আবুল ফজলের বিবরণমতে বাংলা, বিহার ও ওড়িশার প্রতি সম্রাট আকবরের পরিকল্পনার পথে সোলায়মান কররানি একটি শক্তিশালী বাধা ছিলেন। শেরশাহ ধীরে ধীরে শক্তিশালী শাসক হিসেবে পূর্বাঞ্চলে তার আবির্ভূত হওয়া আকবরকে একটা উপযুক্ত মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বাধ্য করেছিল। সোলায়মান কররানির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সেই উপযুক্ত মুহূর্তটির আগমন ঘটে। ভাইসরয় মুনিম খানের কাজটি আরো সহজ হয়ে ওঠে দাউদ কর্তৃক লোদি খানকে হত্যার মধ্য দিয়ে। লোদি খানের মৃত্যু মুনিম খানকে বিহার আক্রমণে উৎসাহিত করে।
অধিকন্তু সম্রাট আকবর মুনিম খানের কাছে এ লক্ষ্য অর্জনে বারবার আদেশ পাঠাতে থাকেন এবং সেনাধ্যক্ষের পর সেনাধ্যক্ষ প্রেরণ করেন। রিয়াজের মতে, ‘আকবরের বাহিনী আক্রমণের জন্য বিরাট সৈন্যবহর নিয়ে দাউদ সোনে নদীর তীরে অগ্রসর হন। সোনে, শ্র এবং গঙ্গা নদীর সঙ্গমস্থলে বিশাল নৌযুদ্ধ সংঘটিত হয়। অবশেষে আকবরের ভাগ্যে বিজয় আসে। উৎপাটিত হয়ে আফগানরা পালাতে থাকে এবং পাটনায় আশ্রয় নেয়।’১
মুনিম খান তার অগ্রসরমাণ মোগলদের নিয়ে সোনে নদী অতিক্রম করেন, যেহেতু তাকে বাধা দেয়ার মতো কেউ ছিল না। আবুল ফজল বলেন, ‘শাহানশাহের দৈনন্দিন ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ার কারণে দাউদ এ ধরনের সৈন্য ও অস্ত্র সত্ত্বেও কাপুরুষের মতো পালালেন এবং নিজে পাটনার দুর্গে আবদ্ধ থাকলেন।’২ ১৫৭৩ সালের নভেম্বরের প্রথম দিকে মুনিম খান পাটনার দিকে অগ্রসর হন এবং শাল্লা নগরীকে অবরুদ্ধ করে ফেলেন। পুনপুন নদীর বাঁধ ভেঙে ফেলার জন্য তিনি মাজনুন খান কাকশাল এবং অন্যান্য মোগল কর্মকর্তাকে পাঠালেন। পুনপুন নদীটি পাটনার দশ মাইল পূর্বে গঙ্গা নদীতে এসে মিশেছে। বাঁধটি পাহারারত আফগান প্রধান সোলায়মান মানকালী এবং বাবুই মানকালী রাত্রিকালীন আক্রমণে হতবাক হয়ে যান এবং নিজেদের অবহেলায় লজ্জিত হয়ে ঘোড়াঘাটের দিকে পালিয়ে যান।
পাটনা অবরোধ অবশ্য খুব বেশি অগ্রগতি সাধন করতে পারেনি। এটা গঙ্গা নদী দ্বারা সুরক্ষিত ছিল এবং মোগল সেনাদের অবরোধ এই দুর্গটি অবজ্ঞা করেছিল। ১৫৭৩ সালের অক্টোবরে গুজরাট বিজয় শেষে প্রত্যাবর্তনের পর মুনিম খানকে সাহায্যের জন্য আকবর একটার পর একটা সেনাপ্রধান প্রেরণ করতে থাকেন। ১৫৭৮ সালের এপ্রিল মাসে মুনিম খান আকবরকে জানালেন যে অবরোধ ঠিকমতো কাজ করছে না। একই বছরের ১৫ জুন আকবর নিজেই পাটনার উদ্দেশে রওনা হলেন এবং তার উপস্থিতি এখানকার পরিস্থিতি পুরোপুরি পাল্টে দেয়। পাটনা গঙ্গা নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত।
পাটনার বিপরীতে গঙ্গা নদীর উত্তর তীরে হাজীপুর অবস্থিত। হাজীপুর এতদিন পাটনার রসদ জোগানদার হিসেবে কাজ করত। পাটনার এতদিনের অবরোধ কার্যকর হয়নি এজন্য যে তার রসদ সরবরাহ যেত হাজীপুর থেকে। আকবর তাৎক্ষণিক হাজীপুর দখলের ব্যবস্থা নিলেন এবং দুর্গটি খান-ই-আলমের কাছে শিগগিরই পতন হলো।
হাজীপুরের পতন মোগলদের বিরুদ্ধে আফগান প্রতিরোধের মনোবলকে ভেঙে ফেলে। নিমাত আল্লার মতানুসারে৪, দাউদকে দুর্গ ছাড়তে বাধ্য করা গেল না। ১৫৭৪ সালের ১০ আগস্ট কাতলু এবং অন্যান্য আফগান প্রধানরা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে দাউদকে মাদক সেবন করালেন এবং অজ্ঞান অবস্থায় একটি নৌকা করে রাজধানী তান্ডায় নিয়ে এলেন। দাউদের উজির শ্রীহরি সমস্ত সম্পদ একটা নৌকায় তুলে দাউদকে অনুসরণ করে বাংলার দিকে যাত্রা করেন। সেনাদল ও হাতি নিয়ে গুজার খান পাটনা থেকে বেরিয়ে এলেন। রাত্রিটা ছিল অন্ধকারাছন্ন। অবিরাম বৃষ্টি হচ্ছিল। নদীর স্রোত ছিল স্ফীত এবং আশপাশের গ্রাম ছিল প্লাবিত।
এ ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়কর অবস্থায় স্থান ত্যাগ ছিল দাউদের বাহিনীর জন্য ধ্বংসাত্মক। অসংখ্য সেনা দুর্গের আশপাশে গর্তে ডুবে মারা যায়, বিশাল সংখ্যায় লোকজন নদীতে ডুবে যায়, আর ভীত হাতির দল অনেককে পিষে মেরে ফেলে; পলায়মান সৈন্য সামন্তদের চাপে নদীর ওপর সেতুটি ভেঙে পড়ে। ফলে অনেক সৈন্য ও হাতি পুনপুন নদীতে ডুবে মারা যায়। পরের দিন সকালে আকবর শূন্য দুর্গটি দখলে নেন এবং নিজেই পলায়মান আফগানদের পিছু ধাওয়া করেন। দ্রুতই গুজার খানকে ঘিরে ফেলা হয় কিন্তু তিনি পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেন হাতি ফেলে রেখেই। বিপদ উপেক্ষা করে আকবর ধাওয়ায় নেতৃত্ব দিয়েই চলেন।
তিনি ঘোড়ার পিঠে চড়ে পুনপুন নদী সাঁতরিয়ে পার হলেন। শুধু পাটনা থেকে ৬০ মাইল পূর্বে গ্র্যান্ড ট্র্যাংক রোডে গঙ্গা নদীর পাশে দরিয়াপুরে থামলেন। এভাবে বিহার থেকে দাউদকে বিতাড়িত করার পর এবং দাউদ ও তার আফগানদের বাংলা থেকে নির্মূল করতে মুনিম খানকে নির্দেশ দানের পর আকবর ১৫৭৪ সালের ২৪ আগস্ট রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করেন।৫ আকবরের আগমনের এক পক্ষকালের মধ্যেই দাউদের পরাজয় নিশ্চিত হয়।
১৫৭৪ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে মোগলরা বস্তুত কোনো বিরোধিতা ছাড়াই আফগানদের কাছে থেকে সুরুজগড়, মুঙ্গের, ভাগলপুর, কোলগাঁও এবং অন্যান্য স্থান দখল করে নেয়। পাটনা থেকে বিপর্যয়কর পশ্চাদপসরণ করার পর আফগানরা নিজেরাই কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। কালাপাহাড়, সোলায়মান মানকালী এবং বাবুই মানকালীর নেতৃত্বে একটি ভাগ ঘোড়াঘাটের দিকে চলে যায়। দাউদের নেতৃত্বে অন্য দলটি তান্ডায় আশ্রয় নেয়। ইসমাইল সিলাহদারের তত্ত্বাবধানে একটি ছোট দল তেলিয়াগড়ের গিরিপথ রক্ষার্থে থেকে যায়। তেলিয়াগড়ের গিরিপথ অতিক্রম করে যাওয়াটা মুনিম খানের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।
অবশ্য তিনি স্থানীয় কিছু জমিদারকে প্রভাবিত করে একটি গোপন পথের সন্ধান লাভ করেছিলেন। যে পথে এক ডিভিশন মোগল সৈন্য অগ্রসর হয়ে আফগানদের পেছন দিক থেকে আক্রমণ করে।৬ তাই পরিকল্পনাটি ভালোভাবেই সফল হয়। একই সময়ে সম্মুখভাগ ও পশ্চাদভাগ উভয় দিক থেকে আক্রমণ হওয়ায় ছোট একটি সেনাদল নিয়ে ইসমাইল সিলাহদারের পক্ষে মোগলদের বিরুদ্ধে লড়াই করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়লে তিনি পিছু হটে যান। বস্তুত তেমন কোনো লড়াই ছাড়াই তেলিয়াগড়ও মোগলদের কাছে পতন ঘটে। মুনিম খান ও টোডরমল আরো এগিয়ে যান। দাউদ তান্ডা ত্যাগ করেন এবং ওড়িশায় পিছু হটেন। মুনিম খান ও টোডরমল কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই তান্ডা দখল করেন।
এখন তিনি নিজেকেই রাজ্যের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলো গোছাতে মনোনিবেশ করেন। মুনিম খান চিরুনি অভিযান পরিচালনা করে আফগানদের বিভিন্ন শক্তিশালী ঘাঁটি থেকে সরিয়ে দিতে অনেকগুলো সেনাদল পাঠান। মুহম্মদ কুলি খান বারলার নেতৃত্বে একটি দল দাউদের পিছু ধাওয়া করে এবং নিজেরা সাতগাঁওয়ে অবস্থান নেয়। মজনুন খান কাকশাল ও বাবু খান কাকশালের নেতৃত্বে একটি দল পাঠানো হয় ঘোড়াঘাটের দিকে। মুরাদ খানের নেতৃত্বে আর একটি দল ফতেহাবাদ ও বাকলার দিকে যায়। ইতিমাদ খানের নেতৃত্বে চতুর্থ দলটিকে সোনারগাঁওয়ের দিকে প্রেরণ করা হয়।৭
সুতরাং এটা বলা যায় যে দাউদের ওড়িশায় পালানোর সঙ্গে সঙ্গে উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণবঙ্গে আফগানরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ঘোড়াঘাটে সোলায়মান মানকালী, কালাপাহাড় ও অপরাপর আফগান প্রধানরা মাজনুন খান কাকশালের নেতৃত্বাধীন মোগল বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেন। আফগানরা পরাজিত হয়। সোলায়মান মানকালীকে যুদ্ধক্ষেত্রে হত্যা করা হয়। আফগান বাহিনীর অবশিষ্টাংশ কোচবিহারে পালিয়ে যায়। আর তাদের পরিবার ও পোষ্যদের মোগলদের হাতে বন্দি রেখে যায়।
মাজনুন খান ঘোড়াঘাট দখল করেন এবং তার পুত্রকে সোলায়মান মানকালীর মেয়ের সাথে বিয়ে দেন। ‘মুনতাখাব আল তাওয়ারিখ’-এর তথ্যানুসারে মৃত সূর সুলতান জালাল উদ্দীনের (সুলতান গিয়াস উদ্দিন জালাল শাহ সূর) সন্তানেরাও ঘোড়াঘাটের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল (যে যুদ্ধে আফগানরা পরাজিত হয়)।৮ দাউদের উজির শ্রীহরি প্রভুর সঙ্গ ত্যাগ করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ নিয়ে যশোরে পালিয়ে যান।৯ মোগল সেনাধ্যক্ষ মহম্মদ কুলি খান বারলার আগমনে দাউদ মোগলদের সাথে লড়াই করার জন্য দেবরাকসাই (মেদিনীপুর শহর থেকে ১৫ মাইল পূর্বে) নামক দুর্গে নিজেকে আবদ্ধ করেন। কিন্তু টোডরমলের বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধির জন্য মুহম্মদ কুলি খান বারলা মান্দারান থেকে কুলিয়া (মেদিনীপুর শহর থেকে ২৩ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে) অভিমুখে রওনা হন। তিনি হরিপুর গড়ে ধরাশায়ী হন। এটি বাংলা-নাগপুর রেলওয়ের দান্তন স্টেশনের ১১ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত।১০ তাই দাউদ ওড়িশায় অবসর গ্রহণ করলে বাংলার উত্তর, পশ্চিম, কেন্দ্র ও দক্ষিণে কোনো সংগঠিত আফগান শক্তির উপস্থিতি পাওয়া যায় না।
এরই মধ্যে যখন আফগান প্রধানদের বাংলার আনাচে-কানাচে ছত্রভঙ্গ অবস্থায় একের পর এক পতন হচ্ছিল তখন ইমাদ কররানির পুত্র জুনায়েদ কররানি, যিনি বাংলার সিংহাসনের কোনো উপেক্ষণীয় উত্তরাধিকারী ছিলেন না, ঝাড়খণ্ডের (বীরভূম জেলার গঙ্গা নদীর দক্ষিণের স্থলভূমি) জঙ্গলে আবির্ভূত হন এবং মোগলদের সমস্যার কারণ হয়ে ওঠেন।১১ এই জুনায়েদ কররানি দেবরাকসায়ে অবস্থানরত দাউদের সঙ্গে যোগ দিতে চান।
ভীষণ বিপদে থাকা দাউদ তার এই ধীর ও দুঃসাহসিক ভাইয়ের প্রতি আস্থা রাখতে পারেননি, যা প্রকারান্তরে আফগান স্বার্থের অনুকূলে যেত। দাউদ মোগলদের বিরুদ্ধে জুনায়েদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হতে ব্যর্থ হন। হতাশ হয়ে জুনায়েদ ঝাড়খণ্ডে তার সুরক্ষিত দুর্গে ফিরে যান কিন্তু বিহারে মোগলদের জন্য একটা প্রতিবন্ধকতা হয়ে থাকেন।১২
১৫৭৫ সালে মুনিম খান এবং রাজা টোডরমল দাউদের খোঁজে একটা পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। মোগলরা ওড়িশার দিকে অগ্রসর হয়। দাউদ তার পরিবারকে কটকে রেখে নিজে হরিপুর তাঁবুতে আশ্রয় নেন। পরিখা খনন করে এবং ইটের দেয়াল নির্মাণ করে তিনি তার তাঁবুকে দুর্গায়িত করেন। মেদিনীপুর থেকে হরিপুর গড় পর্যন্ত চলমান রাস্তার গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অবস্থানে তিনি প্রতিবন্ধকতা স্থাপন করেন।১৩ মুনিম খান তার বাহিনী নিয়ে এ পথে অগ্রসর হওয়াটা কষ্টসাধ্য মনে করলেন কারণ বর্ষাকাল শুরু হয়ে গিয়েছিল এবং রাস্তাটাও খারাপ ছিল।
অধিকন্তু মুহম্মদ কুলি বারলার মৃত্যুর পর মোগল সৈন্যরা হতাশ হয়ে পড়েছিল, কারণ তারা এ জঙ্গলে অভিযান চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে আপত্তি জানিয়েছিল।১৪ তবে স্থানীয় জনগণের সহায়তায় একটা নতুন পথ আবিষ্কৃত হয়। সেই পথে অগ্রসর হয়ে মোগলরা আফগানদের মুখোমুখি হয় তুকারয় নামক স্থানে ১৫৭৫ সালের ৩ মার্চে। এখানে একটা যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধটা মোগলমারির যুদ্ধ নামে খ্যাত।১৫
আফগান ও মোগল উভয় দলই তাদের সেনাদের সনাতনী পদ্ধতিতে সাজালেন। কিন্তু মোগল বাহিনীর পার্থক্যটা হলো এই যে তাদের অতিরিক্ত ডিভিশনকে আলতামাস (altamash) বা অগ্রগামী দলের ঠিক পেছনের দল হিসেবে রাখা হয়। মোগলদের সামনে কামান আর আফগানদের সম্মুখে ছিল ‘তস্করের’ এক বিশাল বাহিনী। এ চলমান পর্বতগুলোকে আরো ভয়ংকর করে তোলা হয় চামড়া দিয়ে মুড়িয়ে এবং তাদের মাথা ও দাঁত থেকে অসংখ্য কালো বন্য প্রাণীর লেজ ঝুলিয়ে রেখে।১৬
আফগান বাহিনীর সম্মুখভাগে গুজার খান এবং মোগল বাহিনীর সম্মুখভাগে ছিলেন মুনিম খান। জ্যোতিষীরা দিনটি শুভ নয় মর্মে মত দিলে সেদিন যুদ্ধ করার কোনো ইচ্ছা মুনিম খানের ছিল না। আফগানরা এগিয়ে আসছে বুঝতে পেরে মোগল সেনাধ্যক্ষ আলম খান অধৈর্য হয়ে উঠলেন। কাজেই মোগল সৈন্য বিন্যাস সমাপ্ত হওয়ার আগেই তিনি আক্রমণ করার জন্য উৎসাহিত বোধ করেন। মুনিম খান আলম খানকে ডেকে পাঠান।১৭ এই ধরনের সিদ্ধান্তহীনতা মোগল সৈন্যদের দ্বিধায় ফেলে দেয়। পক্ষান্তরে আফগান সেনাপ্রধান অত্যন্ত ক্ষিপ্ততার সঙ্গে মোগলদের আক্রমণ করেন এবং আলম খানকে হত্যা করেন।
১৮ এমনকি তিনি ‘আলতামাস’ বা সম্মুখভাগের পেছনের অতিরিক্ত কেন্দ্রীয় সেনাদের তাড়িয়ে দেন। ফলে সর্বাত্মক চেষ্টা সত্ত্বেও মুনিম খান তার সৈন্যদের মাঠে রাখতে পারলেন না। মুনিম খান তরবারি উন্মুক্ত রেখে চাবুক মেরে যখন তার পলায়মান সৈন্যদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন, ঠিক সেই সময় গুজার খান এসে তাকে সংঘর্ষে জড়িয়ে ফেলেন। অশীতিপর এই সেনাধ্যক্ষ গুজার খানের তরবারির আঘাতের পর আঘাতে তাঁর চাবুকের হাতল দিয়ে প্রতিহত করতে থাকেন এবং মারাত্মকভাবে আহত হন। হঠাৎ করেই কিছু ভক্ত সেখানে উপস্থিত হয় এবং তারা জোর করে তার ঘোড়ার লাগাম টেনে তাকে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে যায়। তিনি বেশ অনেক দূরেই গিয়ে অবস্থান করেন।১৯
তুকারয় মোগলমারি থেকে আট মাইল দক্ষিণে অবস্থিত। ভট্টশালীর মতে, যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল তুকারয় ও মোগলমারির মধ্যবর্তী সমতল ভূমিতে। তাই আফগান সেনাদলের সম্মুখভাগ মোগল বাহিনীর প্রধান অংশটিকে ধ্বংস করতে অক্ষম হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধ পূর্ণভাগ জয়ের আগেই লুটপাটের প্রতি লোভ তাদের বিজয়কে বিধ্বস্ত করে দেয়। কিয়া খান এবং অন্যান্য মোগল সেনাধ্যক্ষ লুটপাটরত আফগান সেনাদের ওপর আক্রমণ করে বসেন। অজ্ঞাত হাত থেকে নিক্ষিপ্ত একটি ধনুক গুজার খানের মস্তিষ্ক ভেদ করে গেলে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে নিহত হন।
গুজার খানের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তার অগ্রসরমাণ বিজয়ী সেনাদল মুহূর্তেই জীবন রক্ষার্থে পলায়মান একটি উচ্ছৃঙ্খল জনতায় পরিণত হয়ে মুহূর্তেই মিলিয়ে যায়। আফগান সেনাদলের বিধ্বস্ত হওয়ার সংবাদ অন্যান্য আফগান উপদলকে মানসিকভাবে বিপর্যন্ত করে দেয়।২০ টোডরমল ও শাহাম খান মাঠে অনড় থেকে দাউদের মুখোমুখি হন। এরই মধ্যে শাহাম খান আফগান সেনাদলের বাম অংশকে তাড়িয়ে দিয়ে টোডরমলের সমর্থনে এগিয়ে যেতে সক্ষম হন।
তাদের সমন্বিত শক্তির সামনে দাউদ টিকতে পারলেন না এবং ওড়িশার দিকে পালিয়ে গেলেন। আফগান বন্দিদের তরবারির আঘাতে শিরশ্ছেদ করা হলো এবং তাদের বিভিন্ন মস্তক দিয়ে আটটি মিনার তৈরি করা হলো। মোগলদের জয় করা তুকারয়ের যুদ্ধের এই ছিল চিত্র।২১ ভট্টশালীর পর্যবেক্ষণ হলো, যুদ্ধের পরিচিত নাম মোগলমারির যুদ্ধ (অর্থাৎ মোগলদের তাণ্ডব) ব্যাপকভাবে যুদ্ধে মোগলদের কার্যক্রমের জনসমর্থন লিপিবদ্ধ করে।
তুকারয়ের যুদ্ধে বাংলার সার্বভৌমত্ব আফগানদের হাত থেকে মোগলদের হাতে বদল হয়। যুদ্ধটি ছিল মোগলদের জন্য সিদ্ধান্তকারী বিজয় চিত্র। তাদের অনেক উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীকে হত্যা করা হয়েছিল এবং অনেকেই আহত হয়েছিলেন। তুকারয়ের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দাউদ কটকে চলে যান এবং অবরোধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তারা কটকের গভর্নর খান জাহান তাকে মোগলদের বিরুদ্ধে আবার যুদ্ধ করতে উৎসাহিত করেন।
কিন্তু দাউদ যুদ্ধের জন্য তার প্রস্তুতির অপ্রতুলতা এবং কটক থেকেও তাকে তাড়িয়ে দেয়ার মোগলদের দৃঢ়তা বুঝতে পেরে মোগলদের সঙ্গে দরকষাকষিকে শ্রেয় মনে করেন। যুদ্ধবিধস্ত মোগলরা প্রস্তাবকে স্বাগত জানান এবং টোডরমল, মুনিম খান ও অন্যান্য কর্মকর্তার প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও একটি শান্তি চুক্তিকে বেশি সুবিধাজনক মনে করেন।
আপনার মতামত জানানঃ