব উপাদানের অন্যতম ভেড়ার উল।
বিভিন্ন কারণে অন্যান্য উদ্ভিজ্জ তন্তুর তুলনায় উল অধিক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। উদ্ভিজ্জ তন্তুগুলো রঙ করা বেশ কঠিন ছিল। কিন্তু উল প্রাকৃতিকভাবেই বিভিন্ন রঙের হয়। তাছাড়া এটিকে খুব সহজেই বিভিন্ন উজ্জ্বল রঙে রাঙানো সম্ভব ছিল। অন্যান্য তন্তুর তুলনায় উল সংগ্রহ করাও বেশ সহজ ছিল। এজন্য কৃষিজমির প্রয়োজন নেই। জমি চষা, বীজ বোনা, আগাছা উপড়ানো, ফসল তোলা ইত্যাদির কোনো ঝামেলা নেই।
কেবল একটি চারণভূমি থাকলেই হলো। তাই উদ্ভিজ্জ তন্তুর তুলনায় খুব কম সময় ও পরিশ্রমে অধিক উল উৎপাদন করা সম্ভব ছিল। উদ্ভিজ্জ তন্তুর ক্ষেত্রে জমির গুণগত মান ও আবহাওয়া প্রভাব ফেলত। কিন্তু উলের ক্ষেত্রে সে সমস্যা ছিল না। অন্যান্য তন্তুর তুলনায় উল অধিকতর টেকসই। এর গঠন প্যাঁচানো। এর স্থিতিস্থাপকতা বেশি। টেনে ধরলে উল লম্বা হয়। ছেড়ে দিলে আগের অবস্থায় ফিরে যায়। কটন ও সিল্কের তুলনায় উলের প্রাকৃতিক স্থিতিস্থাপকতা ৭-১০ গুণ বেশি। তাই উলের তৈরি পোশাক সহজে ছিঁড়ে না বা ক্ষয় হয় না। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ও গরম উভয় আবহাওয়ায়ই উলের পোশাক আরামদায়ক।
উলের বৈশিষ্ট্য হলো তা শরীরে প্রয়োজনীয় তাপ ধরে রাখতে পারে। আবার অতিরিক্ত তাপ বের করে দিতে পারে। মরুভূমিতে দিনে গরম ও রাতে ঠাণ্ডা। তাই মরুবাসীরা উলের জামা পরিধান করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। উলের বিশেষ গঠনের কারণে এটি অগ্নি প্রতিরোধক হিসেবেও ভূমিকা রাখে। এসব কারণে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বস্ত্র শিল্পে উল ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ছোট পরিবারের ক্ষেত্রে মেষপালন বেশ লাভজনক ছিল। অল্পসংখ্যক মেষ থেকেই পরিবারের সদস্যদের কাপড় তৈরিতে প্রয়োজনীয় উলের চাহিদা পূরণ হতো।
মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন অধিবাসীরা তাদের খাদ্য ও বস্ত্রের জন্য মেষের ওপর নির্ভরশীল ছিল। পরে তারা সুতা তৈরি ও কাপড় বোনার কৌশল আবিষ্কার করে। পর্যায়ক্রমে উল ব্যাবিলনের অন্যতম সম্পদে পরিণত হয়েছিল। উলের তৈরি জামার উষ্ণতা মানুষকে বিভিন্ন শীতপ্রধান অঞ্চলে সভ্যতা বিস্তারে সহায়তা করেছিল। খ্রিস্টপূর্ব তিন থেকে এক হাজার বছর আগে পারসীয়, গ্রিক ও রোমানদের মাধ্যমে সমগ্র ইউরোপে উন্নত জাতের ভেড়া ছড়িয়ে পড়ে।
রোমানরা যেখানেই সাম্রাজ্য স্থাপন করত, সেখানেই ভেড়া নিয়ে যেত। তাদের মাধ্যমে স্পেন, উত্তর আফ্রিকা ও ব্রিটেনে ভেড়ার উলের ব্যবহার বহুল প্রচলিত হয়। ৫০ খ্রিস্টাব্দে রোমানরা ইংল্যান্ডের উইনচেস্টার শহরে একটি উলের কারখানা স্থাপন করেছিল। আট শতকে আরবরা স্পেন জয় করে। সেখান থেকে তারা উত্তর আফ্রিকা, গ্রিস, মিসর ও কনস্টান্টিনোপলে ব্যাপক হারে উল রফতানি শুরু করেছিল।
বারো শতকে নরম্যানরা গ্রিস দখল করে। তারা গ্রিসের অসংখ্য বয়নকারীকে দাস হিসেবে পালেরমোয় পাঠিয়েছিল। বয়ন শিল্পে তারা খুবই দক্ষ ও উন্নত ছিল। তাদের কাছ থেকে ইতালীয় বয়নকারীরা প্রশিক্ষণ নেয়। ফলে ফ্লোরেন্স, জেনোয়া ও ভেনিসসহ ইতালির বিভিন্ন শহরে উলের পোশাক তৈরি বিস্তৃত হয়।
স্পেনে উলের ব্যবসা ছিল জমজমাট। বলা হয় কলম্বাসের সমুদ্র অভিযানের অর্থ এ ব্যবসা থেকেই এসেছিল। আর উলের প্রধান উৎস ছিল ভেড়া। তাই স্পেন কঠোরভাবে ভেড়া রফতানি নিষিদ্ধ করেছিল। ১৭৮৬ সাল পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বলবৎ ছিল। ভেড়া রফতানিকারীকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হতো। ১৭৮৬ সালে এ নিষেধাজ্ঞা রহিত হওয়ার পর ফ্রান্সের রাজা ষোড়শ লুই স্পেন থেকে বিশেষ জাতের ৩৮৬টি মেয়ে ভেড়া আমদানি করেছিলেন। এ জাতের নাম ‘মেরিনো’।
অন্যান্য জাতের তুলনায় এ জাতের ভেড়ার উল অধিকতর উন্নত ও নরম। রাজা ষোড়শ লুই তার রাজ্যের ভেড়ার সঙ্গে মেরিনো ভেড়ার প্রজননের মাধ্যমে ভেড়ার নতুন জাত উৎপাদন করেন। এ জাতের ভেড়া ‘র্যামবুয়ে’ নামে পরিচিত। চমৎকার ও লম্বা উলের জন্য বিশ্বে র্যামবুয়ে ভেড়ার চাহিদা অনেক বেশি।
স্পেনের মতো ইংল্যান্ডও ভেড়া ও উল রফতানি নিষিদ্ধ করেছিল। চৌদ্দ শতকে ইংল্যান্ডের একজন রাজা ছিলেন তৃতীয় এডওয়ার্ড। তিনি ‘দ্য রয়েল উল মার্চেন্ট’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৩৭৭ সালে রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ড উলের তৈরি পোশাক আমদানি নিষিদ্ধ করেন। তিনি বিদেশী উল দিয়ে দেশে পোশাক তৈরিকেও নিষিদ্ধ করেন। স্পেনের আক্রমণে পালিয়ে বেড়ানো ফ্লেমিশ বয়নকারীদের তিনি ইংল্যান্ডে বসতি স্থাপনের আমন্ত্রণ জানান। তাদের মাধ্যমে ইংল্যান্ডে উল শিল্প বিস্তার লাভ করে। ১৬৬০ সালের মধ্যে উলের পোশাক রফতানি ইংল্যান্ডের বৈদেশিক বাণিজ্যের দুই-তৃতীয়াংশ দখল করে নিয়েছিল।
ইংল্যান্ড উত্তর আমেরিকায় উল শিল্পকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করেছিল। তথাপি চোরাচালানের মাধ্যমে সে অঞ্চলে কিছু ভেড়া চলে গিয়েছিল। ১৬৬৫ সালের মধ্যে উত্তর আমেরিকায় ভেড়ার সংখ্যা লাখের ঘরে পৌঁছায়। সুতা তৈরি ও বয়নকর্মে যুবকদের নিয়োজিত করার জন্য ম্যসাচুসেটসে আইন পাস হয়েছিল। উল শিল্পকে ঘিরে সেখানে অনেক ঐতিহ্য ও লোককাহিনী গড়ে ওঠে। পরিবারের অবিবাহিত বড় মেয়ের ওপর সুতা তৈরির দায়িত্ব বর্তাত। সেখান থেকেই কুমারী অর্থে ‘স্পিনস্টার’ শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়েছিল।
ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় জর্জ উপনিবেশগুলোয় উলের ব্যবসা দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। এ ধরনের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তির ডান হাত কেটে দেয়া হতো। কিন্তু উল ব্যবসাকে ব্যাহত করার জন্য রাজার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রে উল শিল্প বিস্তৃত হয়েছিল। দেশটির প্রথম ও তৃতীয় প্রেসিডেন্ট যথাক্রমে জর্জ ওয়াশিংটন ও থমাস জেফারসনের ভেড়ার পাল ছিল। উভয়েই অভিষেক অনুষ্ঠানে উলের তৈরি স্যুট পরেছিলেন।
উল প্রক্রিয়াজাতের জন্য স্পিনিং জেনি, কম্বিং মেশিন ও ওয়াটার-পাওয়ারড লুমের মতো নতুন মেশিন আবিষ্কৃত হতে থাকে। আঠারো-উনিশ শতকে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকায় উল শিল্প স্থাপিত হয়। একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে, ‘অস্ট্রেলিয়া ভেড়ার পিঠে চড়ে তৈরি হয়েছে।’ অস্ট্রেলিয়ায় বসতি স্থাপনকারীরা ভূমি দখল ও পরিষ্কার করে ভেড়া পালন শুরু করেছিল। সে সম্পদের মাধ্যমেই বর্তমান অস্ট্রেলিয়ার ভিত্তি তৈরি হয়েছিল।
বিভিন্ন সংস্কৃতিতে উল গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ইনকা জাতি তাদের পোশাক তৈরিতে বহুল পরিমাণে উল ব্যবহার করত। তারা বয়ন শিল্পে খুবই দক্ষ ছিল। জামা ছাড়াও উল দিয়ে তারা কম্বল, পনচো (এক ধরনের পোশাক) ও চাদর তৈরি করত। প্রায়ই এসব পোশাক মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করা হতো। ধর্মীয় ও গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এসব পোশাক পরার বিধান ছিল।
নিউজিল্যান্ডের মাউরি আদিবাসীদের সংস্কৃতিতে উল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পোশাক তৈরিতে উলের ব্যবহার নিয়ে তাদের দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। উলের তৈরি পোশাক ছিল তাদের কাছে সামাজিক মর্যাদা ও বিত্তের প্রতীক। লাদাখে বসবাসকারী একটি যাযাবর গোষ্ঠীর নাম চাংপা। তারা ‘কাশ্মীরি উল’ নামে খুবই উন্নত মানের উল উৎপাদন করে। উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকায় অনেক যাযাবর জাতি বাস করে।
এদের মধ্যে হাউসা, টুয়ারেগ ও বারবার গোষ্ঠীর নাম উল্লেখযোগ্য। এসব গোষ্ঠীর উৎপাদিত দ্রব্যের মধ্যে উল অন্যতম। তারা মেরিনো উল উৎপাদনে বিখ্যাত। কোমলতা ও স্থায়িত্বে এ ধরনের উল বিশ্বে খুবই জনপ্রিয়। তাছাড়া মঙ্গোলিয়ার যাযাবররা, উত্তর মেরুর ইনুইট ও স্কটল্যান্ডের আদিবাসীরাও উল উৎপাদনে বিখ্যাত।
উলের ব্যবহার শুরু প্রাচীনকালে। মধ্যযুগে এর ব্যবহার ও বাণিজ্য বিস্তৃত হয়। প্রাচীন ও মধ্যযুগের নানা ঘটনাপ্রবাহ পেরিয়ে আধুনিক মানুষের কাছেও আছে উলের জনপ্রিয়তা।
আপনার মতামত জানানঃ