প্রায় ২৩ বছর ধরে রাশিয়া শাসন করছেন ভ্লাদিমির পুতিন। এর মধ্যে গত ২৪ জুন পুতিনকে যে এতটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলেন তা এর আগে কখনও পড়তে হয়নি তাকে। সেইদিন তারই ঘনিষ্ঠ মিত্র ভাড়াটে সেনাদল ওয়াগনার গ্রুপের নেতা ইয়েভগেনি প্রিগোজিন রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন।
তবে বিদ্রোহ করার প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর অবশ্য অবস্থান থেকে সরে আসেন ওয়াগনারপ্রধান প্রিগোজিন। পুতিনের মিত্র বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোর মধ্যস্থতায় দলবল নিয়ে প্রিগোজিন চলে যান বেলারুশে।
সেইসময় বিবিসির বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে বলা হয়, পুতিন বিশ্বাসঘাতকতা পছন্দ করেন না। তিনি এটিকে ঘৃণা করেন। সেইসময়ে প্রকাশ্যে বিদ্রোহীদের দমন করার বার্তা দেন পুতিন, যদিও তিনি প্রিগোজিনের নাম উল্লেখ করেননি।
এরপর বিদ্রোহের পর থেকে প্রিগোজিনকে প্রকাশ্যে তেমন দেখা যায়নি। তার অবস্থান নিয়েও জল্পনা শুরু হয়েছিল। তবে শেষমেশ জানা যায়, প্রিগোজিন রাশিয়াতেই আছেন।
এরপর গত বুধবার আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় খবর আসে, প্রিগোজিনকে বহনকারী বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। সেই বিমানের সবাই নিহত হয়েছেন। গতকাল বুধবার রাজধানী মস্কো থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গগামী বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। বিমানে সাতজন যাত্রী ও তিনজন ক্রু ছিল। যাত্রীদের মধ্যে ছিলেন প্রিগোজিন ও ওয়াগনারের উপপ্রধানও।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, ব্যক্তিগত বিমানটি উড্ডয়নের আধা ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে বিধ্বস্ত হয়। বিধ্বস্ত হওয়ার পর ওই উড়োজাহাজে আগুন ধরে যায়। এখন পর্যন্ত ১০ জনেরই মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
যা বলেছে পুতিন
এ বিষয়ে প্রথম দিকে নীরব থাকলেও এবার মুখ খুললেন রুশ প্রেসেডিন্টে ভ্লাদিমির পুতিন। পাশাপাশি নিহতদের প্রতি জানিয়েছেন সমবেদনা।
পুতিন তার বক্তব্যে বলেন, প্রিগোজিনকে দীর্ঘদিন ধরে আমি চিনি। সেই ১৯৯০ সাল থেকে।
ওয়াগনার প্রধান সম্পর্কে রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন, তিনি জটিল ভাগ্যের মানুষ ছিলেন ও জীবনে গুরুতর ভুল করেছিলেন। কিন্তু তিনি সঠিক ফলাফল অর্জন করেছিলেন। পিগোজিন একজন মেধাবী মানুষ ও মেধাবী ব্যবসায়ী ছিলেন।
পুতিন বলেন, প্রিগোজিন শুধু দেশেই কাজ করেননি, বিদেশের মাটিতেও তার অবদান রয়েছে, বিশেষ করে আফ্রিকায়।
রুশ প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, আমি যতদূর জানি তা হলো একদিন আগে সে আফ্রিকা থেকে ফিরেছিলেন। কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে দেখাও করেছেন। তবে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে মারা যওয়ার বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
অন্যদিকে প্রিগোজিনের মৃত্যুর পেছনে সরাসরি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের হাত রয়েছে বলে মনে করছেন পশ্চিমা বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, গত জুনে পুতিনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ করার পর থেকেই এমন ভয়ংকর পরিণতি ‘অনিবার্য’ হয়ে পড়েছিল প্রিগোজিনের জন্য।
সূত্র মতে, বুধবার একটি প্লেন বিধ্বস্ত হয়ে ওয়াগনার প্রধানের মৃত্যুর পর একটি ব্রিকস সম্মেলনে ভার্চুয়াল বৈঠকে যোগ দেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। আন্তর্জাতিক ওই সম্মেলনে যোগ দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বললেও ওয়াগনার প্রধানের মৃত্যুর বিষয়ে তাকে কোনো কথা বলতে শোনা যায়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
গ্রে জোন নামে একটি টেলিগ্রাম চ্যানেলের একটি পোস্টে বলা হয়, প্রিগোজিন রাশিয়ার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করার পদক্ষেপের ফল স্বরূপ মারা গেছে। গ্রে জোন চ্যানেলটি ওয়াগনার গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
এ ছাড়া মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র সাবেক কর্মকর্তা ড্যানিয়েল হফম্যান দাবি করেছেন, প্রিগোজিনের মৃত্যু অবশ্যই পুতিনের নির্দেশে হয়েছে। সিআইএর মস্কো স্টেশনের সাবেক এই প্রধান বলেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই পুতিনের নির্দেশেই প্রিগোজিনের হত্যা করা হয়েছে।’
রাশিয়ার রাজনৈতিক বিশ্লেষক তাতিয়ানা স্তানোভায়া বলেছেন, এই বিমান বিধ্বস্তের কারণ যাই হোক না কেন, মানুষ এটিকে পুতিনের প্রতিশোধ হিসেবে দেখবে। এবং ক্রেমলিন এই নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়াও দেখাবে না।
তিনি আরও বলেছেন, পুতিন এ বিমান বিধ্বস্তের পেছনে জড়িত আছেন- তা বিশ্বাস করার জন্য যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ আছে। তাতিয়ানা স্তানোভায়া বলেন, প্রিগোজিনের মৃত্যু তাকে সমর্থনকারীদের জন্য একটি সরাসরি হুমকি। এটি বিক্ষোভের উৎসাহের চেয়ে বরং সরাসরি হুমকি।
ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ইন্সটিটিউট ফর দি স্টাডি অব ওয়ার (আইএসডব্লিউ) বলেছেন, প্রিগোজিনকে বহনকারী বিমানকে গুলি করতে রাশিয়ার সামরিক কমান্ডকে যে পুতিন নির্দেশ দিয়েছেন তা প্রায় সত্য।
আরও ভয়ংকর বাহিনী
এবার ওয়াগনার প্রধান নিহত হওয়ায় যদি তার ভাড়াটে সেনাদলের নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের হাতে গিয়ে পড়ে তবে দলটি আগের থেকেও বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠবে বলে মনে করেন পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী।
ওয়ানগার গ্রুপ বেলারুশে ঘাঁটি গাড়ার পর ঘুম উড়ে যায় প্রতিবেশী পোল্যান্ড সরকারের। ওয়াগনার হামলা করতে পারে এই আশঙ্কায় তারা সীমান্তে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করে সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এ নিয়ে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ইউরোপের ভূরাজনীতি উত্তপ্ত ছিল। নানা গুঞ্জন বাতাসে উড়ছিল। এর মধ্যেই বিমান বিধ্বস্ত হয়ে প্রিগোজিনের মৃত্যুর খবর এলো।
ওয়াগান গ্রুপের টেলিগ্রাম চ্যানেল গ্রে জোনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়ার সামরিক বাহিনী ওই বিমানটিকে গুলি করে ভূপাতিত করেছে; যদিও তারা তাদের দাবির বিষয়ে কোনো প্রমাণ হাজির করেনি।
এসডব্লিউএসএস/১৪৫৫
আপনার মতামত জানানঃ