৯ মিনিটেই অপারেশন শেষ। ভোর সাড়ে ৪টার কিছু পরে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ২৪ ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল আবুল মনজুরকে মেজর মোজাফফর হোসেন ফোন করে জানালেন, ‘দ্য প্রেসিডেন্ট হ্যাজ বিন কিলড।’
১৯৮১ সালের ৩০ মে ভোররাতে চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে একদল সেনা কর্মকর্তা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সামরিক বাহনে চেপে বেরিয়ে আসেন। তখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। সেনাসদস্যদের গন্তব্য ৭ কিলোমিটার দূরে শহরের কেন্দ্রস্থল কাজীর দেউরিতে সরকারি কর্মকর্তাদের অতিথিশালা সার্কিট হাউস।
ব্রিটিশ আমলে গড়া বাংলো প্যাটার্নের নয়নাভিরাম তিন তলা এই ভবনে তখন অবস্থান করছিলেন তখনকার রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। আগের দিন তিনি এখানে এসেছেন রাজধানী থেকে, স্থানীয় বিএনপিতে চলতে থাকা কোন্দল মেটাতে।
জিয়া হত্যার পূর্বাপর নিয়ে প্রোবনিউজ-এর প্রধান সম্পাদক ইরতিজা নাসিম আলীর একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট ১৯৯৪ সালের মে মাসে মতিউর রহমান সম্পাদিত দৈনিক ভোরের কাগজ-এ ধারাবাহিকভাবে আট কিস্তিতে ছাপা হয়েছিল। এই রিপোর্টে জানা যায় যে চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে ২৯ ও ৩০ মে তারিখের মধ্যবর্তী রাত সাড়ে ৩টায় তিনটি গাড়ি নিয়ে ১৬ জন সেনা কর্মকর্তা রওনা হন। প্রেসিডেন্ট জিয়া তখন সার্কিট হাউসে ঘুমিয়ে।
গুলি করতে করতে তাদের একটি দল দোতলায় উঠে যায়। গোলাগুলির শব্দ শুনে বাইরে কী হচ্ছে দরজা ফাঁক করে দেখার চেষ্টা করলেন জিয়া। তখন গর্জে ওঠে আততায়ীর হাতের অস্ত্র। ৯ মিনিটেই অপারেশন শেষ। ভোর সাড়ে ৪টার কিছু পরে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ২৪ ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল আবুল মনজুরকে মেজর মোজাফফর হোসেন ফোন করে জানালেন, ‘দ্য প্রেসিডেন্ট হ্যাজ বিন কিলড।’
বলা হয়, এক সামরিক অফিসার তার স্টেনগানের এক ম্যাগাজিন গুলি পুরোটাই জিয়ার ওপর চালিয়ে দেন। মেশিনগানের ব্রাশ ফায়ারে জিয়াউর রহমানের মুখের একপাশ উড়ে গিয়েছিল। একটি চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে এসেছিল। পেছনের দেয়ালে লেগেছিল বীভৎসতার চিহ্ন। বারান্দায় পড়ে থাকা প্রেসিডেন্টের রাতের পোশাক সাদা ধবধবে পাজামা-পাঞ্জাবি লাল হয়েছিল রক্তে।
জিয়ার লাশ এতটাই ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল যে তাকে চিনতে পারা কঠিন ছিল। চট্টগ্রামের তখনকার পুলিশ সুপার সৈয়দ শফিউদ্দীন আহমেদের পরিবারের সদস্যরা জানান, জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর দায়িত্বরত কোনো বেসামরিক কর্মকর্তা হিসেবে শফিউদ্দীন আহমেদই প্রথম ঘটনাস্থলে পৌঁছান। তিনি বারান্দায় পড়ে থাকা প্রেসিডেন্টের ছিন্নভিন্ন দেহ দেখে সেখানেই স্ট্রোক করেন।
জিয়ার সঙ্গে ওইদিন সার্কিট হাউসে গুলিতে নিহত হয়েছিলেন আরও দুই সেনা কর্মকর্তা– লে. কর্নেল আহসান এবং ক্যাপ্টেন আশরাফুল হাফিজ খান। এরা ছিলেন রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা বাহিনী বা প্রেসিডেন্টস গার্ড রেজিমেন্টের সদস্য।
জিয়ার এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে লেখক-সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ তার অনুভূতি প্রকাশ করেছিলেন সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরীর কাছে। তিনি বলেন, ‘জিয়া নিহত হয়েছিলেন তার প্রিয় সহকর্মী ও অনুগতদের হাতে। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না।’
অন্যদিকে জিয়ার এই মৃত্যু নিয়ে তার অন্যতম রাজনৈতিক সহযোগী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদকে উদ্ধৃত করে গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, যাদের ওপর জিয়া বেশি নির্ভর করেছিলেন, তারা যদি তাদের আনুগত্য বজায় রাখতেন, তাহলে জিয়ার এ রকম মর্মান্তিক পরিণতি হতো না। তার মতে, দুই পক্ষই (মুক্তিযোদ্ধা ও অমুক্তিযোদ্ধা) তার পতন চেয়েছে, এক পক্ষ কাজটা করেছে, লাভ গেছে অন্য পক্ষের ঘরে। দাবার চালে একদল জিতেছে, অন্য দলটি হেরেছে।
জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড ছিল বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থান আর পাল্টা অভ্যুত্থানের এক বিশৃঙ্খল পর্বের শেষ অধ্যায়, যা শুরু হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। জিয়াউর রহমানের সেনাপ্রধান থেকে রাষ্ট্রপতি হয়ে ওঠার পেছনেও ভূমিকা ছিল একই রকম সামরিক অভ্যুত্থানের।
৩০ মে ভোররাত ৪টার দিকে জিয়াকে হত্যা করা হয়। সকালবেলা সেনানিবাস থেকে যে দুজন সামরিক কর্মকর্তা প্রথম সেখানে হাজির হন, তারা ছিলেন মেজর শওকত ও মেজর রেজাউল করিম। এদের মধ্যে মেজর শওকতের দায়িত্ব ছিল নিহত তিনজনের মরদেহ সংগ্রহ করে কবর দেয়া। আর মেজর রেজার দায়িত্ব ছিল প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের সদস্যদের সংগ্রহ করে সার্কিট হাউস থেকে ক্যান্টনমেন্টে ফিরিয়ে আনা। তারা দুজনই সার্কিট হাউসের দোতলার বারান্দায় নিজ কক্ষের সামনে জিয়ার ক্ষতবিক্ষত মরদেহ দেখেছেন।
মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) রেজাউল করিম ওইদিনের স্মতিচারণা করে বলেন, ‘দোতলায় উঠে সিঁড়িবারান্দায় দেখি ছোটখাটো একটা ডেডবডি ঢাকা। একজন পুলিশ দাঁড়ানো। তাকে জিজ্ঞেস করলাম যে এটা কার ডেডবডি। সে বলল রাষ্ট্রপতির। তাকে মুখটা খুলতে বলার পর দেখলাম পরনে সাদা পাঞ্জাবি। তার একটা চোখ বের হয়ে ঝুলে আছে। পুরো মুখ ঝাঁঝরা। আমি তারপর তাকে বললাম ঠিক আছে ঢেকে রাখো। এর বেশি দেখার আর ইচ্ছা হয় নাই।
‘বারান্দায় আরেকটু সামনে গিয়ে দেখি আরেকটা ডেডবডি। দেখি একটা হাত বের হয়ে আছে। মুখ খুলে দেখি এটা কর্নেল আহসান। আরেকটু সামনে গিয়ে দেখি একটা বড়সড় মরদেহ। যেটার শুধু পা বের হয়ে আছে। সেটা খুলে দেখি আমার বন্ধু ক্যাপ্টেন হাফিজ।’
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড নিয়ে তার গবেষণা তুলে ধরেছেন ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম: শান্তিবাহিনী, জিয়া হত্যাকাণ্ড, মনজুর খুন’ বইয়ে। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জিয়াউর রহমানের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট থেকে দেখা গেছে যে তার মুখ ও কাঁধে ব্রাশফায়ার করা হয়েছে। তাছাড়া হাতে গুলির ক্ষত আছে। পায়ে গুলির ক্ষত আছে। মাথার খুলি একদিকে উড়ে গিয়েছিল ও মস্তিষ্ক বেরিয়ে গিয়েছিল। এগুলো রিপোর্টে লেখা আছে। রিপোর্ট তৈরি করেছিলেন লে. কর্নেল তোফায়েল।’
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর কর্নেল শওকত তা রাঙ্গুনিয়ায় এক পাহাড়ের পাদদেশে মাটিচাপা দিয়ে আসেন। আবার ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ্ কয়েক দিন পর তা গর্ত খুঁড়ে তুলে এনে ঢাকা পাঠান। এই অংশটি সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায় না। গবেষকরা এখানে খুব বেশি আলো ফেলতে পারেননি।
আপনার মতামত জানানঃ