বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য মনোনয়নপত্রের সাথে হলফনামায় সংসদ সদস্যরা তাদের সম্পদের যে বিবরণ তুলে ধরেছেন সেগুলো দেখে অনেক বিস্মিত হচ্ছেন।
হলফনামার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে সংসদ সদস্যদের সম্পদ ও নগদ টাকার বিবরণ প্রকাশিত হচ্ছে। এসব প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, গত কয়েক বছরে বহু সংসদ সদস্যের কোটি কোটি নগদ টাকা ও সম্পদের বৃদ্ধি হয়েছে।
সংসদ সদস্যদের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা যেমন রয়েছেন তেমনি তাদের জোটের শরীক দলগুলোর নেতারাও রয়েছেন। পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, যে দলের সংসদ সদস্য হোন না কেন, সবারই সম্পদ কিংবা নগদ টাকা বেড়েছে।
এ ধরনের সম্পদ বৃদ্ধিকে ‘অস্বাভাবিক’ বলে বর্ণনা করছেন দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তবে সবার ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে সেটি বলা যায় না – একথা উল্লেখ করে মি. জামান বলেন, কারও কারও ক্ষেত্রে সম্পদ বৈধ প্রক্রিয়াতেও হতে পারে।
“মানুষের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যাচ্ছে যে ক্ষমতায় থেকে অর্থ সম্পদের মালিক হওয়া যায় বিশালভাবে। এটা এমন একটা পর্যায় পর্যন্ত হওয়া যায় যেটা সীমাহীন, কিন্তু তা সত্ত্বেও কোন জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হয়না,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. জামান।
তিনি বলেন, সম্পদের যে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে সেটি বৈধ প্রক্রিয়ায় পৃথিবীর কোন দেশে অর্জন করা সম্ভব নয়।
এতো টাকা বাড়লো কীভাবে?
একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হচ্ছে, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ফেনী-২ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীর স্ত্রী নূরজাহান বেগমের ৪ কোটি ১৩ রাখ টাকার সম্পদ ছিল। ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগে তাদের সম্পদের পরিমাণ বেড়ে হয় প্রায় ৩২ কোটি টাকা। এবারের হলফনামায় তাদের সম্পদের সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয়েছে প্রায় ১২৫ কোটি টাকা।
নিজাম উদ্দিন হাজারী বিবিসি বাংলাকে বলেন, তিনি তার সব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের বিবরণ হলফনামায় তুলে ধরেছেন।
“ আমি কোন কিছু গোপন করি নাই। আমার ফার্নিচার কত টাকার আছে সেটিও তুলে ধরেছি,” বলেন মি. হাজারী।
তিনি দাবি করেন, তার আয় অবৈধ নয় এবং হলফনামায় যা উল্লেখ করা করা হয়েছে সেগুলোর আয়কর পরিশোধ করা আছে। সংসদ সদস্য হবার পর থেকে এতো দ্রুত সম্পদের বৃদ্ধি পায় কীভাবে?
এমন প্রশ্নে হাজারী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ আমার ব্যবসা আছে। ব্যবসা থেকে আয় করি। তাছাড়া আমার আগে থেকেই সম্পদ ছিল , আয়ও ছিল।”
রাজশাহী-২ আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা। তিনি ২০০৮ সাল থেকে এই আসনে সংসদ সদস্য হিসেবে রয়েছেন। ২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচনের আগে তিনি যে হলফনামা জমা দিয়েছিলেন সেখানে দেখানো হয়েছিল তাঁর ব্যাংকে প্রায় ২৬ লাখ টাকা রয়েছে।
এবারের হলফনামায় উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁর ব্যাংকে আছে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকার বেশি। অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে তার ব্যাংকে টাকা বেড়েছে পাঁচগুণ। এতো টাকা বেড়েছে কিভাবে? মি. বাদশা বিবিসি বাংলাকে বলেন, তার আয়ের কিছু সূত্র আছে। তিনি দাবি করেন, সংসদ সদস্য হিসেবে তার ‘অস্বাভাবিক’ আয়ের সুযোগ নাই।
“পারিবারিক আয় আছে। নিজের আয় যা আছে সেটা তো পরিচ্ছন্ন। আমরা সংসদ থেকে যা পাই সেগুলো নিয়ম মাফিক সংসদ থেকে ব্যাংকে জমা হয়। সে ব্যাংকের রিপোর্ট ধরেই আমরা হলফনামা দিয়েছি। এছাড়া পুরনো গাড়ি বিক্রি করে কিছু টাকা আয় হয়েছে সেটা ব্যাংকে থাকে।”
সংসদ সদস্য হওয়ার আগে সম্পদের এতো দ্রুত বৃদ্ধি হতো না। সংসদ সদস্য হবার পরে কীভাবে এতো দ্রুত আয় বৃদ্ধি পায়?
“আমার পারিবারিক আয়ের সূত্র বেড়েছে। আমাদের পারিবারিক যে সম্পত্তি ছিল, সেখানে বহুতল বিশিষ্ট ইমারত করা হয়েছে, সেখানে ফ্ল্যাট করা হয়েছে এবং সেগুলো ভাড়া দেয়া হয়েছে। সেটা আমাদের পরিবারের যৌথ সম্পত্তি।”
টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যে হারে সম্পদ বেড়েছে সেটি বাংলাদেশের বাস্তবতায় কতটা সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। খুবই যৌক্তিকভাবে প্রশ্ন উঠেছে যে এটা কি ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিরা অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছেন কি না?”
যেসব তথ্য হলফনামায় দেয়া হয়েছে সেটা কি পর্যাপ্ত নাকি এর বাইরেও অঘোষিত সম্পদ রয়েছে সেটি নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। ড. জামান বলছেন, হলফনামায় দেয়া এসব সম্পদের বিবরণ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কখনো যাচাই করে দেখেনি।
দুর্নীতি দমন কমিশন কী বলছে?
টিআইবি বলছে, হলফনামায় সংসদ সদস্যরা যে তথ্য দিয়েছেন সেটি চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশন যাচাই-বাছাই করে দেখতে পারে। এজন্য কোন অভিযোগ দায়ের করার প্রয়োজন নেই। দুর্নীতি দমন কমিশন কি এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করবে?
“এখনো সময় আসেনি, সময় আসুক দেখা যাবে। কমপ্লেইন আসলে আমরা দেখবো,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের অন্যতম কমিশনার মো: জহুরুল হক।
“এখন তো দেখে মনে হচ্ছে, সব এমপির সম্পত্তি বেড়েছে। কিছু এমপি আছেন যারা ব্যবসা করে করে আয়কর দিয়ে বৈধ উপায়ে সম্পত্তি করেছেন। আবার অবৈধ উপায়েও কেউ কেউ করতে পারেন,” বলেন দুদক কমিশনার মি. হক।
পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টগুলোর উপর কমিশনের নজর আছে – একথা উল্লেখ করে দুদক কমিশনার বলেন, এসব তথ্য অনুসন্ধানের জন্য কমিশনের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এখন নির্বাচন এসে গেছে সেজন্য নির্বাচনের পরে বিষয়টি নিয়ে কমিশন কাজ করবে। দুদক মনে করছে, এসব তথ্য হলফ নামায় উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো মধ্যে কিছু মিথ্যা তথ্য থাকতে পারে, কিছু সত্য তথ্যও আছে।
আপনার মতামত জানানঃ