একবিংশ শতাব্দীতে এসে নানা ধরনের আবিষ্কারের কথা শুনে আমরা বেশ অবাক হয়ে যাই। অথচ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রাচীন সব পাণ্ডুলিপি যখন হঠাৎ করেই আমাদের সামনে হাজির হয়, তখন সেই আমলের মানুষের চিন্তাভাবনা আমাদের টনক নড়িয়ে দিতে বাধ্য করে। বলছিলাম সিবিউ পাণ্ডুলিপির কথা।
আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগেকার এই পাণ্ডুলিপিটিতে তরল জ্বালানি, কামান, ক্ষেপণাস্ত্র ও একাধিক প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট রকেট তৈরির বর্ণনা দিয়েছেন কনরাড হাস নামক এক ব্যক্তি। চোখ কপালে তোলা সেই পাণ্ডুলিপিটি নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।
শুরুতেই আসা যাক কনরাড হাসের প্রসঙ্গে। ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপে খুব উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা ছিলো প্রটেস্ট্যান্ট রিফরমেশন। পোপ কর্তৃক খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের এক শ্রেণীকে অস্বীকৃতি জানানোর পর পুরো বিষয়টিকে ঢেলে সাজানোর একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়।
এর ফলে গোটা ইউরোপ ক্যাথোলিক এবং প্রটেস্ট্যান্ট, মোটা দাগে এই দুই গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে যায়। দুই দলে ভাগ হয়ে চলতে থাকে তাদের মধ্যকার অরাজকতা। আর এদিকে প্রাচ্যে তখন অটোমান সাম্রাজ্য বেশ বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। ১৫২৯ সালে বিধানকর্তা সুলাইমানের হাত ধরে তারা এমনকি ভিয়েনার গেট অব্দি পৌঁছে যায়। এমনই এক দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় শতাব্দীতে জন্ম হয় কনরাড হাসের।
হাস ছিলেন অস্ট্রিয়ান অথবা ট্রানসিলভানিয়ার স্যাক্সন সামরিক প্রকৌশলী। হাঙ্গেরিতে কর্তব্যরত এই ইঞ্জিনিয়ার রকেটের প্রধান নকশাকারী হিসেবে পরিচিত। তার নকশা করা রকেটের মধ্যে তিন স্তর বিশিষ্ট একটি রকেট এবং মনুষ্যবাহী রকেটের অস্তিত্বও পাওয়া গেছে।
১৫০৯ সালে জন্ম নেয়া হাস অস্ত্র প্রকৌশলী এবং প্রশিক্ষক হিসেবে রকেট প্রযুক্তি নিয়ে জার্মান ভাষায় একটি প্রবন্ধ লেখেন। শুধু রকেটই নয়, এখানে ক্ষেপণাস্ত্র, আগ্নেয়াস্ত্র সহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রের বিবরণও দিয়েছেন তিনি।
১৯৬১ সালে আবিষ্কৃত হয় হাসের পাণ্ডুলিপিটি। সিবিউয়ের পাবলিক রেকর্ড থেকে এটি উদ্ধার করা হয় বলে একে ‘সিবিউ পাণ্ডুলিপি’ বলেই ডাকা হয়। ডেলটা বা ত্রিভুজাকৃতির ডানা, ঘণ্টাকৃতির নল, বিভিন্ন তরলের সংমিশ্রণে তরল জ্বালানি তৈরি থেকে শুরু করে কয়েক প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট রকেটের গতিতত্ত্বও আবিষ্কার করেছিলেন হাস।
তার সেই প্রবন্ধের মূল পাণ্ডুলিপিটিতে উল্লেখিত রকেটের সামরিক ব্যবহার সংক্রান্ত অধ্যায়ের শেষ অনুচ্ছেদে তিনি লিখেছেন, “আমার উপদেশ থাকবে যুদ্ধকে না বলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আরও বেশি মনোনিবেশের প্রতি। শান্তভাবে রাইফেলগুলো গুদামে রেখে আসা উচিত, যাতে আর একটি গুলিও না চলতে পারে, গানপাউডারগুলোও খরচ না হয়। এতে একদিকে যেমন রাজার টাকা বেঁচে যাবে, অন্যদিকে অস্ত্রাগারের রক্ষীর চাকরিটাও টিকে যাবে বহুদিন। কনরাড হাস তোমাদেরকে অস্ত্রের অপব্যবহার না করার উপদেশ দিচ্ছে।”
হাসের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায়নি। ইতিহাসে প্রায় বিস্মৃত হাসকে নতুন করে সামনে উপস্থিত করে এই পাণ্ডুলিপিটি। বলা হচ্ছে, এটি মূল পাণ্ডুলিপির তৃতীয় খণ্ড, যা লেখা হয়েছিল প্রায় ১৫০০ সালের দিকে। সামরিক এ ইঞ্জিনিয়ার এখানে ‘ফ্লাইং জ্যাভেলিন’ বা ‘উড়ুক্কু বর্শা’ নামক এক নতুন প্রযুক্তির বর্ণনা দিয়েছেন, আশ্চর্যজনকভাবে যা বহুস্তর বিশিষ্ট রকেটের বর্ণনার সাথে বহুলাংশে মিলে যায়। কাজেই ইতিহাস খুঁড়ে হাসের নাম নতুন করে উত্থিত হবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
এতদিন ধরে পোল্যান্ডের আর্টিলারি বিশেষজ্ঞ কাজিমিয়ার্জ সিমেনোউইকজকে রকেট উদ্ভাবকের স্বীকৃতি দেয়া হতো। ১৬৫০ সালে তিনি তিন স্তর বিশিষ্ট রকেটের নকশা প্রণয়ন করেছিলেন। পাণ্ডুলিপিটি আবিষ্কৃত হওয়ার পর কাজিমিয়ার্জকে হটিয়ে রকেট উদ্ভাবকের জায়গায় নাম লেখান কনরাড হাস।
সিবিউ পাণ্ডুলিপিটি উদ্ধার করেন ডরু তোদেরিকিউ। রোমান এই লেখক, ঐতিহাসিক, গবেষক সিবিউয়ের স্টেট আর্কাইভের পুরনো পাণ্ডুলিপি নিয়ে কাজ করছিলেন। এরই মধ্যে তার চোখে পড়ে হাসের পাণ্ডুলিপিটি। সময়ের চেয়ে কয়েক গুণ এগিয়ে থাকা এই পাণ্ডুলিপিটি ডরুকে একটি স্বতন্ত্র গবেষণার খোরাক যোগায়। জার্মান ভাষায় লেখা পাণ্ডুলিপিটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪৫০। সিবিউয়ের স্টেট আর্কাইভ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বলে ডরু নিজেই এর নাম দেন ‘সিবিউ পাণ্ডুলিপি’। প্রযুক্তিগত দিক থেকে সে সময় খুব বেশি উন্নতি না ঘটলেও হাসের চিন্তা-ভাবনা ছিল অভূতপূর্ব ও চমকপ্রদ।
১৯২৬ সালের ১৬ মার্চ রবার্ট গোদার্ড ম্যাসাচুসেটসে বিশ্বের প্রথম তরল জ্বালানি বিশিষ্ট রকেট উৎক্ষেপণ করেন। এর আগপর্যন্ত সাধারণ মানুষ ভাবতেও পারেনি যে এমন কিছু আবিষ্কার করা সম্ভব। অথচ তারও প্রায় ৫০০ বছর আগে এমন একটি অভিনব জিনিসের নকশা তৈরি করে ফেলেছিলেন হাস।
পাণ্ডুলিপির তৃতীয় খণ্ডে ১৫৫৫ সালে সিবিউ শহরে হাজার হাজার মানুষের সামনে একাধিক টায়ার বিশিষ্ট একটি রকেট উৎক্ষেপণের সফল বর্ণনাও রয়েছে। ঘটনাটি কতটুকু সত্যি বা কতটুকু মিথ্যে, তা যাচাই করার উপায় নেই। তবে হাসের নিজ হাতে আঁকা রকেটের বিভিন্ন ছবি রকেট উৎক্ষেপণ না হলেও আবিষ্কারের প্রমাণ বহন করছে।
শত শত বছর আগে একজন মানুষ রকেট বিজ্ঞানের এত জটিল প্রক্রিয়া কীভাবে আবিষ্কার করলেন, তা এক রহস্যই বটে। শুধু রকেট নয়, মহাকাশযান, তরল জ্বালানি এবং ত্রিভুজাকৃতির ডানা- এতগুলো চমকপ্রদ আবিষ্কার হাসের সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে।
সিবিউ পাণ্ডুলিপি বর্তমানে রোমানিয়ায় সংরক্ষিত আছে। অনেকেই অবশ্য এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের ভাষ্যমতে, এত বছর আগে যেহেতু এমন জটিল পদ্ধতি নিয়ে কাজ করার সুযোগ ছিল না, সেহেতু ডরু নিশ্চয়ই নিজ হাতে এগুলো লিখে সবাইকে ধোঁকা দেয়ার পাঁয়তারা করছে।
তাদের এই সন্দেহের ভিত্তিতে পরবর্তীতে গবেষকরা হাসের বর্ণনা করা পুরো প্রক্রিয়াটি খতিয়ে দেখেন। ধোঁয়া এবং জ্বালানির হিসাবে সেখানে বেশ কিছু গরমিল তাদের চোখে পড়ে, যার ফলে ঐ বর্ণনানুযায়ী সফলভাবে রকেট উৎক্ষেপণ করা সম্ভব কিনা, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। তবুও এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার জন্য হলেও একবার অন্তত সিবিউ পাণ্ডুলিপিটি পড়ে দেখা প্রয়োজন।
অসংখ্য নকশা আর আর্টিলারি, ক্ষেপণাস্ত্র, আগ্নেয়াস্ত্রের বর্ণনা সম্বলিত সিবিউ পাণ্ডুলিপি আবিষ্কৃত হওয়ার আগপর্যন্ত রকেট উদ্ভাবনের জগতে কাজিমিয়ার্জ ছাড়াও আরেকজন বেশ নাম করেছিলেন। ষোড়শ শতাব্দীতে ব্যাভেরিয়ান আতশবাজি নির্মাতা জোহান স্কিমিডলাপ দ্বি-স্তরবিশিষ্ট রকেট নির্মাণ করেন বলে জানা যায়। ১৫৯০ সালের দিকে তিনি প্রথম এ ব্যাপারে নিরীক্ষা চালান।কাজিমিয়ার্জ নিজেও তিন স্তর বিশিষ্ট রকেটের নকশা প্রণয়ন করেন ১৬৫০ সালে। কাজেই তাদের সমসাময়িক উদ্ভাবক হাস যদি আগেই রকেটের নকশা প্রণয়ন করেন, তবে তা খুব একটা অবিশ্বাস্য হবে না।
হাসের নকশাকৃত রকেট পরবর্তীতে উৎক্ষেপিত হয় কেপ কেনেডিতে। মার্কারি, জেমিনি এবং অ্যাপোলো নামক নাসার কয়েকটি প্রোগ্রামেও পরীক্ষামূলকভাবে তা ব্যবহৃত হয়েছে বলে জানা যায়। রোমানিয়ার সিবিউ জাদুঘরে সংরক্ষিত মূল পাণ্ডুলিপিটির তত্ত্বাবধায়নে ছিলেন লেডি সালা শাবাজ। ২০০২ সালের ২৮ মার্চ তিনি মারা যান।
তিনি বলেছিলেন, “দুর্ভাগ্যবশত বহু বছর আগে লেখা অধিকাংশ পাণ্ডুলিপিতে কুসংস্কার আর গোঁড়ামির ছাপ বেশি পাওয়া যায়। ব্যক্তিগত ডায়েরিগুলোতেও মানুষ কেন যেন মনের মাধুরী মিশিয়ে ঐতিহাসিক ঘটনা বিকৃত করত, এমন প্রমাণ আমি নিজে দেখেছি। এত শত ঠিক-বেঠিকের ভিড়ে অনেক সময় দরকারি বা কাজের তথ্য সংবলিত গুরুত্বপূর্ণ পাণ্ডুলিপিগুলো জনসাধারণের অগোচরে চলে যায়। অথচ এমন দুয়েকটি লেখাই যথেষ্ট সে সময়কার মানুষের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সাথে বর্তমান প্রজন্মের পরিচয় করিয়ে দিতে। এমন আরও কিছু তথ্য আবিষ্কৃত হলে তৎকালীন মানুষের প্রতি আমাদের ধারণাই পাল্টে যাবে। ডরুকে ধন্যবাদ হাসের এমন তথ্যবহুল পাণ্ডুলিপিটি উদ্ধার করার জন্য”।
সিবিউ শহরটি এমন নানা ধরনের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের জন্য বেশ আগে থেকেই খ্যাতি লাভ করেছে। হাসের এই পাণ্ডুলিপি সিবিউয়ের অর্জনের মুকুটে নতুন পালক সংযোজিত করেছে।সূত্র: রোয়ার বাংলা।
এসডব্লিউএসএস১৯১০
আপনার মতামত জানানঃ