প্রায় বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল মানবজাতির পূর্বপুরুষ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ৮ থেকে ৯ লাখ বছর আগে এক বিবর্তনীয় সংকটের মুখে পড়ে বিলুপ্তির পথে ছিল মানবজাতির পূর্বপুরুষ।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একদল গবেষক বিপুল পরিমাণ জিন বিশ্লেষণ করে এ ধরনের একটি পরিস্থিতির সম্ভাব্যতার বিষয়ে মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছেন।
প্রায় ৩ হাজারেরও বেশি জীবিত মানুষের জিন বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা দেখেছেন, মানুষের পূর্বপুরুষের সংখ্যা হ্রাস পেয়ে প্রজননক্ষমদের সংখ্যা ১ হাজার ২৮০–এ নেমে এসেছিল। প্রায় ১ লাখ ১৭ হাজার বছর পর্যন্ত এ অবস্থা ছিল। বিজ্ঞানীদের ধারণা, কোনো চরম আবহাওয়ার কারণে এমন অস্তিত্ব সংকটে পড়ে থাকতে পারে মানুষের পূর্বপুরুষেরা।
ইতালির রোমের সাপিয়েঞ্জা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতাত্ত্বিক ও গবেষণা প্রতিবেদনের জ্যেষ্ঠ লেখক অধ্যাপক জর্জীয় মানজি বলেন, ‘আমাদের গবেষণা থেকে পাওয়া সংখ্যা বর্তমানে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা প্রজাতির সংখ্যার সঙ্গে মিলে যায়।’
মানজি বলেন, ‘সৌভাগ্যক্রমে মানবজাতি বেঁচে যায়। তবে বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান থেকে আমরা জানি যে, ছোট ও বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী থেকেই নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটে।’
মানজি এবং তাঁর সহকর্মীদের ধারণা, অস্তিত্ব বিলুপ্তির ওই সংকটের চাপেই নতুন প্রজাতি হোমো হাইডেলবাজেনসিসের আবির্ভাব ঘটে। মনে করা হয়, এটি প্রজাতিটি আধুনিক মানুষ এবং এর কাছাকাছি প্রজাতি নিয়ানডার্থাল ও ডেনিসোভানসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। যেখানে হোমো স্যাপিয়েন্সের উদ্ভব ঘটেছে প্রায় ৩ লাখ বছর আগে।
লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্টরি মিউজিয়ামের মানব উৎপত্তির প্রধান অধ্যাপক ক্রিস স্ট্রিঞ্জার বলেন, ‘এই সময়সীমাটি খুবই ব্যতিক্রম (যে সময়ের মধ্যে কোনো জীবাশ্ম পাওয়া যাচ্ছে না)। আমরা যে এটি পার হতে পেরেছি, সেটিও একটি অনন্য ঘটনা। এ (ছোট) আকারের জনসংখ্যা বিলুপ্ত হওয়ার জন্য শুধু একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, একটি মহামারি বা একটি অগ্ন্যুৎপাতই যথেষ্ট।’
জনসংখ্যার এই ব্যাপক হ্রাস উল্লেখযোগ্য বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের পরিস্থিতির সঙ্গে মিলে যায় যা দীর্ঘ কালব্যাপী বরফ যুগের মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছে। সেই সঙ্গে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা কমে যাওয়া এবং আফ্রিকা ও ইউরেশিয়ার সম্ভাব্য দীর্ঘকালব্যাপী খরার মতো ঘটনার জন্য দায়ী হতে পারে এ ধরনের জলবায়ু পরিবর্তন।
গবেষক দলটি বলছে, এই সময়টার সঙ্গে আরেকটি ঘটনা মিলে যাচ্ছে, সেটি হলো তুলনামূলকভাবে জীবাশ্মের কোনো রেকর্ড প্রায় না পাওয়া।
মানজি বলেন, ‘আমরা জানি যে, ৯ লাখ থেকে ৬ লাখ বছর আগের এই সময়টার মধ্যে আফ্রিকায় জীবাশ্ম রেকর্ডের সংখ্যা প্রায় শূন্যের কোঠায়। তবে, এর আগে ও পরে আমরা অনেক জীবাশ্মের প্রমাণ পেয়েছি। একই কথা ইউরেশিয়ার ক্ষেত্রেও খাটে। ইউরোপে আমরা প্রায় ৮ লাখ বছর আগে হোমো অ্যান্টেসেসর নামের একটি প্রজাতির প্রমাণ পাচ্ছি। এর পরের ২ লাখ বছর পর্যন্ত আর কোনো জীবাশ্ম পাওয়া যাচ্ছে না।’
অবশ্য স্ট্রিঞ্জার বলছেন, ‘প্রথম দিকের মানুষের জীবাশ্ম রেকর্ডে “বৈশ্বিক মানব শূন্যতার কোনো” যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই ধারণা করা হচ্ছে, কোনো স্থানীয় কারণেই এ বিবর্তনীয় অস্তিত্ব সংকট তৈরি হয়েছিল। হয়তো এ ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী আফ্রিকায় মরু বেষ্টিত কোনো এলাকায় আটকে পড়েছিল।’
বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্সে প্রকাশিত এ গবেষণা প্রতিবেদনে জীবিত ৩ হাজার ১৫৪ জনের জিনোম সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১০টি আফ্রিকার ও ৪০টি আফ্রিকার বাইরের জনগোষ্ঠীর জিন।
একই বিস্তৃত জনগোষ্ঠীর এসব জিনের বিভিন্ন ধরন বিশ্লেষণ করে ধারণা করা যেতে পারে, প্রথম নির্দিষ্ট কোনো জিনের কখন আবির্ভাব ঘটেছে। যত সময় গড়িয়েছে তত আরও বিভিন্ন জিনের আবির্ভাব ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।
নির্দিষ্ট জিনের ফ্রিকোয়েন্সি বা গণসংখ্যা হিসাব করে বলা যেতে পারে নির্দিষ্ট সময়ে কোন ধরনের জিনের আবির্ভাব ঘটেছে। এখান থেকে বিজ্ঞানীরা ধারণা পেতে পারেন, সময়ের সঙ্গে মানুষের পূর্বপুরুষগুলোর কীভাবে বিস্তার ঘটেছে এবং জনসংখ্যা সংকুচিত হয়েছে।
এ বিশ্লেষণে আফ্রিকার সমগ্র জনগোষ্ঠীর ব্যাপকভাবে জনসংখ্যা কমে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু ৪০টি অ–আফ্রিকান জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ ধরনের পরিস্থিতির পক্ষে খুবই দুর্বল প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এটি সম্ভবত অ–আফ্রিকান ঐতিহ্যের পূর্বপুরুষদের আফ্রিকার বাইরে অভিবাসন সেখানে জনসংখ্যার ব্যাপক হ্রাসের কারণ হতে পারে বলে, আগের ঘটনাটি আড়ালে পড়ে গেছে বলে ধারণা করা যেতে পারে।
আধুনিক মানুষের সর্বশেষ কাছাকাছি প্রজাতির নিয়ানডার্থাল এবং ডেনিসোভানসরা পৃথিবীতে বিচারণ করত ঠিকই ওই সময়টার সঙ্গে এই ঘটনাকাল মিলে যায়। বিজ্ঞানীরা এখন দেখার চেষ্টা করছেন, মানুষের পূর্বপুরুষ অন্যান্য প্রজাতির মধ্যেও এ ধরনের ব্যাপক জনসংখ্যা হ্রাসের ঘটনা ঘটেছে কি না। এটি জানতে পারলে বোঝা যাবে কখন, কোথায় এবং কী কারণে এসব প্রজাতির বিস্তার ঘটেছে।
এসডব্লিউএসএস/১৬০০
আপনার মতামত জানানঃ