বাংলাদেশের বিরোধী দল বিএনপি আগামী দুই মাসকে তাদের দাবি মানতে সরকারকে বাধ্য করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সময় বলে বিবেচনা করছে। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বলছেন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই নির্বাচন প্রশ্নে সরকারকে একটি ‘গ্রহণযোগ্য সমাধানে আসতে বাধ্য করতে’ প্রয়োজনীয় সব কিছু করার জন্যই প্রস্তুত হচ্ছেন তারা।
নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ নাগাদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করার কথা রয়েছে নির্বাচন কমিশনের এবং প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভোট গ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করে ওই তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে।
কিন্তু বিএনপি চাইছে তফসিল ঘোষণার আগেই নির্বাচন ইস্যুতে রাজনৈতিক ফয়সালা নিশ্চিত করতে এবং এ লক্ষ্যে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই বড় ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণার চিন্তা আছে দলের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে।
এসব কর্মসূচির মধ্যে ঢাকা ঘেরাও, সচিবালয় ঘেরাও, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘিরে কর্মসূচিসহ নানা ধরণের কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে দলের অভ্যন্তরে।
আর এসব কর্মসূচিতে সরকার পক্ষ বাধা দিলে ‘যদি পরিস্থিতি সহিংস হয়ে ওঠে’ তাহলে এক পর্যায়ে অসহযোগ আন্দোলনের দিকেও যেতে পারে দলটি, এমন ধারণেই পাওয়া গেছে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে।
বাংলাদেশে ১৯৯৬ সালের পনেরই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগের অসহযোগ আন্দোলনের মুখেই সে সময়কার খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার পদত্যাগ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে বাধ্য হয়েছিলো।
বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা বলেছেন কোন ধরণের আক্রমণাত্মক পথে না গিয়ে একের পর একে কর্মসূচির মাধ্যমে তারাও একই পরিস্থিতি তৈরি করবেন দাবি আদায়ের জন্য, যাতে করে তার ভাষায় ‘সরকার গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রশ্নে সমঝোতায় বাধ্য হয়’।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, যে কোন সময়, যে কোন স্থানে বসে মানুষকে নিষ্পেষণের যেসব নার্ভ সরকারের হয়ে কাজ করে সেগুলোকে অচল করে দিবো আমরা। সরকারকে দাবি মানতে হবে।
আর এসবের প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই শনিবার রংপুর থেকে দিনাজপুর পর্যন্ত ‘তারুণ্যের রোডমার্চ’ কর্মসূচি পালন করছে দলটি। আর আজ রোববার বগুড়া থেকে রাজশাহী পর্যন্ত একই কর্মসূচি পালিত হওয়ার কথা।
এরপর আরও কয়েকটি বিভাগে এই কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি ঢাকায় বড় ধরণের ছাত্র বা শ্রমিক গণসমাবেশের আয়োজন হতে পারে চলতি মাসের মধ্যেই। যদিও সরকারি দল আওয়ামী লীগ বরাবরই বলে আসছে যে আগামী নির্বাচন দেশের সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে।
অক্টোবর-নভেম্বর ঘিরে যত কৌশল
বিএনপি দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছে যে শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতায় রেখে কোন নির্বাচন তারা মেনে নেবে না এবং এ ধরণের নির্বাচন তারা হতেও দেবে না। এ লক্ষ্যেই সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলন করে আসছে তারা। দলের সূত্রগুলো বলছে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত চলমান আন্দোলনের কর্মসূচিগুলো অব্যাহত থাকবে। তবে এরপর থেকেই কর্মসূচির ঢেউ বাড়ানোর চিন্তা করা হচ্ছে।
অর্থাৎ রাজধানী ঢাকা, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, নির্বাচন কমিশন কিংবা সচিবালয় কেন্দ্রিক কর্মসূচিগুলো ওই সময়ে ঘোষণা করা যায় কি-না তা নিয়ে নানা ধরনের পর্যালোচনা হচ্ছে। দলের নেতারা মনে করছেন আন্তর্জাতিক নানা চাপের কারণে কিছুটা নমনীয় থাকা সরকার এসব কর্মসূচিকে ঘিরে সহিংস আচরণ করলে একদিকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের চাপ বাড়বে সরকারের উপর , অন্যদিকে বিএনপি কর্মী সমর্থকরাও রাজপথে নেমে আসবেন।
“আমরা তো ৯৬ সালের আন্দোলন ভুলিনি। আর এখনকার পরিস্থিতিতে আমরা কর্মী সমর্থকরাও জানি যে আর পিছু হটার সুযোগ নেই। তাই আঘাত আসলে মুখ বুজে তো সহ্য করবো না। সরকার তীব্রতা বাড়ালে সমুচিত জবাব পাবে,” বলছিলেন দলটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নাসির উদ্দিন আহমেদ অসীম।
তিনটি বিষয়ে দৃষ্টি
দলের গুরুত্বপূর্ণ সূত্রগুলো জানিয়েছে আগামী দুমাসে দলের সব কার্যক্রমে ফোকাস থাকবে তিনটি বিষয়ের উপর। এগুলো হলো যত বেশি সম্ভব রাজনৈতিক দলকে নিজেদের দিকে নিয়ে আসা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে বৈশ্বিকভাবে প্রভাবশালী দেশগুলোর নির্বাচন প্রশ্নে বর্তমান মনোভাবকে বহাল রাখা আর মাঠের কর্মসূচির মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা।
অর্থাৎ নির্বাচনের তফসিল একতরফাভাবে ঘোষণা হলে যাতে করে যত বেশি সংখ্যক দলকে নির্বাচনে অংশ নেয়া থেকে বিরত রাখা যায় সেই চেষ্টাই করবে দলটি। কারণ দলের নেতারা অনেকেই মনে করেন যে একবার নির্বাচন সরকার একতরফা ভাবে করে ফেললে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা কঠিন হয়ে উঠবে। তাই তারা চান ‘পরিস্থিতি যাই হোক তফসিল ঘোষণার আগেই’ সরকারি দলের বাইরে সব দলকে এক জায়গায় নিয়ে এসে ‘দাবি আদায় করা যাবে এমন পরিস্থিতি তৈরি করার’’ মতো অবস্থা তৈরি করা।
পাশাপাশি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবস্থান- এমন বিষয়গুলো যাতে অব্যাহত থাকে সে চেষ্টাও থাকবে দলের পক্ষ থেকে। যুক্তরাষ্ট্র আগেই ভিসা নীতি ঘোষণা করে বলেছে যে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে অন্তরায় যারাই হবে তারাই ওই নীতির আওতায় পড়বেন।
মূলত এ ভিসা নীতি ঘোষণার পরই ‘সরকার বেকায়দায় পড়ে’ বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। তবে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে সক্রিয় প্রভাবশালী বিদেশী শক্তিগুলো চায় না, এমন কোন কর্মসূচি দেয়া থেকে বিএনপি বিরত থাকবে এটিও নিশ্চিত করতে চান দলের নেতারা।
কারণ ভিসা নীতি ঘোষণায় সরকার বেকায়দার পড়লেও এটি শুধুমাত্র সরকার বা সরকারি দলকে উদ্দেশ্য করে ঘোষণা করা হয়নি। মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলছেন বিএনপি কোনভাবেই সহিংসতা তৈরি করবে না, তবে বাধা আসলে প্রতিরোধ থেকেও বিরত থাকবে না।
দলটির একাধিক নেতাদের সাথে কথা বলে বোঝা গেছে যে তারা মনে করছেন ‘আন্তর্জাতিক চাপ আর অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে’ সরকার বেকায়দায় পড়েছে এবং এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন প্রশ্নে ‘আওয়ামী লীগের আর এককভাবে লাভবান হওয়ার’ সুযোগ নেই। অর্থাৎ তারা মনে করছেন কোনও রকমে তফসিল ঘোষণা করে একটা নির্বাচন করে ফেলার মতো পরিস্থিতি এখন আর বাংলাদেশে নেই।
নেতাদের কাছ থেকে আরেকটি ধারণা পাওয়া গেছে যে তারা নিজেরা সহিংসতা এড়িয়ে চলবেন যাতে করে ২০১৪ সালে জ্বালাও পোড়াওয়ের জন্য যেভাবে সরকার বিএনপিকে দায়ী করেছে তেমন পরিস্থিতি আর না হয়। তবে সরকার পক্ষ আক্রমণ করলে সেখানে আর কোন ছাড় তারা দেবেন না এবং এসব ক্ষেত্রে দলীয় সিদ্ধান্তগুলো নেয়ার আগে বৈশ্বিক শক্তিগুলোর মতামত যাচাই করবেন তারা।
অক্টোবরের আগেই প্রয়োজনীয় পরিবর্তন
গত কয়েকদিন ধরেই বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটিতে কিছু পরিবর্তনের কাজ দেখা যাচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা মহানগর ইউনিটে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান কারাগারে থাকায় ফরহাদ হালিম ডোনারকে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক করা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনু কারাগারে থাকায় ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব করা হয়েছে লিটন মাহমুদকে। এর আগে গত মাসেই ছাত্রদল সভাপতিতে সরিয়ে দেয়া সহ বেশ কিছু সাংগঠনিক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিলো বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনগুলোর ক্ষেত্রে।
ইতোমধ্যেই দলের সর্বস্তরে বার্তা দেয়া হয়েছে যে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত দলীয় কর্মসূচিতে যারা নিষ্ক্রিয় থাকবেন তাদের কোনও পদে রাখা হবে না।
আপনার মতামত জানানঃ