আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট মধু মাখানো বরফ খেতে পছন্দ করতেন। বাইবেলে আছে, রাজা সলোমন বরফ কুচি মেশানো পানিয়ের ভক্ত ছিলেন। রোমান সম্রাট নিরো ক্লডিয়াস সিজার প্রায়ই লোক পাঠাতেন পাহাড়ের বরফ কুড়িয়ে আনতে, তারপর তা ফলের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে খেতেন।
এর পরের খবর হাজার বছর পরের। মার্কো পোলো চীন থেকে ইতালিতে ফেরার পর এমন একটি খাবারের কথা বললেন যা শরবতের কাছাকাছি একটা কিছু। সতেরো শতকে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম চার্লসের খাবার টেবিলে ক্রিম আইস উপস্থিত থাকত নিয়মিতভাবে।
আমেরিকায় আইসক্রিমের প্রথম বিজ্ঞাপন বের হয় নিউ ইয়র্ক গেজেটে, ১৭৭৭ সালে। ১৭৯০ সালের গ্রীষ্মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন আইসক্রিমের পিছনে প্রায় ২০০ ডলার খরচ করেছেন। ১৮০০ সালের আগে আমেরিকার সাধারণ মানুষের পাতে আইসক্রিমের দেখা মেলে না, শুধু অভিজাতরাই এর ব্যয়ভার বহন করতে পারত।
সব সত্ত্বেও ইতিহাস গবেষক হাশেম সূফি বললেন, ‘মোগলরাই পৃথিবীকে আইসক্রিম উপহার দিয়েছে, আধুনিক আইসক্রিম। কুলফির কথা ধরা যাক, মোগলদের বাড়ি বাড়ি এ আইসক্রিম বানানো হতো। এখনকার ভারতেও সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় কুলফি। আমাদের দেশেও এর জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করার মতো।
নামকরা আইসক্রিম ব্র্যান্ডগুলোর যেমন কুলফি আছে, তেমনি আবার ঠেলা গাড়ির ওপর বড় মটকা চাপিয়েও বিক্রি হয় কুলফি। সম্রাট আকবরের রাজকীয় রান্নাঘরে কোনাকৃতির ধাতব ছাঁচের ভেতর জন্ম হয়েছিল কুলফির, সে থেকে তার আমীর-ওমরাহ সকলেই কুলফি দিয়ে শরীর জুড়াতে পছন্দ করতেন। তারপর ধরুন ফালুদা, জমিয়ে নিলে এটা একালের টুটি ফ্রুটি।’
জনাব সূফির সঙ্গে কথা বলে দেশ ভাগ পরবর্তী ঢাকার বেবি আইসক্রিমের কথা জানা গেল। চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান গোটা পাকিস্তানের প্রথম রঙিন ছবি ‘সংগম’ নির্মাণ করেছিলেন। উর্দু ভাষার সে ছবির নায়ক ছিলেন হারুন। হারুনের বাবা ছিলেন একজন শিল্পপতি। তিনি বেবি আইসক্রিম কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পঞ্চাশের দশকে। কারখানা ছিল আজিমপুরে।
ঢাকায় আধুনিক চেহারার প্রথম আইসক্রিম ওই বেবি। বিভিন্ন গড়ন, যেমন: কোণাকৃতি, বর্গাকৃতি বা গোলাকৃতির আইসক্রিম তারাই সুন্দর মোড়কে বাজারে নিয়ে আসে প্রথম।
গোড়ার দিকে ফেরিওয়ালাদের দিয়ে তারা পাড়ায় পাড়ায় আর স্কুলের গেটে আইসক্রিম বিক্রি করত। তখন হাতে বয়ে নেওয়ার উপযোগী ফোম লাগানো কাঠের বাক্স ছিল যার ভিতর আইসক্রিম রাখা হতো। প্রায় সারাদিন ধরে এতে আইসক্রিম জমাট থাকত, বিকাল নাগাদ গলতে থাকত। দশ পয়সার আইসক্রিম তাই পাঁচ পয়সায় ছেড়ে দিত ফেরিওয়ালারা।
লোকজন ভাবত হারুনরা বিহারী, তারপর ভেবেছিল আগাখানি কিন্তু আসলে তারা ছিল পাঠান। সব অবাঙালিকেই বিহারী বলে ধরে নেওয়ার প্রবণতা ছিল এখানে। কিন্তু গুজরাত, মুম্বাই, রাজস্থান থেকেও অনেকে এসেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে মূলত আগাখানি, গুজরাতি বা মুম্বাই থেকে আসা লোকজনই করতো আইসক্রিমের ব্যবসা।
বেবির আগে কি ঢাকায় আইসক্রিম ছিল না? হাশেম সূফী বললেন, ‘নিশ্চয় ছিল। দু-তিন মহল্লা পর পর একটি করে আইসক্রিমের দোকান ছিল। তারা মূলত স্যাকারিন দেওয়া বরফ আইসক্রিম বিক্রি করত। এগুলো হলুদ, লাল বা সবুজ রঙের হতো। পরের দিকে এর সঙ্গে যোগ দেয় মালাই আইসক্রিম। পানি আর চিনির সঙ্গে দুধ গুলে দিয়ে মালাই আইসক্রিম তৈরি হত।’
অবশ্য মহল্লায় তৈরি আইসক্রিম খাওয়ার ব্যাপারে ছেলে মেয়েদের নিরুৎসাহ করতেন অভিভাবকরা। কারণ পরিস্কার পানি সহজলভ্য না হওয়ায় দূষিত পানি ব্যবহার করে আইসক্রিম তৈরি করা লাগত। ফলে বাচ্চাদের পেট খারাপ হতো।
সেকারণেই সম্ভবত সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলো বাড়িতে আইসক্রিম তৈরি করত। চারকোনা বাক্স থাকত বনেদি বাড়িগুলোয়। হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে বরফ গুঁড়ো করা হতো, পরে তাতে দুধ-চিনি মিশিয়ে তৈরি করা হতো আইসক্রিম।
জনাব সূফী জানিয়েছেন, ভারতবর্ষে কোম্পানি আমলে (ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি) আইসক্রিমের কারখানা খোলা হয়। ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানদের এতে জীবিকা উপার্জনের পথ খুলেছিল। তারা ফেরি করে আইসক্রিম বিক্রি করতেন। অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরাও নিজেদের বাড়িতে কেক এবং আইসক্রিম তৈরি করতেন, আর স্থানীয় লোকেরা সেগুলো ফেরি করে বিক্রি করতেন। ধারণা করা কঠিন নয় যে, সেকালে বড় পরিসরে উৎপাদন সহজ ছিল না।
‘পাঙ্খা আইসক্রিম’ বলে আরেক ধরনের আইসক্রিমের কথা বললেন হাশেম সূফী। এ আইসক্রিম তৈরির সময় চামড়ার ব্যাগে বরফ ঢুকিয়ে কাষ্ঠ দণ্ড দিয়ে পিটিয়ে গুঁড়ো করা হতো। তারপর পাখা, ছাতা ইত্যাদি ছাঁচে ঢালা হতো। ফলে ছাঁচের গড়ন অনুযায়ী তৈরি হতো আইসক্রিম। স্কুলের ছেলে-মেয়েদের কাছে এটা জনপ্রিয় ছিল এর গড়নের কারণে। আর এগুলো সবই ছিল কাঠি আইসক্রিম। কাপ, কোন ইত্যাদি আরো পরের কথা।
আপনার মতামত জানানঃ