বাংলাদেশসহ ব্রিকসভুক্ত এবং এই নতুন জোটের বাইরেও অনেক দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে লেনদেনের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের একাধিপত্য কমতে শুরু করেছে। এই সাফল্যের প্রধান হকদার গণচীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ইউরোপীয় মিত্রদের যুদ্ধ-বিক্ষত অর্থনীতির পুনর্গঠনে যে ঐতিহাসিক মহাপরিকল্পনা ‘মার্শাল প্ল্যান’ হাতে নিয়েছিল, যেকোনো বিচারে তার চেয়ে বিশ্ববাসীর জন্য অনেক বড় সওগাত হলো চীনের এখনকার আন্তর্জাতিক উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা ‘বিআরআই’ বা ‘বেল্ড অ্যান্ড রোড’ মহাকার্যক্রম। এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ডলারের ‘সাম্রাজ্যবাদী’ একচ্ছত্র আধিপত্যের অবসান ঘটবে এবং জগতের ৭০টি দেশ যেন প্রাণ ফিরে পাবে।
বিষয়টি আজ থেকে ৫০ বছর আগে টের পেয়ে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. হেনরি কিসিঞ্জার নিজের বইতে চীনভিত্তিক এই বিশ্বজাগরণের রূপরেখা তুলে ধরেছিলেন এবং চীনের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধশত বছরের বৈরিতার অবসানকল্পে এক সুদূরপ্রসারী কূটনৈতিক অভিযানে নেমেছিলেন। l
চীনকে নতুন করে আবিষ্কারের এই মিশনে ড. কিসিঞ্জারের প্রধান কর্মপুরুষ ছিলেন তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও ঘটকালির ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন পাকিস্তানের সেনাশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান।
বিশ্বগণমাধ্যমকে এড়িয়ে, এমনকি মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরকে না জানিয়ে এক গুপ্ত মিশনে রিচার্ড নিক্সন, ড. কিসিঞ্জার ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গিয়েছিলেন ‘পিকিং’-এ (তখন বেইজিংকে সবাই পিকিংই বলত)। এক ঐতিহাসিক সফরে তারা মিলিত হয়েছিলেন চীনের নেতা চেয়ারম্যান মাও সে তুংয়ের সাথে। পরের ইতিহাস সবারই জানা। চীন-মার্কিন আঁতাত জগতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত মানচিত্রই বদলে দেয়। এতে অবশ্য রাশিয়ার লোকসান হয়।
তবে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনে এই ক্ষতির ব্যথা তখনকার পূর্ব ও পশ্চিমের অনেকেই (বলা চলে সবাই) হাসিমুখে মেনে নেয়। ওটা না হলে রাশিয়ার ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ’ আরো হিংস্র, আরো বেপরোয়া এবং আরো অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠত, যার খানিক নজির আমরা দেখেছি রাশিয়ার আফগান অভিযানে। কী অঘটনই না ঘটিয়েছে রাশিয়া আফগান পাহাড়ে! আজকের বাস্তবতা কিন্তু ঠিক এর বিপরীত।
এখন মনে হচ্ছে রাশিয়ার অতীতটা একটু আড়াল করে হলেও এখনকার রাশিয়াকে দরকার এই পৃথিবীর। চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক পাওয়ার হাউজ। তবে প্রথম (যুক্তরাষ্ট্র)- কে ডিঙ্গাতে হলে চীনের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির পাশে রাশিয়ার থাকাটা অনিবার্য। এক ইউক্রেনকে সামনে রেখে পশ্চিমা পৃথিবী যেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরিস্থিতির ‘রিহার্সেলে’ নেমেছে।
ইউরোপের বোঝা উচিত আমেরিকার খাস গোলাম ব্রিটেন তাদের সাথে নেই (ব্রেক্সিট); তবু তারা কেন যে খেয়ে না খেয়ে আমেরিকার ঢাকবাদ্য বাজিয়েই চলেছে তা সত্যিই অধমের বুঝে আসে না। ‘মার্শাল পরিকল্পনায়’ যে সাহায্য আমেরিকা ইউরোপকে করেছে, উত্তর আটলান্টিক জোটকে (ন্যাটো) ব্যবহার করে আমেরিকা তার ষোলোআনা আদায়ও করে নিয়েছে। এখনো করছে।
ইউরোপের সমন্বিত মুদ্রাকে (ইউরো) সে মাথা তুলতেই দিচ্ছে না। কেবল ‘ন্যাটোর’ যুদ্ধ-সীমানা তারা বাড়িয়েই চলেছে, একের পর এক দেশকে জোটে ঢুকিয়ে। আমেরিকা দিনের শেষে তার নিজস্ব স্বার্থের (গ্রেট আমেরিকা) দাপট বাড়ানো ছাড়া আর কিছুই বোঝে না; বুঝতে চায়ও না।
পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, আমেরিকার অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা এখন চীনের সাথে বলে মনে হলেও তার আখেরে সঙ্ঘাতটি হবে ইউরোপের সাথেই। কেননা, চীন ৭০ জাতির অর্থনৈতিক সঙ্ঘ (বিআরআই) করে আফ্রিকা ও ল্যাতিন আমেরিকাকে সাথে নিয়ে একাই শ্রেষ্ঠ বিশ্ব অর্থশক্তি অর্জনের পথে।
এই শেষ অর্থনৈতিক মেরুকরণে ইউরোপ যদি নিরপেক্ষ থাকে, তাহলে সে-ও বাঁচবে ‘ন্যাটো’ নিয়ে মার্কিন অভিলাষ চরিতার্থ হওয়ার ব্যগ্রতা থেকে, তার ‘ইউরো’ও বাঁচবে দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ব মুদ্রার মহিমা নিয়ে। এই পাশাখেলায় ইউরোপ যদি তার দানে আবার ভুল করে তাহলে সে-ও হারবে, চীনের অভিযানকেও দীর্ঘায়িত করার দোষে দোষী হবে। এখনই চীনে সব কয়টা খ্যাতনামা ইউরোপীয় ‘ব্র্যান্ড’ তাদের ব্র্যান্ড-ইক্যুয়িটি খুলেছে; বিনিয়োগও করেছে।
এমন কোনো চীনা প্রদেশ নেই যেখানে ইউরোপের বিশ্ব সেরা ব্র্যান্ডগুলোর ম্যানুফ্যাকচারিং বেজ বা লগ্নি নেই। তাহলে এত বড় একটি বাজার এবং এই বাজারের মধ্য দিয়ে বিশ্ববাজারে ‘অ্যাকসেস’ লাভের সুযোগ কি ইউরোপ হাতছাড়া করবে, ¯্রফে তাদের দরিয়া পাড়ের বন্ধুদেরকে খুশি করতে?
আফসোস এই যে, চীনের বর্তমান সম্ভাবনার রূপরেখা আঁকতে রাশিয়াও ব্যর্থ হয়েছে; যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্ররাও এখন ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। অথচ তাদের দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষণে ক্ষণে চীনের প্রতি মুহূর্তের জাগরণকে যে জরিপ করছে, তার মাত্রাটা কিন্তু চমকে দেয়ার মতোই অবিশ্বাস্য।
চীন সমাজতন্ত্রের নিয়মশৃঙ্খলা এবং ধনতন্ত্রের সৃজনশীল উদ্ভাবন (বা লিবারেল ইনোভেশনকে) একত্রিত করে উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির যে নতুন ধারার জন্ম দিয়েছে তারা ঠিকই এর মূল্য বুঝতে পারছে। কিন্তু ‘বড় ভাই’ মানে আমেরিকার বিরাগভাজন হয়ে সেই সত্য তথ্য উপাত্তগুলো তাদের কূটনৈতিক কার্যক্রমে প্রস্ফুটন করে উঠতে পারছে না। সাহস পাচ্ছে না।
অথচ চীনের উত্থানপর্বকে কেউ-ই ধামাচাপা দিয়ে রাখতে পারছে না। চীনের ইংরেজি ভাষার দুর্বলতা তার উন্নয়নের জোয়ারে কেটে যাবে; যেমনটি গিয়েছিল ৪০-৫০ বছর আগেকার আরব পেট্রো-ডলারের জোয়ারে। খোদ সৌদি আরবও তো চীনা বিশ্ব অর্থনৈতিক জোট এবং তাদের গড়া নতুন আন্তর্জাতিক ব্যাংক (বিকল্প বিশ্বব্যাংকের) সদস্য হয়েছে।
মার্কিন শক্তি সাত-সাগর-তেরো-নদী পেরিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় যতই শো-ডাউন করতে আসুক না কেন, সত্য এটাই যে, প্রশান্ত দরিয়া তার উপর হিরোশিমা-নাগাসাকির বদলা নেবেই। আরো ‘পার্ল হারবার’ ঘটনার পুনরাবৃত্তি করে হলেও। আটলান্টিক দাপিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের নীল জলরাশিকে ঘোলা করার মার্কিন লক্ষ্য দিবাস্বপ্ন হয়েই থেকে যেতে পারে। চীন কিন্তু ফিলিপাইন দ্বীপ নয়, তাইওয়ানও নয়।
মার্কিন নৌ ও হাওয়াই শক্তির প্রাধান্য এক জিনিস; আর দরিয়া জয়ের স্বপ্ন আর এক জিনিস। এখন আর সেই পৃথিবী নেই। ভারতও বদলাচ্ছে। আমেরিকার উচিত তার উপকূলেই তার হুঙ্কার সীমা আবদ্ধ করা। ভারত তার হাতের ‘রুশ কার্ড’ থেকে সরে আসছে। তার চীনা বিদ্বেষেও ভাটা পড়ছে। চীন, সত্যি বলতে কী, ভারতকে ঠিক গোনায়ও ধরে না।
চীনের এখন টার্গেট অর্থনৈতিক ‘সুপার পাওয়ার’ আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার। ভারতের সেই সুযোগটি আশির দশকে এসেছিল। তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন রাজীব গান্ধী। মায়ের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ এবং উত্তর-প্রদেশ-সর্বস্ব ভারত শাসননীতির কারণে ভারত তার কাক্সিক্ষত অগ্রগতির কাছাকাছি যেতে পারেনি। ছেলে বাস্তববাদী একজন পাইলট।
তিনি হিন্দুত্ববাদী চরম ডানপন্থীদের শাসনে রেখেছিলেন আর ভারতের অর্থনীতিকে কেন্দ্রীয় কব্জা থেকে বের করে প্রতিযোগিতামুখী করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। তিনি সকারের জুলুম কমিয়ে ব্যবসায়ীদের আস্থা অর্জন করেছিলেন। কিন্তু চীনের নবজাগরণ বিপ্লবের কিনারাতেও পৌঁছুতে পারেনি ভারত। ভারত ‘প্রবৃদ্ধির’ সাথে বিয়ে-বন্ধন ঘটায় ‘পুঁজির’। চীন তখন তার আঙিনা খুলে দেয় বিশ্বের কাছে এবং সমস্ত শক্তি নিয়োগ করে ‘মানবসম্পদ’ উন্নয়নে।
দুই দশকের মধ্যে নব প্রযুক্তিতে পারদর্শী এই চীনা নবীন প্রজন্মই আজকের চীনা অর্থনৈতিক চমক সৃষ্টিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। চীন এখন অর্থনীতিতেও পরাশক্তি, সামরিক শক্তিতেও অদ্বিতীয়- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ‘ন্যাটো’ সমর জোট ছাড়া। তার সাথে রাশিয়ার ষাট বছরের বৈরিতা এখন আর নেই। রাশিয়া মানবসম্পদ সৃষ্টি না করে ‘প্রেরেসত্রয়কা’ ও ‘গ্লাসনস্ত’ সংস্কার সাইনবোর্ডের আড়ালে ‘কোকা-কোলা’র দাসত্ব গ্রহণ করে নিজের পায়ে নিজেই কুঠারাঘাত করে। ১৯৮১ সালে ভারতীয়দের গড় আয়ু ছিল ৫১ বছর; চীনের ছিল ৬৪ বছর।
চীনারা তাদের জনগণকে ভালো খেতে দিয়েছে; ভালো লেখাপড়া শিখিয়েছে, ভালো থাকার বাসা ও স্বাস্থ্যসেবা নিখরচায় জুগিয়েছে। নারীর সুযোগ ও অধিকারে চীন ইউরোপকেও ছাড়িয়ে গেছে। তারা তাৎপর্যপূর্ণ মাত্রায় জন্মহার কমিয়েছে।
এর বিপরীতে, ভারতে কয়েক কোটি মানুষ এখনো উন্মুক্ত রেললাইনের ধারে প্রাকৃতিক কর্ম সারে। লিঙ্গ সমতায় ভারত এখনো ১০০ বছর পিছিয়ে। নারীর শ্রম এবং নিরাপত্তা এখনো অনেক নিচে। চীন তার পণ্য রফতানি বাড়াতে যে কর-রাজস্ব নেয় তা, পৃথিবীর মধ্যে সর্বনিম্ন। তাদের রফতানি উৎসাহ বিশ্বের মধ্যে প্রথম।
দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনশক্তি তারা ভারী শিল্পের সোপান বানিয়েছে; ভারত তথ্য প্রযুক্তিকে প্রাধান্য দিয়েছে। ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী শাসন প্রবণতায় তাদের থেকে অনেক দেশ, বিশেষ করে পেট্রোডলারের দেশগুলো, ভারতে বিনিয়োগে উৎসাহ হারিয়েছে। বিশ্বের মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে ভারতের স্কোর ছিল ০.৪৯, যা কিনা নেপাল বা কেনিয়ার থেকেও কম। চীনের এই স্কোর ০.৬৫।
এখন চীনের শিল্প উৎপাদনক্ষমতা ভারতের প্রায় দ্বিগুণ। ভারতের অগ্রযাত্রায় ব্যর্থতার আর একটি বড় কারণ হলো, কৃষিপ্রধান দেশ হয়েও তারা কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি, উৎপাদনশীলতা এবং চাষিদের অধিকার সংরক্ষণের বিশ্ব ধারা থেকে অনেক পিছিয়ে।
ভারত যখন তার প্রতিবেশীদের দিকে ঘৃণা এবং আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে তাকায়; চীন তখন ৭০টি দেশকে এক অসাধারণ উন্নয়ন মহাকার্যক্রমে বেঁধে নিয়েছে তাদের ‘বিআরআই’ দিয়ে। তারা বিশ্বব্যাংকের মতো আর একটি ‘মিনি বিশ্বব্যাংক’ বানিয়েছে এবং তার নেতৃত্ব দিচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী চীনের অর্থনৈতিক অভিযানে সহযাত্রী হয়েছে কালো মহাদেশ আফ্রিকা ও ‘হিসপানিক’ মহাদেশ দক্ষিণ আমেরিকা। কার সাথে তাহলে কার তুলনা? চীনের অর্ধেক আকারের অর্থনীতি হতে হলেও ভারতকে আরো ১০০ বছর অপেক্ষা করতে হবে। এটি আবেগের কথা নয়, অঙ্কের হিসাব, সূচকের ছক থেকে নেয়া এবং নেতৃস্থানীয় বুদ্ধি প্রতিষ্ঠানগুলোর (থিংক-ট্যাংক) আগাম পূর্বাভাস।
আপনার মতামত জানানঃ