সিগমান্ড ফ্রয়েড বলেছিলেন যে, দুটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব মানুষের মনস্তত্ত্বকে নাটকীয়ভাবে প্রভাবিত করেছে: প্রথমত, পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয়। দ্বিতীয়ত, আজ থেকে অন্তত ৪৫০ কোটি বছর আগে পৃথিবী তৈরি হলেও, খুব অল্প সময় হয়েছে মানুষ এই গ্রহে বসবাস শুরু করেছে। তার আগে পৃথিবীতে মানুষ ছাড়া আর সবকিছুই ছিল।
আর অবাক করা বিষয় যা যোগ করা প্রয়োজন তা হল, আমরা মানুষ একদম নিখুঁত নই। এর মানে হচ্ছে, মানব প্রজাতির শারীরিক নকশা বা কাঠামো অনেক উন্নত, সেটাও বলা যাবে না। বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সময় গবেষণায় দেখেছেন, বহু বিবর্তনের পরও মানবশরীরে বেশকিছু ‘ত্রুটি’ রয়ে গেছে। তার কয়েকটি জেনে নেয়া যাক, চলুন।
পুরুষের প্রজননতন্ত্র
মানবশরীর কতটা দুর্বলভাবে ডিজাইন করা হয়েছে তার একটি স্পষ্ট উদাহরণ হতে পারে পুরুষের প্রজননতন্ত্র। এই ধরনের সংবেদনশীল অঙ্গ সম্পূর্ণরূপে উন্মুক্ত রাখা খুব স্মার্ট বা সর্বোত্তম উপায় বলে মনে হয় না। এই অঙ্গটিকে ফুসফুস বা হৃদপিণ্ডের মতো সুরক্ষিত রাখা গেলে আরও ভাল হতো।
সমস্যা হল, পুরুষদের জননকোষ বা শুক্রাণু, শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় অর্থাৎ ৩৬ দশমিক পাঁচ ডিগ্রী সেলসিয়াসে সঠিকভাবে বিকাশ লাভ করতে পারে না এবং সেই তাপমাত্রা কিছুটা কমানোর সমাধান আমরা কমবেশি সবাই জানি।
অন্যান্য প্রাণী, বিশেষ করে যারা উষ্ণ রক্তের নয়, যেমন ব্যাঙ, তাদের পুরুষ প্রজনন অঙ্গ ভালভাবে সুরক্ষিত এবং নিরাপদে থাকে। এমনকি কিছু উষ্ণ রক্তের প্রাণী যেমন হাতির প্রজনন অঙ্গ বেশ নিরাপদ থাকে। পুরুষ হাতিদের জননকোষের ক্ষতি হওয়ার তেমন আশঙ্কা থাকে না।
পিঠে ব্যথা
নিঃসন্দেহে মানবশরীর কতটা দুর্বলভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, তার আরেকটি উদাহরণ হতে পারে ‘মেরুদণ্ড’। আপনি এমন কোন মানুষ পাবেন না, যাদের জীবনে এক বা একাধিক পিঠের সমস্যা নেই? স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে যারা চার পায়ে হাঁটে, তাদের মেরুদণ্ডের কশেরুকা অনুভূমিকভাবে সাজানো থাকে।
কশেরুকাগুলো পাশাপাশি বসে একটি খিলান তৈরি করে যা ওই প্রাণীর শরীরের বাকি কাঠামোকে দক্ষতার সাথে জুড়ে রাখে। তবে মানুষ যেহেতু দুই পায়ে ভর করে চলা প্রাণী তাই আমাদের মেরুদণ্ড আক্ষরিকভাবে লম্বালম্বি কলামে সাজানো।
এ ধরণের বিন্যাসের কারণে শরীরের নীচের দিকের কশেরুকাগুলোকে বেশি ওজন ও চাপ বহন করতে হয়। সে কারণে মানব প্রজাতির কটিদেশ অর্থাৎ পিঠে ও কোমরে ব্যথার সমস্যা খুব সাধারণ বিষয়।
চোখের ব্লাইন্ড স্পট
মানুষের চোখও মানবদেহের বিবর্তনের দুর্বলতার উদাহরণ। মানুষের রেটিনা ফটো-রিসেপ্টর দিয়ে আবৃত থাকে। রেটিনার কাজ হল আলোর তথ্য ক্যাপচার করা বা গ্রহণ করা এবং সেই তথ্য অপটিক নার্ভের মাধ্যমে আমাদের মস্তিষ্কে পাঠানো।
সমস্যা হল যে বিন্দুতে অপটিক স্নায়ু রেটিনা অতিক্রম করে সেখানে কোন ফটো-রিসেপ্টর নেই, যার মানে আমাদের প্রত্যেক চোখে একটি ‘ব্লাইন্ড স্পট’ বা ‘অন্ধ দাগ’ রয়েছে। আমাদের মতো অন্য প্রাণীদের চোখে এমন দাগ নেই। যেমন অক্টোপাসের চোখে কোন ব্লাইন্ড স্পট নেই।
অক্টোপাসের চোখে, অপটিক নার্ভ ফাইবারগুলো রেটিনার পেছনে থাকে, তাই আলোর তথ্য মস্তিষ্কে পাঠানোর পথে অপটিক নার্ভের প্রয়োজন হয় না। এ কারণে মানুষের মতো অক্টোপাসের চোখে কোন ব্লাইন্ড স্পট নেই।
গলা এবং দম বন্ধ হওয়া
আমাদের শরীরের দুর্বল নকশার আরেকটি বড় উদাহরণ হল মানুষের গলা। সুস্থ প্রজাতির মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যুর প্রথম কারণ হল শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যু। গত বছর স্পেনে গাড়ি দুর্ঘটনার চেয়ে দ্বিগুণ মানুষ শ্বাসরোধে মারা গিয়েছে।
যে টিউবগুলো আমাদের দেহে খাদ্য এবং বায়ু বহন করে সেগুলো শরীরের কয়েকটি পয়েন্টে একটার সাথে একটা খুব বিপজ্জনকভাবে জড়ানো থাকে। গলবিল তেমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট।
গলবিল হল একটি ফাঁপা টিউব যেটি নাকের পেছন থেকে শুরু করে ঘাড় ও গলা বেয়ে নামে। সাধারণত পানি ও খাবার খাদ্যনালীতে যায় এবং বাতাস যায় শ্বাসনালীতে। কিন্তু কখনও কখনও এই সিস্টেমে কিছু ভুল হয়ে যেতে পারে। যদি খাবার খাওয়ার সময় সামান্য পরিমাণ খাবারও ভুল করে শ্বাসনালীতে ঢুকে পড়ে তাহলে সেটি শ্বাসরোধে মৃত্যুর মতো মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। মানবদেহ ভালভাবে ডিজাইন করা হয়নি বলেই মানুষ দ্রুতগতিতে আঙ্গুর খেতে পারে না।
বিবর্তন এবং বুদ্ধিমান নকশা নয়
মানবদেহের ত্রুটিপূর্ণ বা দুর্বল নকশার এগুলো কয়েকটি উদাহরণ মাত্র, তবে মূল তালিকা আরও দীর্ঘ। যেমন নারীদের প্রসব পথ, অপেক্ষাকৃত অনমনীয় পায়ের পাতায় অধিক সংখ্যক হাড়, রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়া, মানুষের জিনের গঠন, নার্সমেইড এলবো ইত্যাদি। নার্সমেইড এলবো হল যখন হাতের লিগামেন্ট জায়গা থেকে সরে কনুইয়ের জয়েন্টের দুটি হাড়ের মধ্যে আটকে পড়ে।
এই সমস্যা মূলত চার বছর বা তার কম বয়সী শিশুদের মধ্যে দেখা যায়। সাধারণত হাত ধরে জোরে টানাটানি করলে, ঝুলে থাকলে বা অতিরিক্ত চাপ পড়লে শিশুদের এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। আমরা মানব প্রজাতিকে বিবর্তন প্রক্রিয়ার ফল হিসাবে ব্যাখ্যা দিয়ে থাকি। যার শারীরিক গঠন বা নকশা পুরোপুরি নিখুঁত বলা যাবে না।
অন্য সব বিদ্যমান বা বিলুপ্ত প্রাণীর যেসব বৈশিষ্ট্য রয়েছে মানুষ বা হোমো স্যাপিয়েন্সে মধ্যেও সেই একই বৈশিষ্ট্য সমানভাবে কাজ করে। এর মধ্যে রয়েছে প্রকৃতির সাথে মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা, জিনগত বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন হওয়া, অন্য প্রজাতির সাথে প্রজনন প্রক্রিয়া ইত্যাদি।
মানুষ হল প্রকৃতির অনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার ফলাফল, যা ঘটতেও পারতো আবার নাও ঘটতে পারতো। এবং ভাবা হয়, বিবর্তন প্রক্রিয়ায় আমাদের প্রাসঙ্গিক কোন ভূমিকা নেই। অন্যদিকে আমরা অন্য অনেক প্রাণীর মতোই সুযোগের ফলশ্রুতিতে জন্মেছি।
এসডব্লিউএসএস/১৮০০
আপনার মতামত জানানঃ