মোহিনী আক্তার তামিম বদরুননেসা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এবার উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। তিনি একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। তার প্রতিবন্ধী ভাতার টাকা তার মায়ের মোবাইলে যায়। এক ব্যক্তি তার মাকে ফোন করে সমাজসেবা অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে বলে, তার বিকাশ নম্বরে একটু ঝামেলা আছে তা পরিবর্তনের জন্য পিন নম্বরটি প্রয়োজন। তার মা পিন নম্বর দিলে তিন বারে তার নগদ অ্যাকাউন্ট থেকে ১২ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় দুষ্টচক্র।
শুধু প্রতিবন্ধী ব্যক্তি মোহিনীই নয়, দুস্থ অসহায় প্রবীণ ভাতাপ্রাপ্ত এমন অগণিত ব্যক্তিকে সমাজসেবা অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে নানা প্রলোভনে পিন নম্বর, ওটিপি জেনে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে দুষ্টচক্র। সমাজসেবা অধিদপ্তর বলছে, বর্তমানে এটি তাদের জন্য একটি বড় প্রতিবন্ধকতা।
অসহায় অশিক্ষিত ব্যক্তিরা নানা কারণে তাদের ফাঁদে পা দিচ্ছে। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) কর্তৃপক্ষ বলছে ভয়, অজ্ঞতা এবং লোভকে কাজে লাগিয়ে নানা কৌশলে প্রতারক চক্র গ্রাহকদের ফাঁদে ফেলছে। কোনো অবস্থাতে পিন, ওপিটি কাউকে না বলার ওপর জোর দেন তারা।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি কামাল হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে চাকরি খুঁজছেন। গত ১০ জানুয়ারি তার মোবাইলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে একজন ফোন করে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্মার্ট কার্ড দেওয়া হবে। ১০২৪ আপনার স্মার্ট কার্ডের নম্বর, আপনি এসে কার্ডটি নিয়ে যান।
আর এজন্য আপনার বিকাশ অ্যাকাউন্টের পিন নম্বরটি প্রয়োজন, কামাল শিক্ষিত হওয়ায় জানতেন কাউকে তার পিন নম্বর দেওয়া যাবে না। তাই সেই ব্যক্তিকে তিনি বলেন, আমি সমাজসেবা অধিদপ্তরে এসে কার্ড নেওয়ার সময়ই পিন নম্বর দেব, তত্ক্ষণাত্ লাইনটি কেটে দেওয়া হয়। কামাল জানান, শুধু তাকে নয় এমন অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে ঠকিয়ে প্রতিবন্ধী ভাতার টাকা কয়েক দফায় নিয়ে যায় প্রতারক চক্র। একেক বার একেক রকম গল্প বলে।
সন্ধ্যারানী নওয়াবপুর সুইপার কলোনিতে বাস করেন। তার বয়স্কভাতা তুলতে গেলে বিকাশ এজেন্ট তাকে বলেন, তার কোনো টাকা আসেনি। অথচ তিনি জেনেই এসেছিলেন তার বিকাশ অ্যাকাউন্টে বয়স্কভাতার টাকা এসেছে। পরে তার পরিবার খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, এর আগে সন্ধ্যারানী ঐ বিকাশ এজেন্টকে তার পিন নম্বর জানিয়েছিলেন। এখন তিনি আবার তার টাকা তুলতে এলে আগে নিজের মোবাইলে টাকা সরিয়ে নিয়ে এজেন্ট জানান তার কোনো টাকা আসেনি।
বিকাশ হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশনস শামসুদ্দিন হাদার ডালিম ইত্তেফাককে জানান, বিকাশ কর্তৃক পরিচালিত একটি মনোসামাজিক গবেষণায় দেখা গেছে, ভয়, অজ্ঞতা এবং লোভকে কাজে লাগিয়ে নানা কৌশলে প্রতারক চক্র গ্রাহকদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলছে।
এজন্য সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছে বিকাশ। আর নগদের হেড অব মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন জাহিদুল ইসলাম সজল জানান, শিক্ষা উপবৃত্তি, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতাসহ এমন অনেক সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় থাকা ব্যক্তিরা প্রতারিত হচ্ছেন প্রতিদিন। তিনি বলেন, পরিস্থিত এমন হচ্ছে যে, অনেক সময় আমদের নিয়ন্ত্রণ রাখাও খুব কঠিন হয়ে পড়ছে। এ পরিস্থিতিতে কোনো অবস্থাতেই গ্রাহকদের পিন ও ওটিপি কারো কাছে না বলার পরামর্শ দেন তারা।
তবে সমাজসেবা অধিদপ্তরের সামাজিক নিরাপত্তা বিভাগের পরিচালক ড. মো. মোক্তার হোসেন বলেন, এই মানুষগুলো এতটাই অসচেতন ও অশিক্ষিত যে, তারা ১-২ চেনে না। পিন, ওপিটি কিছুই বুঝতে পারে না। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১ কোটি ১৬ লাখ লোক মোবাইল ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ভাতা পাবেন। তিনি বলেন, বর্তমানে এটি তাদের জন্য একটি বড় প্রতিবন্ধকতা।
তারা টাকা তুলতে গেলে এজেন্টকে পিন জানিয়ে দেয়, আবার তার নিকটাত্মীয়, ছেলে, নাতিও তার পিন জেনে তার সঙ্গে প্রতারণা করে। তাই নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন। তিনি বলেন, এখন আমরা নানাভাবে প্রচারণার কাজ করছি। কারো পিন ও ওপিটি কাউকে না জানানোর জন্য এলাকায় মাইকিংও করা হচ্ছে। বিটিভিতে প্রতিদিন রাত পৌনে ১০টায় এ সম্পর্কিত অনুষ্ঠানেও বিষয়টি জানানো হচ্ছে। কত শতাংশ মানুষ এখন প্রতারিত হচ্ছে, কিংবা কত টাকা যাচ্ছে, তার হিসাব না থাকলেও তিনি মনে করেন প্রতি ইউনিয়নে ভাতার টাকা তোলার সময় দুই-তিন জন প্রতারিত হচ্ছে।
আপনার মতামত জানানঃ