দেউলিয়ার দ্বারপ্রান্তে থাকা দেশের অন্যতম শিল্প গ্রুপ নাভানার বিপুল অঙ্কের দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ টেকওভার (অধিগ্রহণ) করছে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী। ব্যাংকবহির্ভূত ২০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) কাছে গ্রুপটির এ ধরনের ঋণ রয়েছে প্রায় ৯৫০ কোটি টাকা।
এতে করে এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে নাভানা গ্রুপের আর কোনো দায়স্থিতি থাকবে না। শুধু তাই নয়, নাভানার সব ঋণ নিয়মিতকরণ সাপেক্ষে ব্যাংকগুলো কর্তৃক নতুনভাবে আরও ৮১০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্তও হয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চার ব্যাংকের ঘাড়ে চেপে বসছে নাভানার ৯৫০ কোটি টাকা ঋণের দায় এবং ৮১০ কোটি টাকার নতুন ঋণ।
এর বাইরেও গ্রুপটির কাছে ব্যাংকগুলোর বর্তমানে কয়েকশ কোটি টাকার ঋণ তো রয়েছেই।
নাভানা গ্রুপের আর্থিক সংকটের উত্তরণ (বেইলআউট) নিয়ে সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকেই রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ টেকওভার ও নতুন ঋণ প্রদানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে নাভানা গ্রুপের কোম্পানিগুলো যে পরিস্থিতিতে পড়েছে, সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো অনেকটাই কঠিন। এর পরও সরকারের শীর্ষপর্যায়ের আগ্রহে গ্রুপটিকে এই বিশেষ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এসব সুবিধা নিয়েও যদি গ্রুপটি ঘুরে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ পড়বে ঝুঁকিতে। বিগত সময়ে দেখা গেছে, ব্যাংক খাতে ঋণ অধিগ্রহণের যেসব ঘটনা ঘটেছে, সে সবের বেশির ভাগই পরবর্তীকালে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, ব্যাংক খাতে এটা অহরহ ঘটছে। এ ধরনের প্রবণতা সুস্থ ব্যাংকিংয়ে সহায়ক নয়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ থাকার পেছনে দায়ী কিন্তু এ ধরনের ঋণ ক্রয় বা অধিগ্রহণই। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বড় বড় করপোরেট হাউসগুলো এভাবে সুবিধা নিয়েই চলছে।
তারা এক ব্যাংকে খেলাপি হলে, অন্য ব্যাংক থেকে আরেকটা বড় ঋণ নিয়ে আগেরটা পরিশোধ করছে। কিছুদিন পর সেই ঋণ আবার খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে। এগুলো করে আর কতকাল চলবে। তিনি আরও বলেন, সরকারের নির্দেশে এ ধরনের সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলে সেটা আরও খারাপ হচ্ছে। কারণ এর ফলে ভবিষ্যতে অন্য বড় বড় করপোরেট গ্রুপও এ ধরনের সুবিধা নিতে সরকারকে চাপ সৃষ্টি করবে।
এভাবে সবাই মিলে আমরা সরকারি ব্যাংকগুলোকে ভালনারেবল করে ফেলছি। পরে আবার আমরাই ব্যাংকগুলোর ওপর দোষ চাপাচ্ছি।
জানা গেছে, আর্থিক অবস্থার অবনতি হলে সংকট উত্তরণের জন্য ২০১৯ সালের শেষের দিকে নাভানা গ্রুপ আর্থিক সহায়তার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করে। আবেদনে দেশের বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে নেওয়া শিল্প গ্রুপটির সব ঋণ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো কর্তৃক অধিগ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হয়।
গ্রুপটির ওই আবেদনের পরই এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। এর আগে ব্যাংগুলোকেও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে আলাদাভাবে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়।
সূত্র বলছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ অধিগ্রহণের প্রক্রিয়াতে গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংক লিড ব্যাংক হিসেবে কাজ করলেও এখন সেই দায়িত্ব পালন করছে জনতা ব্যাংক। আর শুরু থেকে এ প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
জনতা ব্যাংকের এমডি আবদুল জব্বার আমাদের সময়কে বলেন, আমি ব্যাংকটিতে নতুন যোগদান করেছি। বিষয়টি নিয়ে আমার সঙ্গে এখনো কোনো আলোচনাও হয়নি। তাই এ নিয়ে কিছুই বলতে পারছি না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, তার কাছে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই। ফলে তিনি বিষয়টি নিয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না। বিষয়টি অনিষ্পন্ন অবস্থায় থাকায় রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য ব্যাংকগুলোর এমডিরাও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
জানা যায়, গত ৭ মে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নাভানা গ্রুপের ঋণ বেইলআউট নিয়ে চূড়ান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামাল। বৈঠকে উপস্থাপিত তথ্য বলছে, এই ২০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে নাভানা গ্রুপভুক্ত ৫টি প্রতিষ্ঠান আফতাব অটোমোবাইলস, নাভানা লিমিটেড, নাভানা রিয়েল এস্টেট, নাভানা কনস্ট্রাকশন ও নাভানা ব্যাটারিজের ঋণস্থিতি রয়েছে প্রায় ৯৬৫ কোটি টাকা।
এর মধ্যে আফতাব অটোমোবাইলসের ১৯১ কোটি ৯১ লাখ, নাভানা লিমিটেডের ২৬৭ কোটি ৬০ লাখ, নাভানা রিয়েল এস্টেটের ১১৪ কোটি ৫৮ লাখ, নাভানা কনস্ট্রাকশনের ৩৭৬ কোটি ও নাভানা ব্যাটারিজের ১৫ কোটি ৪৩ লাখ টাকার ঋণ রয়েছে। অন্যদিকে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ৪টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে এই ২০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায়স্থিতির (কলমানি ও ফান্ড প্লেসমেন্ট খাতে) পরিমাণ প্রায় ২ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের ৫১২ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংকের ৬০৭ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংকের ৬৮৭ কোটি টাকা এবং রূপালী ব্যাংকের ৭৪৬ কোটি টাকা।
এর আগে গত ৩০ মার্চ নাভানা গ্রুপের আর্থিক সংকট উত্তরণ (বেইলআউট) নিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেকটি বৈঠক হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন ডেপুটি গভর্নর আবু ফরাহ মো. নাছের। ওই বৈঠকেই মূলত ব্যাংকগুলো কর্তৃক নাভানা গ্রুপের আর্থিক প্রতিষ্ঠানে থাকা ঋণ অধিগ্রহণ ও গ্রুপটিকে নতুন ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়।
এসডব্লিউএসএস/১৫০০
আপনার মতামত জানানঃ