মানুষের মতো উগান্ডার বন্য শিম্পাঞ্জিদের মেনোপজের (রজঃনিবৃত্তি) হয় বলে নতুন এক গবেষণায় জানা যায়। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে এসব শিম্পাঞ্জিদের প্রজনন ক্ষমতা কমে যায়। মানুষের স্ত্রী প্রজাতির মধ্যে মেনোপজের বৈশিষ্ট্য কীভাবে বিকশিত হলো সে সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে এই গবেষণা।
এখন পর্যন্ত মানুষসহ মাত্র তিনটি প্রজাতির মধ্যে মেনোপজের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকার কথা জানা যায়। বাকি দুটি প্রজাতি হলো—অরকা বা শিকারি তিমি এবং ছোট পাখনাযুক্ত পাইলট তিমি। তবে এত দিন ধারণা করা হতো, প্রাইমেটদের মধ্যে একমাত্র মানুষই জীবনের একটি পর্যায়ে গিয়ে প্রজনন সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস অ্যাঞ্জেলেসের সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষণার প্রধান লেখক ব্রায়ান উড বলেন, ‘মানুষের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে তা আকর্ষণীয় তবে চ্যালেঞ্জিং একটি ধাঁধা।’
কারণ একটি নির্দিষ্ট বয়সে এসে প্রজনন ক্ষমতা হারানোর মধ্যে কোনো সুস্পষ্ট বিবর্তনীয় সুবিধা নেই। তবে গবেষকেরা বলছেন, মেনোপজ শুরু হওয়ার পর নারীরা শিশুদের আরও ভালোভাবে যত্ন নেওয়ার সুযোগ পায়। এটি শিশুদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বাড়ানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এর মাধ্যমে প্রজাতির রক্ষা হয় এবং পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে জিনগত বৈশিষ্ট্য প্রবাহিত হওয়া নিশ্চিত হয়। এটি ‘গ্র্যান্ডমাদার হাইপোথিসিস’ নামে পরিচিত।
সায়েন্স জার্নালে গত ২৬ অক্টোবর প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্য প্রাইমেটদের মধ্যে মেনোপজ হয় কি না তা জানতে গবেষকেরা মানুষের নিকটতম জীবিত আত্মীয় যেমন, পূর্বাঞ্চলীয় শিম্পাঞ্জি প্রজাতির মধ্যে গবেষণা চালিয়েছেন।
উড ও তাঁর সহকর্মীরা উগান্ডায় ১৯৯৫ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ২১ বছর কিবেইল ন্যাশনাল পার্কের এনগোগো শিম্পাঞ্জিদের সংখ্যাগত ও উর্বরতার তথ্য সংগ্রহ করেন। গবেষকেরা ১৮৫টি স্ত্রী শিম্পাঞ্জির রেকর্ড বিশ্লেষণ করেন। তাঁরা দেখতে পান, ৩০ বছর বয়সের পর স্ত্রী শিম্পাঞ্জিদের প্রজনন সক্ষমতা কমে যায় এবং ৫০ বছর বয়স থেকে এরা আর সন্তান জন্ম দেয়নি। যদিও এ বয়সের পরও অনেক স্ত্রী শিম্পাঞ্জি দীর্ঘ দিন বেঁচে ছিল।
এনগোগো স্ত্রী শিম্পাঞ্জিরা প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের এক–পঞ্চমাংশ সময় প্রজননে অক্ষম থাকে। অনুপাতটি হাদজা জনগোষ্ঠীর মতো আধুনিক শিকারি মানব সম্প্রদায়ের নারীদের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। বিভিন্ন প্রজনন পর্যায়ের (১৪ থেকে ৬৭ বছর বয়সী) ৬৬টি স্ত্রী শিম্পাঞ্জির প্রস্রাবের নমুনায় হরমোনের পরিবর্তন দেখা গেছে, সেই সঙ্গে বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে একপর্যায়ে এদের সন্তান জন্মদান বন্ধ হয়ে যায়— মানুষের মেনোপজের বৈশিষ্ট্যও এমন।
কিন্তু অনেক মানুষের মতো স্ত্রী শিম্পাঞ্জিরা একই গোত্রে সন্তান জন্ম দেয় না। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর স্ত্রী শিম্পাঞ্জিরা তাদের বৃদ্ধ মাকে রেখে অন্য গোত্রে চলে যায়। তাই ‘গ্র্যান্ডমাদার হাইপোথিসিস’ শিম্পাঞ্জিদের ক্ষেত্রে খাটে না।
উড বলেন, গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, একটি নির্দিষ্ট বাস্তুতন্ত্রে থাকা স্ত্রী শিম্পাঞ্জিদের মেনোপজ ও উর্বরতা কমার পর বেঁচে থাকাটা এদের সামাজিক ব্যবস্থার মধ্য থেকেই বিকশিত হয়, যা মানব সমাজ থেকে আলাদা। সেখানে পূর্ববর্তী তৃতীয় প্রজন্মের (দাদা–দাদি/নানা–নানি) সহায়তার প্রয়োজন হয় না।
ফলে এখানে গ্র্যান্ডমাদার হাইপোথিসিসের স্থান নেই। তবে এই হাইপোথিসিস যে মানুষের ক্ষেত্রেও খাটবে না, সেটি এই গবেষণার ফলাফল থেকে জানা যায় না।
মানুষের মধ্যে মেনোপজের বৈশিষ্ট্য কীভাবে এল সেই প্রশ্নের ওপর নতুন করে আলোকপাত করেছে এই গবেষণার ফলাফল।
গবেষণায় বলা হয়েছে, শিম্পাঞ্জি এবং মানুষ একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে মেনোপজের জিন পেয়ে থাকতে পারে। আবার বৈশিষ্ট্যটি প্রতিটি প্রজাতির মধ্যে স্বাধীনভাবেও বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
যদি ব্যাপারটা এমনই হয়, তাহলে মানুষের ক্ষেত্রে ‘উন্নত খাদ্যাভ্যাস ও শিকারে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি হ্রাসের’ বিবর্তনীয় ফলাফল হতে পারে মেনোপজ— নতুন এই গবেষণা সেটিরই ইঙ্গিত দেয়। এমনটিই বলছেন গবেষক উড।
কিবেইল ন্যাশনাল পার্কের শিম্পাঞ্জিরা আগের তুলনায় এখন অনেক ভালো আছে। ১৯৬০–এর দশকে শিম্পাঞ্জি শিকারি চিতাবাঘ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং মানুষও আর শিম্পাঞ্জি হত্যা করে না। এনগোগো শিম্পাঞ্জিদের খাওয়ার জন্য প্রচুর ফল থাকে এবং তারা প্রতিবেশী শিম্পাঞ্জি সম্প্রদায়ের তুলনায় বেশি মাংস খায়।
এই সুন্দর জীবনের সুযোগের জন্য নারী শিম্পাঞ্জিরা মেনোপজের পরেও দীর্ঘকাল বেঁচে থাকে। যদিও অন্যান্য বন্য শিম্পাঞ্জি সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রজনন সক্ষমতা হারানো স্ত্রী শিম্পাঞ্জি থাকলেও খুব কমসংখ্যকই ৫০ বছরের বেশি বাঁচে।
প্রাইমেটগুলোতে শুধু ‘অনুকূল পরিবেশের’ জন্য নাকি স্বাভাবিক বিবর্তনের কারণেই এই মেনোপজের লক্ষণ দেখা গেছে তা স্পষ্ট নয়। সাম্প্রতিক পরিবেশগত পরিবর্তন ও মহামারি এদের জীবনকাল সংক্ষিপ্ত করে ফেলার কারণে হয়তো মেনোপজের মতো বৈশিষ্ট্যগুলোর বিবর্তনীয় ইতিহাসের প্রমাণ মুছে গেছে— এমনটি ধারণা করেছেন গবেষকেরা।
আপনার মতামত জানানঃ