প্রাচীন জাতের তুলনায় আধুনিক কুকুরের মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে বলে জানা গেছে সাম্প্রতিক এক গবেষণায়। মানুষের সাথে প্রাণীটির মিথস্ক্রিয়ার কারণে এমনটা হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইভল্যুশন জার্নালে প্রকাশিত ওই গবেষণায় আধুনিক ও প্রাচীন উভয় কুকুরের মস্তিষ্কের আকার পরীক্ষা করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, কুকুরের মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। কুকুর নেকড়ে বা এ জাতীয় প্রাণী থেকে বিবর্তিত হয়ে এসেছে বলে মনে করা হয়। তাই গবেষকেরা নেকড়ের মস্তিষ্কের সঙ্গে কুকুরের মস্তিষ্কের তুলনাও করেছেন।
ইএলটিই ইনস্টিটিউট অব বায়োলজি-এর ইথোলজি বিভাগের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো এনিকো কুবিনি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছেন, ‘প্রাচীন কুকুরের জাত থেকে আধুনিক কুকুর পর্যন্ত বংশবৃদ্ধির সময়ে ধীরে ধীরে প্রাণীটির মস্তিষ্ক বড় হচ্ছে।’
এই গবেষক বলেন, ‘আমরা কুকুরের প্রজাতির ধরন কিংবা বংশবৃদ্ধির ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে এটাকে ব্যাখ্যা করতে পারি না। আমরা কেবল কারণগুলো সম্পর্কে অনুমান করতে পারি।’ অর্থাৎ মস্তিষ্ক বড় হওয়া নিয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এখনো গবেষকদের কাছে নেই। কিছু অনুমানের ভিত্তিতে এই পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা করেছেন তারা।
গবেষণায় হাঙ্গেরি ও সুইডেনের একদল বিজ্ঞানী সিটি স্ক্যান করা ১৫৯ জাতের ৮৫০টি কুকুরের মস্তিষ্ক এবং সেগুলোর আকার পরীক্ষা করেছেন। এরপর সেগুলোকে ৪৮ প্রজাতির নেকড়ের মস্তিষ্কের তথ্যের সঙ্গে তুলনা করে দেখেছেন।
গবেষকেরা দেখতে পান, নেকড়ের সমান ওজনের একটি কুকুরের মস্তিষ্ক সেই নেকড়ের মস্তিষ্কের তিন-চতুর্থাংশ। এটি এখন পর্যন্ত অতীতের এক গবেষণার তথ্যের সত্যতা দেয়। ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, গৃহপালিত হলে প্রাণীর মস্তিষ্কের আকার ২০ শতাংশ কমে। কারণ প্রাণীদের আর নিজের খাবারের জন্য শিকার করা বা শিকারের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার প্রয়োজন হয় না। বন্য প্রাণীদের মতো ততটা বিপদের মুখোমুখি হতে হয় না।
কিন্তু কুকুরের ক্ষেত্রে বরং উল্টো হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে গৃহপালিত হলেও নেকড়ে থেকে বিবর্তনের পর থেকে যত সময় গড়াচ্ছে আর যত প্রজনন হচ্ছে, ততই বড় হচ্ছে কুকুরের মস্তিষ্ক।
গবেষক এনিকো কুবিনি বলেন, জটিল সামাজিক পরিবেশ, নগরায়ন এবং আরও নিয়মের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বাধ্য হওয়া এই পরিবর্তনের কারণ হতে পারে। সমস্ত আধুনিক জাতকেই বিষয়গুলো প্রভাবিত করছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
গবেষণায় বলা হয়েছে, মাথার খুলির আকৃতি, দীর্ঘায়ু কিংবা কুকুর ছানার আকারের সাথে আপেক্ষিক মস্তিষ্কের আকারের কোন সম্পর্ক নেই।
গবেষকেরা বিশ্বাস করেন, প্রাচীন কুকুর স্বাধীন ছিল মর্মে পাওয়া তথ্যকে আরও জোরদার করেছে তাদের অনুসন্ধানের ফলাফল।
স্টকহোম ইউনিভার্সিটির নিকলাস কোলম বলেন, বিভিন্ন কুকুর পৃথক সামাজিক জটিলতার মধ্যে বাস করে এবং জটিল কাজগুলো সম্পাদন করে, যার জন্য সম্ভবত একটি বড় মস্তিষ্কের ক্ষমতা প্রয়োজন।
অতএব, আমাদের ধারণা, কুকুরের প্রজাতির মধ্যে মস্তিষ্কের ওপর চাপ পরিবর্তিত হতে পারে। নেকড়ে থেকে তাদের বিবর্তনের সময়কাল কিংবা কাজ সম্পাদনের ভিন্নতার মধ্যে মস্তিষ্কের আকারের পার্থক্য থাকতে পারে।
এবার একটু পেছেনে ফিরে যেতে হবে। কুকুরের উৎপত্তির ইতিহাস জানতে হলে আগে জানতে হবে কুকুরের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস। যারা এ বিষয়ে গবেষণা করেন তারা এটুকু একমত যে, কুকুরের সাথে সবচেয়ে কাছাকাছি সম্পর্ক রয়েছে নেকড়ে বা গ্রে উল্ফের। জীবাশ্মবিদরা গবেষণা করে দেখেছেন যে নেকড়ের মতো দেখতে প্রাণীর উৎপত্তি প্রায় ৬০ মিলিয়ন বছর আগে যাদের নাম মিয়াসিস (Miacis)।
এরা এশিয়ায় বাস করত। ৩০ থেকে ৪০ মিলিয়ন বছর আগে এরা বিবর্তিত হয়ে বর্তমান নেকড়ের কাছাকাছি আকৃতি পায় যাদের নাম কায়ানোডিক্টিস (Cynodictis)। এরপর কয়েক লক্ষ বছরের বিবর্তনের ফলে এই কায়ানোডিক্টিস দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এক ভাগ যায় আফ্রিকায়, আরেক ভাগ যায় ইউরেশিয়ায়। এই ইউরেশিয়ান প্রজাতির নাম টমার্চাস (Tomarctus) যাদের থেকেই আজকের কেনিস ল্যুপাস (Canis lupus) অর্থাৎ নেকড়ে, শেয়াল এবং কুকুরের উৎপত্তি।
এতদিন ধরে প্রচলিত ছিল কুকুরের সাথে মানুষের সম্পর্ক অন্তত ১৫,০০০ হাজার বছরের পুরোনো। ঠিক কবে থেকে কুকুর আর মানুষ একসাথে থাকা শুরু করেছে তা নিয়ে মতভেদ ছিল। তবে ২০১৫ সালে সুইডিশ জিন তত্ত্ববিদ পন্টাস স্কোগলুন্ড সাইবেরিয়ায় পাওয়া নেকড়ের ফসিলের জিনের উপর গবেষণা করে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। যেখানে তিনি দেখিয়েছেন কুকুরের পূর্বপুরুষদের শিকারের সঙ্গী হিসেবে প্রায় ৩৬,০০০ বছর থেকে ৪০,০০০ বছর আগে থেকে ব্যবহার করা হত; যা প্রকারান্তরে গৃহপালিত করার প্রথম পর্যায়।
এই নেকড়ে থেকে কুকুর হয়ে ওঠার পেছনে কিছু কারণ খুঁজে পেয়েছেন গবেষকগণ। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে নেকড়ে এবং মানুষ দুই প্রজাতিই সঙ্গবদ্ধভাবে বসবাস করে। এরা দল ধরে শিকারে যায়। এই জটিল সামাজিক বন্ধনই তাদেরকে নিজেদের আকৃতির থেকে কয়েকগুণ বড় প্রাণী শিকার বা অন্যান্য শিকারি প্রাণীর আক্রমণ থেকে বাঁচার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। এই কারণেই নেকড়ে এবং মানুষ একসময় একে অপরের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়
তুলনামূলক উন্নত মস্তিষ্ক এবং প্রস্তরনির্মিত অস্ত্রের উদ্ভাবনের কারণে মানুষ শিকারের ক্ষেত্রে বেশি সফল হতে থাকে। দলছুট বা দলের অন্যান্য সদস্যদের থেকে তুলনামূলক দুর্বল নেকড়েরা মানুষের বসতির আশেপাশে ঘুরঘুর করা শুরু করে খাবারের গন্ধে। প্রথমদিকে হয়তো মানুষ তাদের আক্রমণ করে হত্যা করেছে, তবে একসময় অবশ্যই বুঝতে পেরেছে যে এরা মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়। ঠিক এই সময় থেকেই নেকড়ের পোষ মানার প্রথম পর্যায় শুরু হয়েছে।
দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে খাদ্যাভ্যাস। মানুষ একসময় শিকার ছেড়ে কৃষিকাজের দিকে মনোনিবেশ করে। তারা বুঝতে পারে, অনিশ্চিত শিকারের থেকে ফসল উৎপাদন করে ক্ষুধা মেটানো অনেক সহজ। তারা কৃষিকাজ শুরু করলে খাদ্যে আমিষের মাত্রা কমতে থাকে আর শর্করার মাত্রা বাড়তে থাকে।
একদিকে যেমন পোষমানা নেকড়েরা শিকার করা ছেড়ে দেয়, অন্যদিকে তাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তিত হতে থাকে। একসময় তাদের হিংস্রতা কমে যায়। তাদের এই বৈশিষ্ট্যই পরবর্তী প্রজন্মের নেকড়ের মাঝে বাহিত হয়। ধীরে ধীরে জিনগত পরিবর্তন ঘটে তাদের দাঁত এবং চোয়ালের আকার ছোট হয়, কান খাঁড়া থাকে না।
আরেকটি কারণ হচ্ছে যাযাবর মানুষের চলতি পথে এই পোষমানা নেকড়ে এবং বিভিন্ন অঞ্চলের নেকড়ের মধ্যে মিলনে সংকর প্রজাতির নেকড়ের উদ্ভব হয়েছে, যা বর্তমান কুকুরের কাছাকাছি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। যারা প্রাকৃতিক ভাবে সংকরায়িত হয়নি, তাই নেকড়ের বৈশিষ্ট্যও বজায় থাকেনি।
আধুনিক কুকুর এবং নেকড়েদের কিছু আকারগত এবং জিনগত পার্থক্য থাকলেও তারা অনেকদিক দিয়েই একই রকম। কুকুরের কান ঝুলে থাকে, এদের চোয়াল শিকার না করার কারণে ছোট, মাথা ছোট এবং নম্র স্বভাব। জিনগত পার্থক্যের মধ্যে রয়েছে খাবার হজমকারী অন্তত তিনটি জিন, যেগুলো শর্করা জাতীয় খাবার হজমে সাহায্য করে। এগুলো নেকড়েদের মধ্যে পাওয়া যায় না। এছাড়া একগুচ্ছ ভ্রূণ গঠনকারী জিন পাওয়া যায় যেগুলো কুকুরকে কুকুরসুলভ বৈশিষ্ট্য প্রদান করে।
মানুষের সাথে কুকুরের প্রথম সহাবস্থানের প্রমাণ পাওয়া যায় মধ্যপ্রাচ্যের ইজরায়েলে। ইজরায়েলের ইন-মাল্লাহ নামক স্থানে নাতুফিয়ান সংস্কৃতির একটি কবর পাওয়া যায় যেখানে একজন বৃদ্ধকে একটা ছয়-সাত মাস বয়সী কুকুরের সাথে কবর দেওয়া হয়, যা প্রায় ১২,০০০ বছরের পুরোনো।
এসডব্লিউএসএস/১৬৩৫
আপনার মতামত জানানঃ