দেশে গ্যাস সরবরাহের বেশিরভাগই আসে স্থানীয়ভাবে উত্তোলনের মাধ্যমে। যদিও এ বাবদ ব্যয়কৃত অর্থের সিংহভাগ চলে যাচ্ছে এলএনজিতে। ২০১৮ সালে দেশে এলএনজি আমদানি শুরুর পর থেকে গত চার অর্থবছরে গ্যাস সরবরাহে জ্বালানি বিভাগের মোট অর্থ ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকার কিছু বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ব্যয়কৃত এ অর্থের ৭৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ খরচ হয়েছে এলএনজি আমদানিতে। দেশে গ্যাস উত্তোলনকারী বিদেশী কোম্পানিগুলোকে (আইওসি) দিতে হয়েছে ১৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ। আর স্থানীয়ভাবে গ্যাস উত্তোলনকারী তিন দেশী কোম্পানির পেছনে ব্যয় হয়েছে ৫ শতাংশের কিছু বেশি।
অন্যদিকে গত চার অর্থবছরের জাতীয় গ্রিডে দৈনিক গ্যাস সরবরাহের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ সময় দৈনিক গড় সরবরাহ হয়েছে ২ হাজার ৭০০ মিলিয়ন থেকে ২ হাজার ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে আইওসির গ্যাস সরবরাহ ছিল ৫০ শতাংশ। স্থানীয় কোম্পানিগুলোর গ্যাস সরবরাহ ছিল ২৬ শতাংশ। আর আমদানীকৃত এলএনজি সরবরাহ হয়েছে গড়ে ২৪ শতাংশ।
সরবরাহে স্বল্প অবদান রাখা এলএনজি আমদানি করতে গিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে জ্বালানি বিভাগ। এতে আর্থিক ঝুঁকিতে পড়েছে জ্বালানি খাত। আবার দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে স্থানীয় গ্যাস উত্তোলন ও অনুসন্ধানে বিনিয়োগ ছিল যৎসামান্য। দেশে গ্যাসের সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় চলমান সংকটের পেছনে বিষয়টি অনেকাংশেই দায়ী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এই এলএনজি-নির্ভরতা কাটিয়ে ওঠা না গেলে সামনের দিনগুলোয় বিপত্তির মাত্রা আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।
২০১৮ সাল থেকে দেশে এলএনজি আমদানি শুরু হয়। পেট্রোবাংলার এক হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত জ্বালানি পণ্যটি আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৮৫ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা, যা গ্যাস সরবরাহ বাবদ মোট ব্যয়ের ৭৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ। স্থানীয় পর্যায়ে গ্যাসের উত্তোলনে নিয়োজিত রয়েছে বিদেশী দুটি কোম্পানি শেভরন ও তাল্লো। এ দুই কোম্পানিকে ২০২১-২২ পর্যন্ত চার অর্থবছরে গ্যাস সরবরাহের জন্য অর্থ দেয়া হয়েছে ১৯ হাজার ২০৮ কোটি টাকা, যা ব্যয়কৃত অর্থের ১৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
এছাড়া গ্যাস উত্তোলনে স্থানীয় তিন কোম্পানি নিয়োজিত আছে তিনটি—বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (বিজিএফসিএল), সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (এসজিএফসিএল) এবং বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স)। এ তিন কোম্পানিকে চার অর্থবছরে দেশে গ্যাস সরবরাহের জন্য পরিশোধ করা হয়েছে ৫ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা, যা এ বাবদ ব্যয়কৃত অর্থের ৫ দশমিক ২৬ শতাংশ।
২০২১-২২ অর্থবছরের পর গত অর্থবছরের এখনো পূর্ণাঙ্গ কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি পেট্রোবাংলা ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে পেট্রোবাংলার গত অর্থবছরের (২০২২-২৩) এপ্রিল পর্যন্ত তথ্য হালনাগাদ করে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ব্যয়কৃত অর্থের যে হিসাব তুলে ধরা হয়েছে, সেখানেও আগের অর্থবছরগুলোর ব্যয়ের ধারা অব্যাহত থাকতে দেখা গেছে।
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, গত শুক্রবারও দেশে প্রায় ২ হাজার ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ হয়েছে। এর মধ্যেও সবচেয়ে বড় অবদান ছিল আইওসির। আমদানিকৃত এলএনজির অবদান সবচেয়ে কম।
চার অর্থবছরের স্থানীয়ভাবে উত্তোলনকৃত গ্যাসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬১ শতাংশ, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬৩, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬৫ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬৩ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ দিয়েছে আইওসিগুলো। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ে উত্তোলিত গ্যাসের সবচেয়ে বড় জোগানদাতা মার্কিন জ্বালানি খাতের বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন।
২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ২৫২টি এলএনজিবাহী কার্গো দেশে এসেছে। এ পরিমাণ কার্গো এলএনজি আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৮৫ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এলএনজি আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ১১ হাজার ৮১২ কোটি টাকা। এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রায় ১৭ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৭ হাজার ৬৯২ কোটি ও ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩৮ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
এলএনজি আমদানিসংশ্লিষ্ট কাজে জড়িত পেট্রোবাংলার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত অর্থবছরে এলএনজি আমদানি ব্যয় আগের অর্থবছরগুলোর তুলনায় কিছুটা কম হতে পারে। কারণ কয়েক মাস ধরে স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম কম থাকায় জ্বালানি বিভাগ কম মূল্যে এলএনজি কার্গো কিনতে পারছে।
আমদানি-নির্ভরতা না থাকলে দেশে গ্যাস খাতে সরবরাহ বজায় রাখতে গিয়ে এত অর্থ ব্যয় করতে হতো না বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, এলএনজিতে বেশি পরিমাণে ঝুঁকতে গিয়ে আগের বছরগুলোয় বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে ফেলেছে জ্বালানি বিভাগ। এ নীতি থেকে বেরিয়ে আসা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সাবেক সদস্য মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্থানীয় গ্যাস খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বিদেশ থেকে আমদানি করা তেল-গ্যাসে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা সম্ভব নয় বলেই তিনি এমনটি করেছিলেন। কিন্তু আমরা সে নীতির উল্টোপথে হেঁটেছি। আর তা করতে গিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ এলএনজি কিনতে গিয়ে খরচ করে ফেলেছি। যে পরিমাণ অর্থ আমদানিতে ব্যয় করা হচ্ছে তা দেশে বিনিয়োগ করা হলে দুই বছরের মধ্যে আমদানি-নির্ভরতা কমিয়ে আনা সম্ভব।’
দেশে স্থানীয়ভাবে যে গ্যাস উত্তোলন করা হয় তার আর্থিক কোনো মূল্য নিরূপণ করা হয়নি। মূলত স্থানীয় কোম্পানিগুলোর পরিচালন ব্যয় হিসাব করে স্থানীয়ভাবে উত্তোলিত গ্যাসের দাম বিবেচনা করা হয়। বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে যে গ্যাস ক্রয় করা হচ্ছে, তা হিসাব করলেও দেশী গ্যাসের মূল্য পুরোপুরি নিরূপণ করা সম্ভব নয়। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির মূল্যকে বিবেচনায় নিলে এ দাম আরো ভালোভাবে হিসাব করা যায় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘স্থানীয় গ্যাস কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে দেশে যে গ্যাস উত্তোলন হচ্ছে, সেটি পরিচালন ব্যয় মাত্র। এটি গ্যাসের অর্থমূল্য নয়। কিন্তু বিদেশী কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে যে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে সেটিরও কিছুটা অর্থমূল্য রয়েছে। বিদেশী বিনিয়োগ পেলে দেশে আরো অনেক বেশি গ্যাস পাওয়া যেত। কম মূল্যে গ্যাস উত্তোলন করে বিপুল পরিমাণ অর্থ; বিশেষত ডলার সাশ্রয় করা যেত। কিন্তু আমরা সেটি করতে পারিনি। কারণ গত দুই দশকে এ দেশের জ্বালানি খাতে খুব বেশি বিনিয়োগ হয়নি। যদি বিনিয়োগ করা যেত, তাহলে এলএনজির ওপর নির্ভরশীলতা কমানো যেত।
আপনার মতামত জানানঃ