প্রাচীন মিশর মানেই চারপাশে মরুময় তপ্ত বালুরাশির বুকে যেন ফেরাউনের পদচারণা। ফেরাউন, অত্যাশ্চর্য পিরামিড, হাজার বছরের মমি আর লুকিয়ে থাকা হাজারো লুকানো রহস্যের ভয়াল ইশারা। আমরা আজকে জানার চেষ্টা করবো মিশরের দশ ফেরাউনের অজানা ইতিহাস সম্পর্কে।
প্রাচীন যুগে মিশরীয় শাসকদেরকে ফেরাউন নামে অভিহিত করা হতো। ফেরাউনরাই জনপ্রতিনিধি হিসেবে মিশরের রাজা বলে বিবেচিত হতো। মিশরের রাজ সিংহাসনে সর্বমোট ১৭০জন ফেরাউনের রাজ্য শাসনের ইতিহাস জানা যায়, তবে এটি বিশেষজ্ঞদের অনুমান মাত্র।
বংশপরম্পরায় এসব ফেরাউনরা উত্তরাধিকারসূত্রে রাজমুকুট তাদের সন্তানদের কাছে হস্তান্তর করে যেতো। অগণিত ফেরাউন শাসনের মধ্য দিয়ে হাজার বছরের ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রাচীন এই মিশরীয় সভ্যতা।
তবে আজ আমরা বলব ফারাওদের শুরুটা নিয়ে। চলে যাব আজ থেকে প্রায় ৫,০০০ বছর আগে ফারাও নারমারের যুগে, যার হাত ধরে এক হয়েছিল মিশরের উচ্চ আর নিম্নভূমি, শুরু হয়েছিল ইতিহাসের প্রথম সাম্রাজ্যের, মহাপ্রতাপশালী মিশরীয় সাম্রাজ্যের।
নারমার ছিলেন পুরো মিশরকে শাসন করা প্রথম রাজা এবং প্রথম রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা, যিনি কি না মিশরের উচ্চ এবং নিম্নভূমিকে এক করেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩১৫০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২৬১৩ পর্যন্ত মিশর শাসন করেছিল এই নারমারেরই উত্তরপুত্ররা। এদের মধ্যে নারমার নিজেই প্রায় অর্ধ শতাব্দী রাজত্ব করেছিলেন মিশরে।
অনেকে অবশ্য বলে থাকেন, দুই ভূমিকে এক করবার কৃতিত্ব পুরোপুরি নারমারের নয়। কেননা ৩১৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগে থেকেই দুই ভূমিকে এক করবার আয়োজন শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নারমার এই কাজকে সম্পূর্ণ করেন। এতক্ষণ দুই ভূমির কথা শুনে আপনাদের মনে হতেই পারে, উচ্চভূমি আর নিম্নভূমি বলতে কী বোঝানো হচ্ছে? কোনো ভূতাত্ত্বিক বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত নয়, সে সময়ের মিশরের প্রেক্ষাপটে ‘দুই ভূমি’ পরিভাষাটির অর্থ একটু আলাদা।
নারমারের পূর্বে মিশর ছিল উচ্চ ও নিম্ন দুই ভাগে বিভক্ত। উচ্চ মিশর ছিল শহরকেন্দ্রিক ধনী রাজ্য, যার চালিকাশক্তি ছিল বাণিজ্যনির্ভর শক্তিশালী অর্থনীতি। একজন রাজার অধীনে শাসিতে হতো সেই উচ্চভূমি। অন্যদিকে নিম্ন মিশরে ছিল কৃষিনির্ভর গ্রামভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা, যা শাসন করত গ্রাম-প্রধানরা।
যা-ই হোক, উচ্চ মিশরের মসনদে আসীন হলেন নারমার। সিংহাসনে বসেই নারমার উদ্যোগ নেন দুই মিশরকে এক করবার। এ লক্ষ্যে নিম্ন মিশরের গ্রাম-প্রধানদের কাছে রাজকীয় দূত-মারফত শান্তিপূর্ণভাবে নিজ রাজ্যে অন্তর্ভূক্তির প্রস্তাব পাঠান। কিন্তু তার এ শান্তিপূর্ণ প্রস্তাবে মেলেনি গ্রাম-প্রধানদের সাড়া। অপমানিত বোধ করলেন নারমার। আর সেই অপমানেরই বদলা নিতে প্রস্তুত করলেন তার বাহিনীকে।
নারমার তার বর্শা ও তীর-ধনুকে সজ্জিত সেনাবাহিনী নিয়ে উত্তর দিকে, অর্থাৎ নিম্ন মিশর-পানে অগ্রসর হন। তার এই অভিযানের খবর পেয়ে সকল গ্রাম-প্রধানেরা মিলে নিজেদের রক্ষার জন্য সামরিক জোট গঠন করে। নীলনদের ব-দ্বীপের কোনো এক জায়গায় আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে দুই বাহিনী মুখোমুখি হয়। যুদ্ধে অবধারিতভাবেই জয় হয় নারমারের সুসজ্জিত-প্রশিক্ষিত বাহিনীর। আর এর মধ্য দিয়েই মিশরের ইতিহাসে প্রথমবার দুই ভূমি একত্রিত হয়।
দুই ভূমি সংযুক্ত হওয়ার প্রতীক হিসেবে উচ্চ ভূমির সাদা মুকুট আর নিম্ন ভূমির লাল মুকুট যুক্ত করা হয়। জন্ম হয় ফারাওদের দ্বৈত মুকুটের, যা শোভা পেত প্রত্যেক ফারাওয়ের মাথায়। এই দ্বৈত মুকুট দিয়ে দুই ভূমির একচ্ছত্র মালিকানা বোঝানো হতো। দক্ষিণ দিক বা উচ্চ মিশরের প্রতীক হিসেবে পদ্ম এবং উত্তর দিক বা নিম্ন মিশরের প্রতীক হিসেবে পাপাইরাস তুলে দেওয়া হয় নারমারের হাতে।
নারমারকে ঐতিহাসিক অসংখ্য বর্ণনায় মিশরের প্রথম ফারাও বলা হলেও মূলত সেই সময়ে ফারাও শব্দের প্রচলন ছিল না। নারমারকে সাধারণ রাজা হিসেবেই ডাকা হতো।
ফারাও শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয় নারমারের বিদায়ের প্রায় হাজার দেড়েক বছর পর, নতুন রাজবংশের শাসনামলে। সংখ্যার হিসেবে তা ১৫৫০ থেকে ১০৭৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যবর্তী কোনো একটা সময়। সে সময় থেকেই মূলত পূর্ব-পরের সকল প্রাচীন মিশরীয় শাসনকর্তাকে ফারাও সম্বোধন করা হয়।
বিজয়ের পর নিম্ন ভূমির ওপর নিজের শাসন পাকাপোক্ত করতে নাকাদার (Naqada) রাজকন্যা নীথহোটেপকে (Neithhotep) বিয়ে করেন নারমার। শাসনকাজের সুবিধার জন্য তিনি তার রাজধানী নেখেন (Nekhen) থেকে উত্তরে মেম্ফিস (Memphis) নিয়ে যান। পাশাপাশি উত্তরের বিদ্রোহ দমন করে কেনান ও নুবিয়াতে অভিযান পরিচালনা করে সেগুলোকেও রাজ্যভুক্ত করেন। সারা মিশর জুড়ে তিনি অসংখ্য বৃহৎ নির্মাণ প্রকল্প শুরু করেন। এর ফলে সারা মিশরে নতুন নতুন শহর গড়ে ওঠে।
দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর এভাবেই রাজ্যবিস্তার ও একীভূত মিশরের ভিতকে শক্ত করার পর মৃত্যুবরণ করেন নারমার। শিকার করতে গিয়ে জলহস্তির আক্রমণে নিহত হয়েছিলেন। তার মৃতদেহ মমি করে উম আল-কা’ব (Umm el-Qa’ab)-এর সমাধি মন্দিরের বি-১৭ ও বি-১৮ চেম্বারে সমাহিত করা হয়।
১৮৯৭-১৮৯৮ সালে ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ কুইবেল অ্যান্ড গ্রীন, নেখেনের হোরাসের মন্দির থেকে উদ্ধার করেন নারমার প্যালেট। এই শিলালিপি থেকেই সর্বপ্রথম নারমারের পরিচয় সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। শিলালিপিটি ৬৪ সেন্টিমিটার লম্বা। আস্ত পাললিক শিলা থেকে প্রস্তুতকৃত এই পাতটি নারমার বিজয়ের স্মারক হিসেবে দেবতা হোরাসকে উৎসর্গ করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়।
শিলালিপিটির এক পিঠে (ছবির ডান পাশের) দেখা যায়, নারমার লাল মুকুট পরে আছেন, যা বলে দেয় তিনি নিম্ন মিশর জয় করেছেন। সেই সঙ্গে দেখা যায়, নারমার তার বাহিনী নিয়ে বিজয় উদযাপন করছেন। তাদের সামনে পড়ে আছে পরাজিত শত্রুর মৃতদেহ, যা যুদ্ধে নারমারের বিজয়-গৌরবকেই নির্দেশ করে।
মাঝে দেখা যায়, তার দুজন সহকারী দুটি অদ্ভুত প্রাণীর গলার রশি ধরে আছে, যা উচ্চ ও নিম্ন ভূমিকে নির্দেশ করে। শিলালিপিটির একেবারে শেষে দেখা যায়, নারমার একটি শক্তিশালী ষাঁড়ের রুপে তার শত্রুকে পা দিয়ে চেপে ধরেছেন, যা তার শক্তি প্রদর্শন করছে। শিলালিপিটির বাম পাশে দেখা যায়, নারমার তার মুগুর হাতে শত্রুকে আঘাত করছেন এবং নিচে তার ভয়ে দুজন পালিয়ে যাচ্ছে। ওদিকে হোরাস-রূপী বাজপাখি তাকে আশীর্বাদ করছে। এটিও শত্রুদের বিরুদ্ধে তার জয়লাভেরই ভাব-প্রকাশক।
অনেকেই মনে করে থাকেন, মেনেস-ই মিসরের প্রথম ফারাও, কিন্তু মেনেসকে শুধু লোককাহিনীতেই পাওয়া যায়, এখন পর্যন্ত মেনেসের কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি, যেখানে নারমারের ব্যাপারে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ আছে।
প্রখ্যাত মিশরীয় ইতিহাসবেত্তা ফ্লিন্দার পেত্রি দাবি করছেন, নারমার আর মেনেস একই ব্যক্তি। তার ভাষ্যমতে, মেনেস মূলত নারমারেরই উপাধি। আরেক বর্ণনায়, মেনেস হল খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর মিশরের ইতিহাসবিদ ম্যানথো দ্বারা প্রদত্ত নামের গ্রিক রূপ। অন্যদিকে আরেকদল দাবি করে, কিং স্করপিয়ন মিশরের প্রথম ফারাও। এই দাবির পক্ষেও তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।
বেশ কিছু বছর আগে একটি ম্যুরাল পাওয়া গেছে, যেখানে দেখা যায় স্করপিয়ন উচ্চভূমির সাদা মুকুট পরে আছে, ইতোপূর্বেও তাকে কখনো লাল মুকুটে দেখা যায়নি। এ থেকে ধারণা করা হয়, স্করপিয়ন দক্ষিণ মিশরের রাজা ছিলেন এবং কখনোই উত্তর মিশর শাসন করেননি।
অন্যদিকে নারমার প্যালেটে দেখা যায়, নারমার দক্ষিণের সাদা আর উত্তরের লাল- উভয় মুকুটই পরিহিত আছেন, যা থেকে বলা যায়, তিনি পুরো মিশরই অবিসংবাদিতভাবে শাসন করছেন। এ থেকেই প্রমাণ হয়, নারমারই অখণ্ড মিশরকে শাসন করা প্রথম ফারাও।
এসদব্লিউ/এসএস/১৮৫০
আপনার মতামত জানানঃ