গোপাল ভাঁড়। নাম শুনলেই হাসি পায়। হাসির অনেক গল্প মনে আসে। তাঁকে নিয়ে বাজারে সস্তায় বইও আছে। টেলিভিশনে সিরিয়াল চলছে। কার্টুন তৈরি হচ্ছে। কিন্তু গোপাল ভাঁড়ের পরিচয়টা পুরোপুরি খোলসা নয়। রসিক বাঙালির কাছে আলো-আঁধারিতে ঢাকা একটি চরিত্র এই গোপাল ভাঁড়। মধ্যযুগে নদীয়ার শ্রেষ্ঠ রম্য গল্পকার গোপাল কিন্তু নিজে কোনো বই লেখেননি। তবে দুশো বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাভাষী মানুষের কাছে গোপাল ভাঁড়ের গল্পের চাহিদা প্রবল। তবে বাস্তবে গোপাল ভাঁড় নামে আদৌও কেউ ছিলেন কিনা, সে নিয়েও বিস্তর মতভেদ রয়েছে।
নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের নবরত্নদের মধ্যে গোপালকে গল্পে আমরা দেখি। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকাল ১৭১০ থেকে ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দ, অর্থাৎ ৫৫ বছরের রাজত্বকাল। মাত্র ১৮ বছর বয়সে বাংলা ১৭২৮ সালে তিনি রাজা হোন। শাক্তধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। তবে নদীয়ার গোয়াড়ি-কৃষ্ণনগরে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজবাড়িতে গোপালের একটি তৈলচিত্র আছে, সঙ্গে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রও আছেন। তবে এটি প্রামাণ্য কিনা, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে।
মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায় রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র, সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন, জগন্নাথ তর্ক পঞ্চানন, হরিরাম তর্ক সিদ্ধান্ত ছিলেন। রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র, তাঁর রাজত্ব ও সভাসদদের নিয়ে লিখেছেন, কিন্তু সেখানে গোপালের কোনো উল্লেখ নেই। যদিও এ সম্পর্কে বলা যায়, রায় গুণাকর ভারতচন্দ্র নিজের প্রচারের কাজেই ব্যস্ত ছিলেন এবং গোপালের প্রতি ঈর্ষান্বিত ছিলেন। সেজন্য তাঁর লেখায় গোপাল নেই।
এছাড়া রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র ও সাধক কবি রামপ্রসাদ সেনকে জমিদান করেছিলেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র। কিন্তু প্রিয়পাত্র গোপালের নামে এরকম কোনো জমিদানের কোনো রেকর্ড কৃষ্ণচন্দ্রের রাজবাড়িতে নেই। হতে পারে, গোপাল কারো কাছে হাত পাততেন না। এক্ষেত্রেও হাত পাতেননি, তাই জমি পাননি।
ড: সুকুমার সেন জানাচ্ছেন, ” গোপাল ভাঁড় সম্পর্কে আধুনিক বাঙালির কৌতুহল থাকার ফলে বাস্তব অথবা কল্পিত ব্যক্তিটির সম্পর্কে যে জনশ্রুতি জাতীয় ঐতিহ্য গজিয়ে উঠেছে ও উঠছে তার বীজ হচ্ছে ভাঁড় নামের অংশটি, গোপাল ভাঁড়ের ভাঁড়টুকু সংস্কৃত শব্দভাণ্ডারের ‘ভাণ্ড’ জাত মনে করে অনেকে গোপালের জাতি নির্ণয় করেছেন। নাপিতের জাতি ব্যবসায় ভাঁড়-ক্ষুর নিয়ে। সুতরাং গোপাল ভাঁড় নাপিত।”
কেউ বলেন, গোপালের আসল নাম— গোপাল চন্দ্র প্রামাণিক। থাকতেন নদীয়ার কৃষ্ণনগরের কাছে ঘূর্ণিতে। জলঙ্গী নদী এখানে ঘুরেছে, অর্থাৎ বাঁক নিয়েছে, তাই এলাকাটার নাম “ঘূর্ণি।”
নগেন্দ্রনাথ বসুর “বিশ্বকোষ” -এ গোপালের বাড়ি গুপ্তিপাড়া। আবার “বাঙ্গালা ক্ষিতীশ বংশাবলী” -র দাবি, গোপাল ছিলেন শান্তিপুরের বাসিন্দা।
কেউ বলেন, তিনি জাতে কায়েত। আবার কারো মতে, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের দেহরক্ষী ছিলেন শঙ্কর তরঙ্গ নামে এক ব্যক্তি এবং তিনিই হচ্ছেন গোপাল ভাঁড়।
খ্রিস্টিয় উনিশ শতকের প্রথম দিকে কলকাতার বটতলার বইয়ে গোপাল ভাঁড় বিখ্যাত হোন। তবে গোপালের বংশধর দাবি করে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার ৫৪ নং সুকিয়া স্ট্রীট থেকে একটি বই লেখেন নগেন্দ্রনাথ দাস। বইটির নাম— নবদ্বীপ কাহিনী বা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ও গোপাল ভাঁড়। তাতে তিনি জানিয়েছেন, গোপালের পদবি ছিল “নাই।” গোপালের বাবার নাম— দুলালচন্দ্র নাই। পিতামহ আনন্দরাম নাই ছিলেন তন্ত্র সাধক। গোপালের বুদ্ধিতে মুগ্ধ হয়ে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র তাঁকে দরবারে ঠাঁই দেন। তখন তাঁর উপাধি হয় “ভাণ্ডারী।” আর এই “ভাণ্ডারী” থেকেই “ভাঁড়।” তবে নগেনবাবু নিজে “দাস” পদবি নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। তিনি তাঁর লেখায় গোপালের একটি বংশ তালিকাও দিয়েছেন। তালিকাটি এইরকম:
নগেন্দ্রনাথ দাস নিজেকে গোপাল ভাঁড়ের দাদা কল্যাণের বংশধর বলে দাবি করেছেন। কলকাতার সুকিয়া স্ট্রীটের কাছে ৪/১/১, রাধাপ্রসাদ লেনে পাঁচ পুরুষ ধরে বসবাস করছেন এই পরিবার।
বিগত ২০১৪ সালের কলকাতা বইমেলায় এসেছিলেন এই পরিবারের তিন সদস্য— মলয় কুমার দাস, বিষ্ণুমাধব দাস ও ৬ বছরের শৌভিক দাস। মলয়বাবু ত্রয়োদশ প্রজন্ম। সি.ই.এস.সি থেকে অ্যাসিস্ট্যন্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে অবসর নিয়েছেন। তবে তাঁরা কেউ আর হাস্যরসিক নন, পেশার টানে অন্য মানুষ।
অন্যদিকে, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের বংশধর সৌমিকচন্দ্র রায় জানিয়েছেন, গোপাল কাল্পনিক চরিত্র নন্, তাঁদের রাজবাড়ির প্রিয়জন ছিলেন।
রমেশ ও উমেশের মৃত্যুর পর গোপালের বংশ লোপ পেয়েছিল বলে তাঁর বিষয় সম্পত্তির খবর কেউ রাখেন নি, এটাও যুক্তিসঙ্গত কথা। তাই গোপালের কোনো জমি-বাড়ির দলিল পাওয়া যায় নি।
তবে গোপালের অনেক গল্পে তাঁর মা ও স্ত্রীর কথা থাকলেও বংশতালিকায় তাঁদের নাম নেই। তাঁরা শুধু বেঁচে আছেন গোপালের গল্পে।
কৃষ্ণনগর পৌরসভার সীমানায় ঘূর্ণিতে গোপাল ভাঁড়ের মূর্তি বসেছে। হাস্যরসিক বাঙালিকে আবার একবার মনে করিয়ে দিচ্ছে হাসির রাজা গোপাল ভাঁড় আজকের এই জেটযুগেও সমান জনপ্রিয়।
আপনার মতামত জানানঃ