ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) বছরে প্রায় ২৫০০ কোটি ডলারের বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানি হয়। এরমধ্যে ইইউ’র ২৭ দেশে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির ৯৩ শতাংশই তৈরি পোশাক। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইইউতে রপ্তানি আরও বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। তবে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানিয়ে গৃহীত প্রস্তাব নিয়ে নতুন করে দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে রপ্তানিকারকদের মাঝে।
বর্তমানের শুল্কমুক্ত সুবিধা ‘এভরিথিং বাট আর্মস’ এর মেয়াদ বাড়ানো এবং ‘জিএসপি প্লাস’-সংক্রান্ত আলোচনার জন্য পার্লামেন্টের এ প্রস্তাবকে ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন তারা। সংশ্লিষ্টরা জানান, ইইউ’র সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও তাদের উদ্বেগ গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিতে হবে। তা না হলে রপ্তানি খাতের জন্য কঠিন বিপদ অপেক্ষা করছে।
জানা গেছে, অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা বা জিএসপি’র কারণে গত দুই দশকে ইউরোপের ২৭ দেশে পোশাকশিল্প শক্ত অবস্থানে পৌঁছেছে। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল তালিকায় যুক্ত হলেও পরের ৩ বছর সুবিধাটি থাকবে।
এরপর ২০২৯ সালের পর ইইউতে শুল্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশকে জিএসপি প্লাসের জন্য যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। তবে ২০২৪-৩৪ সালের জন্য জিএসপি’র নতুন নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত করেছে ইউরোপীয় কমিশন। সেটি ইইউ পার্লামেন্টে এখনো অনুমোদন হয়নি।
জিএসপি প্লাসের খসড়াটি হুবহু ইইউ পার্লামেন্টে অনুমোদিত হলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক এই সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রাথমিক শর্তেই আটকে যাবে। তখন প্রায় ১২ শতাংশ শুল্ক দিয়ে ইইউতে পোশাক রপ্তানি করতে হবে। এজন্য ইইউ’র সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের আলোচনা চলছে। বর্তমানে ইইউ’র বাজারে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, উজবেকিস্তান, বলিভিয়াসহ আটটি দেশ জিএসপি প্লাস সুবিধা পায়। আর বাংলাদেশসহ ৪৬টি স্বল্পোন্নত দেশ জিএসপি সুবিধা পাচ্ছে।
এমন প্রেক্ষাপটে গত সপ্তাহে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতিতে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে ইইউ পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাব কণ্ঠভোটে গৃহীত হয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের জন্য ইইউ’র অবাধ বাজার সুবিধা ‘এভরিথিং বাট আর্মস’-এর (ইবিএ) পরিসর আরও বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলমান। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক সনদ লঙ্ঘনের মাধ্যমে মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের মামলাটি একটি পশ্চাদগামী পদক্ষেপ, যা উদ্বেগের।
জানা গেছে, স্বল্পোন্নত দেশের জন্য ইইউ জিএসপি স্কিমের মেয়াদ ১০ বছরের জন্য হয়ে থাকে। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পর্যালোচনা করে নতুন করে আবার মেয়াদ বাড়ানো হয়। চলতি মেয়াদ আগামী ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা। এ সংক্রান্ত একটি খসড়া ২০২১ সালে করা হয়েছে, যা ইইউ পার্লামেন্টে এখনো পাস হয়নি। অন্যদিকে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর ‘জিএসপি প্লাস’ স্কিমের জন্য যোগ্য বিবেচিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষক এবং গবেষণা সংস্থা র্যাপিডের চেয়ারম্যান ড. আব্দুর রাজ্জাক মনে করেন, ইইউ’র বিবৃতিতে ইবিএ সুবিধা অব্যাহত রাখা উচিত কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। ইইউ’র বিবৃতি অত্যন্ত উদ্বেগের কারণ। বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। সরকারকে এ বিষয়ে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত হতে হবে। তা না হলে রপ্তানি খাতের জন্য হয়তো বিপদ অপেক্ষা করছে।
কারণ, ইইউ চাইলে যেকোনো মুহূর্তে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা প্রত্যাহার করতে পারে। এ রকম উদাহরণ আছে। মানবাধিকার ইস্যুতে আপত্তির কারণে কম্বোডিয়ার বিরুদ্ধে শাস্তি হিসেবে সে দেশের ১০ শতাংশ পণ্যের ওপর শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা প্রত্যাহার করেছে ইইউ। এরপর ওই ১০ শতাংশ পণ্যে ১২ শতাংশ শুল্কারোপ হয়েছে। এতে তাদের রপ্তানি হোঁচট খেয়েছে। ২০২০ সালে আরোপ করা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা এখনো বহাল আছে।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের গৃহীত প্রস্তাব ‘জিএসপি প্লাস’ আলোচনায় বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে দিলো। বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে সরকারকে। অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, মানবাধিকারসহ যেসব বিষয়ে তাদের আপত্তি, সেগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিতে হবে। আলোচনার মাধ্যমেই আপত্তির সুরাহা করতে হবে। যাতে ব্যবসা-বাণিজ্য বিশেষত রপ্তানি যেন নতুন করে কোনো সংকটে না পড়ে।
পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএ এলডিসি-উত্তর পরবর্তী সময়ে ২০৩৬ সাল পর্যন্ত এ সুবিধা অব্যাহত রাখার অনুরোধ জানিয়েছে। বিজিএমইএ জানান, বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত তিন দফা ব্রাসেলসে ইইউ পার্লামেন্টের প্রভাবশালী কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। ব্যবসা এবং বিনিয়োগকে যাতে সব ধরনের রাজনীতির বাইরে রাখা হয়, তার সুপারিশ করেছেন এসব বৈঠকে।
আপনার মতামত জানানঃ