দেশে বিদ্যুৎ চাহিদা এখন দৈনিক ১৪ থেকে সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। এর বড় একটি অংশ আসছে ভারতের আদানি পাওয়ার লিমিটেডের কাছ থেকে। ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রটি থেকে দৈনিক বিদ্যুৎ আসছে ১২০০-১৪০০ মেগাওয়াট। যদিও চুক্তি অনুযায়ী আদানি থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নিতে পারবে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। সে হিসেবে একক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে আদানির কাছ থেকেই এখন বিপিডিবি সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ কিনছে।
দেশের বিদ্যুৎ চাহিদায় আদানি পাওয়ার বড় ভূমিকা রাখলেও এরই মধ্যে বিদ্যুতের বিল বাবদ বকেয়া ৪০০ মিলিয়ন (৪০ কোটি) ডলার ছাড়িয়েছে। যদিও বিপিডিবি বলছে, প্রতিষ্ঠানটির বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করা হচ্ছে। চলতি অক্টোবর পর্যন্ত ৭৫ মিলিয়ন (সাড়ে ৭ কোটি) ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। এ সপ্তাহে আরো বিল পরিশোধ করা হবে বলে জানিয়েছে সংস্থাটির নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র।
নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বিপিডিবির একজন কর্মকর্তা জানান, পরীক্ষামূলক বিদ্যুতের বিল ১৭ মিলিয়ন (১ কোটি ৭০ লাখ) ডলার আগেই পরিশোধ করা হয়েছে। বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার পর আদানি পাওয়ার বিপিডিবিতে যে বিল জমা দেয়, তার মধ্যে তিন কিস্তিতে সাড়ে ৭ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। চলতি মাসে আরো পরিশোধ করা হবে। আইপিপিগুলোর বিল পরিশোধ হচ্ছে, তবে তা একটু ধীরগতিতে বলে জানান এ কর্মকর্তা।
চলতি বছরের মার্চে বাংলাদেশে পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করে আদানি পাওয়ার। এর প্রায় এক মাস পর অর্থাৎ এপ্রিলে কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট থেকে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়। জুলাই থেকে দ্বিতীয় ইউনিট চালু হওয়ার পর দুটি ইউনিট থেকে পূর্ণ সক্ষমতায় বিদ্যুৎ সরবরাহ নেয় বিপিডিবি। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয় মাস বিদ্যুৎ সরবরাহ বাবদ আদানির বকেয়া পাওনা ৪০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে।
এর আগে সরবরাহ বাবদ বিল পরিশোধের বিষয়টি জানিয়ে আদানি পাওয়ারের পক্ষ থেকে বিপিডিবি ও বিদ্যুৎ বিভাগকে কয়েক দফা চিঠি দেয়া হয়। বিদ্যুৎ বিভাগের একটি চিঠি সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত আদানি পাওয়ার তিনটি বিলের চিঠি দেয় বিপিডিবিকে। ওই তিনটি বিলে ২০ কোটি ডলার বিদ্যুৎ সরবরাহ বাবদ বকেয়া পাওনার কথা জানায় প্রতিষ্ঠানটি। এরপর আরো তিন মাস অতিবাহিত হওয়ায় এ বিল দ্বিগুণ হয়েছে বলে জানা যায়।
বিপিডিবি বৃহৎ তিনটি পাওয়ার প্লান্টের কাছ থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিদ্যুৎ কিনছে। এর মধ্যে ভারতের ঝাড়খণ্ডের আদানি পাওয়ার থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট, পটুয়াখালীর পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৬৫০ মেগাওয়াট এবং বাগেরহাটের রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০-৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ নিচ্ছে সংস্থাটি।
দেশে বর্তমানে দৈনিক বিদ্যুতের চাহিদা ১৪ থেকে সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। এর মধ্যে ভারত থেকে আসছে ২ হাজার ৬০০ মেগাওয়াটের কম-বেশি। আদানি পাওয়ারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ১ হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াটের মধ্যে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ আসছে। এর বাইরে ভারতের সঙ্গে জিটুজি চুক্তির আওতায় ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসছে দেশে। ফলে দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের যে পরিমাণ চাহিদা রয়েছে তার মধ্যে ভারত থেকে আমদানীকৃত বিদ্যুতের পরিমাণ প্রায় ২০ শতাংশ।
দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে প্রতি মাসে বিপুল অংকের বিদ্যুৎ কিনছে বিপিডিবি। কিন্তু অর্থ বিভাগ থেকে নিয়মিত অর্থছাড় না হওয়ায় এসব বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলোকে বকেয়া পরিশোধ করতে পারছে না। বকেয়া পাওনা না পাওয়ায় এরই মধ্যে অনেক আইপিপি দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হয়েছে বলে জানা গেছে।
বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস (বিআইপিপি) সভাপতি ফয়সাল খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বকেয়া বিল এখন আরো ওভারডিউ হয়ে গেছে। বিপিডিবির কাছে বর্তমানে আইপিপিগুলোর সাত মাসের বকেয়া পাওনা রয়েছে। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্য এখন ঋণপত্র খোলা যাচ্ছে না। পাশাপাশি অর্থ সংকটের কারণে বিদ্যুৎ কেন্দ্র মেরামত করা যাচ্ছে না। অনেক আইপিপি কোম্পানি ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে খেলাপি হয়ে গেছে।’
জ্বালানি খাত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে গিয়ে সেভাবে চাহিদা বাড়ানো যায়নি। যখন বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছিল, সে সময় প্রতি বছর বিদ্যুতের চাহিদা ১০ শতাংশ হারে বাড়বে বলে প্রাক্কলন করা হয়, কিন্তু সেটি বাড়েনি। ফলে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে, কিন্তু বিপিডিবি সেই বিদ্যুৎ ব্যবহারের খাত তৈরি করতে পারেনি। ফলে অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে না থেকেও টাকা নিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে বকেয়া বিল, জ্বালানি আমদানির বিল, এমনকি বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে বকেয়া বিল পাওনাসহ প্রতিষ্ঠানটির ওপর নানামুখী চাপ তৈরি হয়েছে।
দেশে দৈনিক যে পরিমাণ বিদ্যুতের চাহিদা তৈরি হচ্ছে তার জ্বালানি সংগ্রহ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্যের কারণে সক্ষমতার এক-তৃতীয়াংশেরই বেশি ব্যবহার করা যাচ্ছে না তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
বিপিডিবির তথ্য অনুযায়ী, দেশে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক (এইচএফও) বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা রয়েছে ৬ হাজার ৪৯২ মেগাওয়াট। আর ডিজেলভিত্তিক (এইচএসডি) বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে ৪৯০ মেগাওয়াট। জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের তথ্য থেকে দেখা যায়, বর্তমানে দেড় হাজার থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে বিপিডিবি।
এছাড়া গ্যাসের সংকট থাকায় মোট গ্যাসভিত্তিক সাড়ে ১১ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে সর্বোচ্চ ছয় হাজার মেগাওয়াট। বাকি সক্ষমতার অন্তত ৪৫টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র গ্যাস সংকটের কারণে বসিয়ে রাখা হয়েছে। এছাড়া গ্যাসভিত্তিক অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ায় সেগুলোও ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
দেশে বিদ্যুতের চাহিদার মৌসুম মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এ সময় সেচ ও গ্রীষ্ম মৌসুম থাকায় ব্যাপক হারে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যায়, যা সাড়ে ১৩ হাজার থেকে ১৪ হাজার মেগাওয়াটের মতো। তবে এ যাবতকালে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা সাড়ে ১৫ হাজার মেগাওয়াটের ওপরে ওঠেনি।
বিপিডিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত বছর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বিদ্যুতের চাহিদা ছিল সর্বনিম্ন ১০ হাজার মেগাওয়াট থেকে সর্বোচ্চ ১৩ হাজার ৬৬২ মেগাওয়াট। আর এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সেই চাহিদা ছিল সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। অক্টোবর থেকে চাহিদা কমে ডিসেম্বর পর্যন্ত তা নেমে যায় ১০ হাজার ৩৪৬ মেগাওয়াটে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেশে বিদ্যুতের গড় চাহিদা ছিল ১০ হাজার ৩৩০ মেগাওয়াট, ফেব্রুয়ারিতে ১১ হাজার ৭০৪ মেগাওয়াট, মার্চে ১২ হাজার ৯২১ মেগাওয়াট, এপ্রিলে ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট, মে মাসে ১৪ হাজার ৫১১ মেগাওয়াট, জুনে ১৪ হাজার ৬৫৫ মেগাওয়াট, জুলাইয়ে ১৫ হাজার ১৬৪ মেগাওয়াট, আগস্টে ১৪ হাজার ৮৮৯ মেগাওয়াট, সেপ্টেম্বরে ১৪ হাজার ৯৩৮ মেগাওয়াট।
বিপিডিবির হিসাব বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দুই-একটি মাসে সর্বোচ্চ সাড়ে ১৫ হাজার মেগাওয়াট হলেও প্রকৃতপক্ষে বিদ্যুতের চাহিদা আটকে আছে ১৪ থেকে সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াটে।
আপনার মতামত জানানঃ