ডন লুচ্চেসের বিখ্যাত উক্তি ছিল- ‘অর্থনীতি একটি বন্দুক। রাজনীতি জানে, কখন ট্রিগার টানতে হবে।’ উল্লেখ্য, বাংলাদেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে অচলাবস্থা ও সামাজিক ক্ষেত্রে অস্থিরতা থাকলেও অর্থনৈতিক সঙ্কট বাকি দু’টি সমস্যাকে ছাড়িয়ে বড় সঙ্কটের দ্বারপ্রান্তে। অর্থনীতি বিষয়টি জটিল।
সাধারণ মানুষ এর হিসাব-নিকাশ খুব কমই রাখে; কিন্তু তাদের জীবনে এর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া প্রতিফলিত হয় প্রতিদিন। সু-অর্থনীতি জনগণের জীবনে আনে সুখ ও সমৃদ্ধি। আর কু-অর্থনীতির দাপটে তাদের জীবন হয় দুঃখ ও কষ্টের। সামগ্রিকভাবে এর প্রভাবে অর্থনীতি হয় বিধ্বস্ত। দেশ হয় বিপর্যস্ত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনীতির সঙ্কটের মূল কারণ মূলত করোনা অতিমারী নয়। এমনকি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধও দেশের অর্থনীতির সঙ্কটের অন্যতম উৎস নয়; বরং এ যুদ্ধ কেবল সঙ্কটের মাত্রাকে বৃদ্ধি করেছে মাত্র। সঙ্কটের কারণগুলোর সূচনা হয়েছে আরো আগেই; তার একটি উদাহরণ হচ্ছে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত যা একের পর এক জটিল সঙ্কটের মুখে।
রাজনীতিবিদরাও স্বীকার করছেন, ব্যাংকিং খাত থেকে যে পরিমাণ অর্থ লুট হয়েছে, ‘ব্রিটিশরাও এভাবে এ দেশ লুট করেনি’। শেয়ার বাজার লুট ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুতে দুর্নীতি ইত্যাদিও দেশের সঙ্কটের অন্যতম। শেয়ারবাজারে এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের বাজার সম্পর্কে নিরাশ করে তুলছে।
অর্থনৈতিক সঙ্কট সবচেয়ে প্রবল হয়ে উঠছে বৈদেশিক বাণিজ্য, লেনদেন ও বিনিময় হারের ক্ষেত্রে। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছিল। এর প্রায় সবই অভ্যন্তরীণ সঙ্কট, বৈশ্বিক নয়।
দেশের অর্থনীতি আক্ষরিক অর্থেই কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। সংকট মোকাবিলায় সামনে বেশকিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে বলে মনে করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০২২-২৩: তৃতীয় অন্তবর্তীকালীন পর্যালোচনা’ শিরোনামে এক আলোচনায় সিপিডি এই তথ্য জানিয়েছে।
ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে শনিবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে পর্যালোচনাটি তুলে ধরেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। এতে তিনি বলেন, আমরা দেখছি যে, আমাদের অর্থনীতিতে বর্তমানে অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জ প্রতিভাত হচ্ছে। যে গতিধারাটা আমরা দেখছি, বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ কঠিন কিছু সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। এর একটি হচ্ছে বাহ্যিক, আরেকটি হচ্ছে অন্তর্নিহিত বা ভেতরের।
বাহ্যিক যে কারণগুলো আমরা দেখি, ২০২০ সালে যখন কোভিড প্যানডেমিকের (করোনাভাইরাস মহামারি) প্রতিঘাত সেটি এবং সেটা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই আমরা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মুখোমুখি হই ২০২০-এর ফেব্রুয়ারি মাসে।
এই অনুঘটকগুলোর কারণে আমরা দেখছি যে, আন্তর্জাতিক বাজারে যে পণ্যের মূল্য, সেটি অত্যন্ত উচ্চ দিকে, ঊর্ধ্বগতির দিকে গিয়েছিল। ফলে আমদানি পণ্যমূল্য বেড়ে যায়। আমদানির মূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে মূল্যস্ফীতি এবং তা ছাড়া আমাদের সরবরাহ শৃঙ্খলে একটা ব্যাঘাত ঘটেছিল।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, অভ্যন্তরীণ যে কারণগুলো আমরা দেখছি অন্তর্নিহিত যে কাঠামোগত দুর্বলতা, অর্থনীতিতে এবং নীতি নেয়ার ক্ষেত্রে একটা পূর্ণাঙ্গ নীতি না, কিছু কিছু সঠিক নীতিমালার একটা অভাব এবং যে নীতিগুলো নেয়া হয়, সেগুলো বাস্তবায়নেরও দুর্বলতা এবং তা ছাড়া সুশাসনের ঘাটতি এবং আমরা যে সমস্ত সংস্কারের কথা বলছি, সেই সংস্কার বাস্তবায়নের ব্যর্থতার কারণেও আমরা অনেক সমস্যাগুলো এখন দেখছি। যেগুলো খুব গুরুতরভাবে প্রতিভাত হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা কিন্তু ২০২২-এর জুলাই মাস থেকেই অর্থনীতির দুর্বলতাগুলি কোথায় এবং সেখানে প্রেশার পয়েন্টগুলো কোথায় এবং এগুলো যে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটা প্রভাব ফেলবে, সেগুলোর ব্যাপারে কিন্তু ক্রমাগতভাবে বলে এসেছি। ২০২৩ অর্থবছরের সামষ্টিক অর্থনীতির যে স্ট্রেসগুলো, অভিঘাতগুলো, সেগুলো যদি আমরা দেখি, সেগুলোর মূল মূল জায়গাগুলো কীভাবে প্রতিভাত হচ্ছে?
একটি হচ্ছে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সঞ্চালন। সেখানে কিন্তু আহরণ কম এবং যার ফলে আমাদের রাজস্বের ক্ষেত্রে একটা স্বাধীনতা, ফিসকাল স্পেস, সেখানে কিন্তু একটা সংকোচন ঘটছে এবং তার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়াটা বাড়ছে সরকারের।
সরকারের যে বাজেট ঘাটতি, সে ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার ব্যাপকভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে এবং তা ছাড়া যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে, সেখানে আমরা দেখছি যে তারল্যের একটা নিম্নগতি এবং প্রাইসের কথা, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঊর্ধ্বগতির কথা, লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি এবং সেটিও আমরা দেখতে পাচ্ছি।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, আমাদের বহিঃখাতের যে ভারসাম্য, সেটার ক্ষেত্রে একটা অধোগতি, নিম্নগতি, এই ভারসাম্যের ক্ষেত্রে এবং তার পাশাপাশি আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষেত্রে একটা নিম্নগতি দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে আমরা দেখছি এই প্রেক্ষিতটার কারণেই আমরা দেখছি এখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে ঋণ নিয়েছি। যাতে আমাদের যে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা, সেটা আমরা ফিরে পাই।
এসডব্লিউএসএস১৭৪০
আপনার মতামত জানানঃ